প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষা কাকে বলে ? প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষার বৈশিষ্টগুলি লেখ।
প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষা :-
বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষার ধারণাটি গড়ে উঠেছে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল নিয়ন্ত্রিত বা প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মেলবন্ধন ঘটিয়ে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষাকে উন্মুক্ত করে তোলা। প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষা নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মত চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রিত ও কঠোরভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ নয় আবার অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মত সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণমুক্ত নয়। শিক্ষার চারটি প্রধান উপাদান - শিক্ষার্থী , শিক্ষক , পাঠক্রম ও বিদ্যালয় - সবগুলিই প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষার অংশ কিন্তু নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার সঙ্গে তার কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।
প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষার বৈশিষ্ট :-
১. নমনীয়তা :-
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার সকল উপাদান যথা - পাঠক্রম , পঠন - পাঠন , মূল্যায়ন ও পরীক্ষা , শ্রেণীকক্ষে উপস্থিতি - ইত্যাদি সবকিছুই প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষায় বর্তমান থাকলেও নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার তুলনায় তা অনেকাংশে নমনীয়। যে সকল শিক্ষর্থী নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার কঠোরতার সঙ্গে স্বচ্ছন্দবোধ করতে পারেনা , তারা প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষায় উপকৃত হতে পারে।
২. নির্দিষ্ট সময়সীমা না থাকা :-
প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষায় নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা থাকেনা। এখানে শিক্ষার্থী নিজের সুবিধামত যেকোনো সময়ে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষায় নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মত নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়া ও পঠন - পাঠনে অংশগ্রহণ করা বাধ্যতামূলক নয়।
৩. নির্দিষ্ট বয়সসীমা না থাকা :-
প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষায় পঠন - পাঠনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো বয়সসীমা থাকেনা। শিক্ষার্থীরা যেকোনো বয়সে পঠন পাঠনে অংশগ্রহণ করতে পারে। ফলে যেসকল শিক্ষার্থী কোনো কারণে নির্দিষ্ট বয়সে নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনি তাদের জন্য প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষা বিশেষভাবে কার্যকর।
৪. জীবনব্যাপী শিক্ষা :-
প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষা সারা জীবনের যেকোনো সময় গ্রহণ করা যেতে পারে ; তাই প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষা হল জীবনব্যাপী শিক্ষা। শিক্ষার্থী এখানে জীবনের যেকোনো বয়সে নিজের প্রয়োজনমত শিক্ষালাভ করতে পারে।
৫. শিক্ষকের ভূমিকা :-
প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষায় শিক্ষকের ভূমিকা নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মত নয়। শিক্ষক এক্ষেত্রে শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত থেকে শিক্ষা সঞ্চালন করেন না। প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষায় শিক্ষক নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ''স্টাডি মেটেরিয়াল '' ও বিভিন্ন মডিউল প্রস্তুত করেন। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই সেইসকল ''স্টাডি মেটেরিয়াল '' ও বিভিন্ন মডিউল থেকে শিক্ষালাভ করতে পারে।
৬. নির্দিষ্ট পাঠক্রম :-
প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষায় নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মতই নির্দিষ্ট পাঠক্রম থাকে। নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মতই এইসকল পাঠক্রম তৈরী হয় শিক্ষার্থীর বিভিন্ন চাহিদা ও বিকাশের কথা মাথায় রেখে।
৭. বিভিন্ন রূপ :-
প্রথা বহিৰ্ভূত শিক্ষার দুটি প্রধান রূপ হল - দূর শিক্ষা ও মুক্ত শিক্ষা। দূর শিক্ষায় শিক্ষার্থী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন স্টাডি মেটেরিয়াল সংগ্রহ করে পড়াশোনা করে। অন্যদিকে মুক্ত শিক্ষায় শিক্ষার্থীদেরকে সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে হয় এবং এক্ষেত্রেও স্টাডি মেটেরিয়ালের মাধ্যমেই পঠন - পাঠন পরিচালিত হয়।
৮. স্বয়ম শিখন :-
প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষায় শিক্ষার্থীকে স্বয়ম শিখনের নীতি গ্রহণ করতে হয়। প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষায় পঠন - পাঠনের ক্ষেত্রে শিক্ষকের সাহায্য পাওয়া যায়না ; শিক্ষার্থীকে নিজেকেই শিখতে হয়।
৯. আর্থিক বিষয় :-
প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষার সঙ্গে আর্থিক বিষয়টি জড়িত আছে। তবে , প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষার খরচ যথেষ্ট কম। প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষায় নিজস্ব বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করতে হয়না , প্রচুর পরিমানে পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজন হয়না , শিক্ষকদের বিপুল পরিমান বেতনের সমস্যা নেই ও অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রেও খরচ যথেষ্ট কম।
১০. পাঠ্যপুস্তক :-
প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষায় পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তে স্টাডি মেটেরিয়াল ও মডিউল নির্মাণ করা হয়। এগুলি যোগ্য শিক্ষকদের দ্বারা নির্মিত হয়। ফলে প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষার স্টাডি মেটেরিয়াল ও মডিউল গুলির গুণগত মান সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকেনা।
১১. বৈচিত্রময় পাঠক্রম :-
প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষায় বৈচিত্রময় পাঠক্রমের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এখানে শিক্ষার্থী বহুবিধ ও বহুমুখী পাঠক্রমের মধ্যে থেকে নিজের প্রয়োজন ও চাহিদামত পাঠক্রম বেছে নিতে পারে।
১২. প্রযুক্তির ব্যবহার :-
বর্তমানে প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে শিক্ষার্থীর নিকট পাঠ্য বিষয় সহজ ও প্রাঞ্জল হয়ে উঠেছে।
১৩. শিক্ষার সুযোগ :-
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় আসন সংখ্যা থাকে সীমিত। ফলে উচ্চশিক্ষায় বহু শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়না। কিন্তু প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষায় এই সমস্যাটি নেই। দূরশিক্ষা ও মুক্তশিক্ষায় যেকোনো সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারে।
১৪. সকলের জন্য শিক্ষা :-
এককথায় প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষা সকলের জন্য। প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষায় যেকোনো বয়সের , যেকোনো মেধার শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করতে পারে। বয়স , দূরত্ব , আর্থিক অবস্থা , পেশাগত দিক - ইত্যাদি কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।
১৫. মানব সম্পদ উন্নয়ন :-
প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষায় মানব সম্পদের উন্নতি ঘটে। নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার নিয়মের বেড়াজালে যেসকল শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় , তারা সহজেই প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে মানব সম্পদের উন্নতি ঘটায় এবং তাদের মধ্যে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়।