দূর শিক্ষা কাকে বলে ? দূর শিক্ষার বৈশিষ্টগুলি লেখ।
দূর শিক্ষা কাকে বলে ? দূর শিক্ষার বৈশিষ্টগুলি লেখ।
দূর শিক্ষার সংজ্ঞা / ধারণা :-
দূর শিক্ষা হল প্রথাবহিৰ্ভূত শিক্ষার একটি রূপ। দূর শিক্ষাকে মূলতঃ নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার বিকল্প হিসাবে পরিচালিত করা হয়। নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার কঠোরতা , শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান নির্ভরতা , মূল্যায়ন কেন্দ্রিকতা - ইত্যাদির বাইরে তুলনামূলক স্বাধীন পরিবেশে শিক্ষার্থী নিজ চাহিদা , সামর্থ্য , সময় অনুসারে শিক্ষার্থী যে ধরণের শিক্ষা গ্রহণ করে - তাকেই বলে দূর শিক্ষা।
দূর শিক্ষা নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মত সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রিত নয় আবার অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মত সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণবিহীন নয়। দূর শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল সকল স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের সুবিধামত সময় , চাহিদা - ইত্যাদি অনুসারের উচ্চ শিক্ষার প্রসার ঘটানো।
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার '' Quantity , quality and relevance '' - এর সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে তুলনামূলক সমস্যামুক্ত একটি বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থা হল দূর শিক্ষা।
দূর শিক্ষার বৈশিষ্ট :-
১. শিক্ষকের ভূমিকা :-
দূর শিক্ষায় শিক্ষকের ভূমিকা ন্যূনতম। দূর শিক্ষায় নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মত শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করেন না। দূর শিক্ষায় শিক্ষকের কাজ হল পাঠক্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত স্টাডি মেটেরিয়াল বা মডিউল প্রস্তুত করা।
২. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান :-
দূর শিক্ষায় নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মত কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা শ্রেণীকক্ষ থাকেনা। সাধারণতঃ নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিকেই সাময়িকভাবে দূর শিক্ষায় ব্যবহার করা হয়।
৩. পাঠক্রম :-
দূর শিক্ষার ক্ষেত্রেও নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মত নির্দিষ্ট পাঠক্রম থাকে। তবে নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার পাঠক্রমের সঙ্গে দূরশিক্ষার পাঠক্রমের কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। দূর শিক্ষার পাঠক্রম অনেক বেশি বৈচিত্রময় এবং শিক্ষার্থী নিজ চাহিদা অনুযায়ী যেকোনো ধরণের পাঠক্রম নির্বাচন করতে পারে।
৪. মূল্যায়ণ প্রক্রিয়া :-
দূর শিক্ষায় মূল্যায়ণ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার তুলনায় অনেক বেশি নমনীয়। শিক্ষার্থী নিজ সুবিধামত একটি পাঠক্রমের বিভিন্ন অংশের মূল্যায়নে অংশগ্রহণ করতে পারে।
৫. সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির অনুপস্থিতি :-
দূর শিক্ষা ব্যবস্থায় কোনোরূপ সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়না। ফলে নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিগুলির মাধ্যমে শিশুর যে বিভিন্ন ধরণের বিকাশ ঘটে ; দূর শিক্ষায় তা সম্ভব নয়।
৬. নির্দেশনা :-
দূর শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষক ন্যূনতম নির্দেশনা প্রদান করেন। শিক্ষার্থীদেরকে এই নির্দেশনা অনুসারে নিজেকেই পঠন পাঠন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে হয়।
৭. ফিডব্যাকের অভাব :-
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মত দূর শিক্ষায় শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফিডব্যাক পাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকেন। শিক্ষার্থীরা যেহেতু নিজেই পঠন - পাঠন করে - সেহেতু দূর শিক্ষায় সকল প্রকার ফিডব্যাক অনুপস্থিত।
৮. মিথস্ক্রিয়ার অভাব :-
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যে মিথস্ক্রিয়া ঘটে - তা দূর শিক্ষায় সম্ভব নয়। দূর শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের সাহায্য ছাড়াই জ্ঞানার্জন করে।
৯. শংসাপত্রের গ্রহণযোগ্যতা :-
দূর শিক্ষা ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মত পাঠক্রমের শেষে শংসাপত্র প্রদান করা হয় এবং এর মান কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার তুলনায় কম নয়। যেকোনো সরকারি চাকরি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে দূর শিক্ষার শংসাপত্র নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মতই গ্রহণযোগ্য।
১০. সমাজে গ্রহণযোগ্যতা :-
রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে সরকারি কাজকর্মের জন্য বা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক কাজকর্মের জন্য দূর শিক্ষার শংসাপত্র নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার সমতুল্য হিসাবে গ্রহণযোগ্য হলেও সামাজিক ক্ষেত্রে ও মানুষ ব্যক্তিগতভাবে দূর শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার তুলনায় নিম্নমানের বলে মনে করেন।
১১. প্রযুক্তির ব্যবহার :-
আধুনিক সময়কালে দূর শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির বহুল প্রচলন ঘটেছে। ফলে সব ধরণের শিক্ষার্থী এবং বিশেষ করে প্রান্তিক অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের সম্প্রচার , দূরদর্শন , ইন্টারনেট - ইত্যাদি দূর শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছে।
১২. শিক্ষার্থীর বয়স :-
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মত দূর শিক্ষা ক্ষেত্রে বয়সের কোনো বাধানিষেধ নেই। শিক্ষার্থী যেকোনো বয়সে যে পাঠক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে। তবে অবশ্যই ন্যূনতম বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন।
১৩. শিক্ষার্থীর সংখ্যা :-
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা সীমিত থাকে। কিন্তু দূর শিক্ষায় সে সমস্যা নেই। যেকোনো সংখ্যক শিক্ষার্থীরা দূর শিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে।
১৪. রাষ্ট্রের ভূমিকা :-
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মত বেশিরভাগ দূর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত হয়। দূর শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ , স্টাডি মেটেরিয়াল নির্মাণ , মূল্যায়ন , শিক্ষার পাঠক্রম - ইত্যাদি সবকিছুই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত হয়। অবশ্য দূর শিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগও সমানভাবে প্রচলিত আছে।
১৫. আর্থিক বিষয় :-
দূর শিক্ষা ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মত বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ , শিক্ষকের পারিশ্রমিক , পাঠ্যপুস্তক - ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিপুল খরচ হয়না। দূর শিক্ষার খরচ নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার তুলনায় স্বল্প।
১৬. বৃত্তিমূলক শিক্ষা :-
বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষার জন্য দূর শিক্ষা বিশেষভাবে কার্যকরী। শিক্ষার্থী নিজ পছন্দের বৃত্তি অনুসারে যেকোনো বৃত্তিমূলক পাঠক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে।
১৭. শিক্ষার্থী কেন্দ্রিকতা :-
দূর শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক। পাঠক্রম নির্বাচন , পঠন - পাঠন , মূল্যায়ন - ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থী সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনতা ভোগ করে। তাই দূর শিক্ষায় শিক্ষার্থী আত্মনির্ভর হওয়ার সুযোগলাভ করে।
১৮. নমনীয় ভর্তি প্রক্রিয়া :-
দূর শিক্ষায় ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার তুলনায় অনেক বেশি নমনীয়। নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাক্ষেত্রে ভর্তির সময় শিক্ষার্থীরা যে কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয় - দূর শিক্ষায় সে সমস্যা নেই।
১৯. আংশিক সময়য়ের শিক্ষা :-
দূর শিক্ষা হল আংশিক সময়ের শিক্ষা। শিক্ষার্থী নিজের পছন্দমত সময়ে পঠন - পাঠন করতে পারে , শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত থাকারও কোনো প্রশ্ন নেই। ফলে শিক্ষার্থী তার অন্যান্য কাজ বজায় রেখে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
২০. শিক্ষায় সমসুযোগ সৃষ্টি :-
অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ছুট শিক্ষার্থীরা নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়না ; বা , বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরাও উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রথাগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারেনা। কিন্তু দূর শিক্ষায় এই সকল শ্রেণীর মানুষেরা শিক্ষার সুযোগ পায় এবং শিক্ষায় সমসুযোগের সৃষ্টি হয়।
0 comments