­
নিয়ন্ত্রিত বা প্রথাগত শিক্ষার সীমাবদ্ধতা। - NANDAN DUTTA

নিয়ন্ত্রিত বা প্রথাগত শিক্ষার সীমাবদ্ধতা।

by - March 10, 2025

নিয়ন্ত্রিত বা প্রথাগত শিক্ষার সীমাবদ্ধতা। 

নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার ত্রুটি। 

নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার অসুবিধা।  




নিয়ন্ত্রিত বা প্রথাগত শিক্ষার সীমাবদ্ধতা :- 


আধুনিক সময়ে সারা বিশ্ব জুড়ে নিয়ন্ত্রিত বা প্রথাগত শিক্ষার উপযোগিতা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। শিশুর সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা শিশুকে সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানগুলির সঙ্গে পরিচয় ঘটায় , সু - অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করে , সামাজিকীকরণে ও অভিযোজনে সহায়তা করে। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা সমালোচনার উর্দ্ধে নয়। নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার বিভিন্ন সীমাবদ্ধতাগুলি আলোচনা করা হল। 

১. শিক্ষক নির্ভরশীলতা :- 
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা সম্পূর্ণরূপে শিক্ষকের উপর নির্ভরশীল। শিক্ষক প্রতিটি শিক্ষাস্তরে পাঠ্য বিষয়গুলি শিক্ষার্থীর সামনে উপস্থাপন করেন। এক্ষেত্রে শিক্ষকের নির্দেশিত পথে শিক্ষার্থীকে চলতে হয়। জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সেরূপ স্বাধীনতা থাকেনা। 

২. আরোপিত পাঠক্রম :-
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় পাঠক্রম সম্পূর্ণরূপে আরোপিত। এখানে শিক্ষার্থীর ইচ্ছা - অনিচ্ছার কোনো স্থান নেই। শিক্ষার্থী নিজের পছন্দমত পাঠক্রম নির্বাচন করতে পারে ঠিকই ; কিন্তু তা কেবলমাত্র উচ্চ - শিক্ষার স্তরে। নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় পূর্বনির্দিষ্ট পাঠক্রমে অংশগ্রহণ করতে শিক্ষার্থীরা বাধ্য থাকে। 

৩. বিদ্যালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ :- 
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা বিদ্যালয়ের চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বৃহত্তর সমাজ ও আন্তর্জাতিক জীবনের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে কেবলমাত্র পাঠক্রম ও পাঠ্য পুস্তকের মাধ্যমে। এই ধরণের ব্যবস্থা শিক্ষার্থীর স্বাধীনভাবে জ্ঞানার্জনের পথে বাধা সৃষ্টি করে। 


৪. পরীক্ষাকেন্দ্রিক :- 
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় শিক্ষার্থীর যোগ্যতা ও মান যাঁচাই হয় কেবলমাত্র পরীক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষার্থীর মধ্যে যে বহুবিধ প্রতিভা লুকিয়ে থাকে তার যথাযথ মূল্যায়ন পরীক্ষার মাধ্যমে করা সম্ভব নয়। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল না করতে পারলে তাকে আদর্শ শিক্ষার্থী হিসাবে গণ্য করা হয়না। 

৫. আর্থিক বিষয় :- 
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা পরিচালনায় অর্থনৈতিক দিকটি একটি অন্যতম সমস্যা। বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ ও পরিচালনা , পরিকাঠামো উন্নয়ন , যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও পারিশ্রমিক প্রদান , মূল্যায়ন ও শিক্ষা নির্দেশনা পরিচালনা - ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিপুল অর্থ প্রয়োজন হয়। 

৬. বৃত্তি শিক্ষার অভাব :- 
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মূল লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন বিকাশ। শিক্ষার্থীর বৃত্তিমূলক বিকাশ নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার একটি অন্যতম লক্ষ্য হলেও - যে পরিমান বৃত্তি শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয় তা বৃত্তি জগতে সাফল্যলাভের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই পর্যাপ্ত নয়। 

৭. বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন :- 
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার বিরুদ্ধে একটি অন্যতম প্রধান অভিযোগ হল যে , নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা বাস্তব জীবনের সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন। শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যে ধরণের শিক্ষা গ্রহণ করে কর্মক্ষেত্রে ও উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে তা শিক্ষার্থীর সহায়ক হয়ে উঠতে পারেনা। 

৮. বৈচিত্রবিহীন :- 
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় সহপাঠক্রমের ব্যবস্থা থাকলেও কর্যক্ষেত্রে পাঠক্রমকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে শিক্ষামূলক ক্ষেত্রে সহপাঠক্রমের সেরূপ ভূমিকা থাকেনা। অন্যদিকে গতানুগতিক ও বৈচিত্রহীন পাঠক্রম শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ের প্রতি নিরুৎসাহিত করে তোলে। 

৯. শিক্ষার্থীর মেধাগত সমস্যা :- 
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় একটি শ্রেণীকক্ষে বিভিন্ন মেধার বহু শিক্ষার্থী থাকে। ফলে পাঠ্য বিষয় , শিক্ষণ নির্দেশনা - ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে সকল শিক্ষার্থী একই সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনা। কেউ এগিয়ে যায় , আবার কেউবা পিছিয়ে থাকে। 


১০. পরীক্ষণ পদ্ধতি মনোবিজ্ঞানসম্মত নয় :- 
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার বহুক্ষেত্রেই পরীক্ষা পদ্ধতি মনোবিজ্ঞানসম্মত হয়না। পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত জ্ঞানকে যাঁচাই করা। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার পরীক্ষা পদ্ধতি আজ তথ্য উপস্থাপনের একটি প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। 

১১. সামঞ্জস্যের সমস্যা :- 
শিক্ষার্থী শুধুমাত্র পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলিকে পাঠ্য পুস্তকের মাধ্যমে আয়ত্ত্ব করতে পারে। কিন্তু সেই বিষয়ে সাম্প্রতিক চিন্তাভাবনা , গবেষণা , বিষয়ের সাম্প্রতিক গতি - প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে অবগত হতে পারেনা। 

১২. কৃত্রিম পরিবেশ :- 
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা পরিচালিত হয় কৃত্রিম পরিবেশে। এখানে শিক্ষর্থীকে কৃত্রিমভাবে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে হয় এবং পঠন পাঠনে অংশগ্রহণ করতে হয়। ফলে বহু শিক্ষার্থী শিক্ষা প্রক্রিয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনা এবং ধীরে ধীরে তারা শিক্ষার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে। 

১৩. সংকীর্ণতা :- 
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা প্রকৃতিগতভাবে সংকীর্ণ। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের চার দেওয়ালের মধ্যে শুধুমাত্র শিক্ষক ও পাঠক্রমের উপর নির্ভর করে জ্ঞানার্জন করে। নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় অভিজ্ঞতা , জ্ঞানের বাস্তবিক প্রয়োগ ইত্যাদির পরিবর্তে পুঁথিগত বিদ্যাকে অত্যধিক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। 

১৪. কঠোরতা :- 
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার প্রতিটি উপাদান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। শৃঙ্খলাভঙ্গের কোনো অবকাশ এখানে নেই। বিদ্যালয়ে উপস্থিতি , মূল্যায়ন , পঠন পাঠনে অংশগ্রহণ - ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই কঠোরতা লক্ষ্য করা যায়। ফলে অনেক সময় এই যান্ত্রিক কঠোর পরিবেশে শিক্ষার্থীরা হাঁফিয়ে পড়ে। 

১৫. পরিবহণের সমস্যা :- 
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র অর্থাৎ বিদ্যালয়গুলি যদি শিক্ষার্থীর বাসস্থান থেকে বহুদূরে থাকে তাহলে বিদ্যালয়ে যাতায়াতের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সমস্যায় পড়তে হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের এই সমস্যা আরো বহুগুন বেড়ে যায়। 

পরিশেষে বলা যায় , নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার বহুবিধ সমস্যা থাকলেও এর বিকল্প কোনো ব্যবস্থার উদ্ভাবন করা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। কাজেই উপরোক্ত সমস্যাগুলির প্রতি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা অনেকটাই ত্রুটিমুক্ত হয়ে উঠতে পারে। 

You May Also Like

0 comments