সামাজিক পরিবর্তনে প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিক উপাদানগুলি আলোচনা কর।

by - July 27, 2022

সামাজিক পরিবর্তনে প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিক উপাদানগুলি আলোচনা কর। 

সামাজিক পরিবর্তনে প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিক উপাদানগুলির প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা কর। 

সামাজিক পরিবর্তনে প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিক উপাদান। 




সামাজিক পরিবর্তনে প্রযুক্তিগত উপাদান :- 

সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উপাদানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সমাজতাত্ত্বিক অধ্যাপক কিংসলে ডেভিস ( K. Devis ) বলেছেন , বিজ্ঞান বলতে মানুষের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের অংশবিশেষকে বোঝায়। এর দ্বারা প্রকৃতি সম্পর্কে সুসংবদ্ধ জ্ঞানের বিকাশ ঘটে এবং প্রযুক্তি হল এই বিকশিত জ্ঞানের প্রায়োগিক দিক। সমাজতত্ত্বে প্রযুক্তিবিদ্যার ধারণাকে ব্যাপক অর্থে গৃহীত হয়েছে। এখানে সমাজ জীবনে প্রযুক্তিবিদ্যার প্রত্যাশিত সাফল্যের সাথে সহায়ক ও পরিবর্তিত মানসিক গঠন বিন্যাস ও সামাজিক কাঠামোর উপর আলোকপাত করা হয়েছে। সমাজতাত্ত্বিক ফস্টার বলেন , প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতি বলতে  কেবলমাত্র পার্থিব ও প্রযুক্তিমূলক উন্নয়নকে বোঝায় না - এ হলো এক বিশেষ ধরনের সামাজিক , সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি। অগবার্ন বলেছেন - প্রযুক্তিবিদ্যা সমাজের পরিবেশগত পরিবর্তনের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তনে সক্ষম হচ্ছে এবং আমরা এই পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে শিখছি।  


প্রযুক্তিবিদ্যার ফলে সামাজিক পরিবর্তন কিভাবে ঘটে সে সম্পর্কে বিধিবদ্ধ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে - 
(ক ) প্রযুক্তিবিদ্যার প্রভাবে উৎপাদন ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। উৎপাদনের গুণগত এবং পরিমাণগত মানেরও  শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। 
(খ ) শিল্পক্ষেত্রের পাশাপাশি কৃষিজ উৎপাদনও প্রযুক্তিবিদ্যার প্রভাবে প্রভাবিত হয়। যে দেশে কৃষি এবং শিল্পের সমান্তরাল অগ্রগতি ঘটে সে দেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রেও যে পরিবর্তন ঘটবে - সে কথা নিশ্চিত। 
(গ ) প্রযুক্তিবিদ্যার প্রভাবে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সহজলভ্য হয়। প্রাত্যহিক জীবনে নানাবিধ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে মানুষের কায়িক শ্রম হ্রাস পায় , সুখ- স্বাচ্ছন্দ বৃদ্ধি পায়। 
(ঘ ) বহুমুখী উৎপাদন ব্যবস্থার বৃদ্ধি ঘটলে মানুষ তাতে জড়িয়ে পড়ে এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে লাভবান হয়। 
(ঙ ) প্রযুক্তি বিদ্যার প্রসার নারী পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যেও পরিবর্তন আনে।  সাম্প্রতিক কালে নারী শিক্ষার প্রসার , নারীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতা প্রদান ইত্যাদির পাশাপাশি বৈবাহিক সম্পর্কেও নানাবিধ শিক্ষার প্রসার ও পরিবর্তন ঘটেছে। 
(চ ) প্রযুক্তিবিদ্যার প্রসার মানুষের মানসিকতার মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। এর দ্বারা মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠেছে এবং পেশাভিত্তিক মানসিকতা গড়ে তুলেছে। 
(ছ ) প্রযুক্তিবিদ্যা সামাজিক কাঠামোরও পরিবর্তন ঘটায় এবং এর ফলে সমাজজীবন প্রায় কুসংস্কারমুক্ত হয়ে উঠেছে।  শ্রেণি কাঠামোতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে।
( জ )  প্রযুক্তিবিদ্যার প্রভাব রাষ্ট্রের কার্যাবলীকেও  প্রভাবিত করছে। এর দ্বারা রাষ্ট্রের কার্যাবলী শুধু পরিবর্তন হয়েছে তা নয় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
(ঝ ) প্রযুক্তিবিদ্যার প্রভাব পারিবারিক জীবনকেও প্রভাবিত করেছে। যৌথ পরিবারগুলির অবসান ঘটে একক পরিবারে পরিণত হচ্ছে। পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানগুলিতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। 
(ঞ ) প্রযুক্তিবিদ্যার ফলে সমাজে নারীদের ভূমিকার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। নারীদের মধ্যে স্বাধীনচেতা মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারীরা অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। 
(ট ) প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে একদিকে যেমন বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান সম্মত মানসিকতার বিকাশ ঘটছে অন্যদিকে তেমন ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারগুলি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাচ্ছে।  


সামাজিক পরিবর্তনে সাংস্কৃতিক উপাদান :- 

মানব সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে সংস্কৃতি মানুষেরই তাত্ত্বিক সৃষ্টি। মানব সমাজের সামগ্রিক পরিচিতির ধারক হল সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতিকে সামাজিক পরিবর্তনের অপর একটি অন্যতম অন্তর্নিহিত উপাদান বলে মনে করা হয়। প্রকৃতঅর্থে সংস্কৃতি স্থিতিশীল বিষয় নয় ,  তবে এটির পরিবর্তন ধীরগতিসম্পন্ন। মানুষের চিন্তা , চেতনা , ন্যায়-নীতি বোধ , আদর্শ  মূল্যবোধের মধ্যে দিয়ে সংস্কৃতি বাস্তবায়িত হয়। এগুলির পরিবর্তন ঘটলে সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন ঘটে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার প্রভাবে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ধারা দ্রুততর হয়।  আবার সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রভাবে প্রযুক্তিবিদ্যার পরিবর্তনেও প্রভাব পড়ে। 
(ক ) সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ফলে সমাজে সার্বজনীন , বহুমুখী ও বিচিত্রধর্মী পরিবর্তন সাধিত হয়। 
(খ ) সামাজিক পরিকাঠামোগত ক্ষেত্রে সংস্কৃতি ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে। যেমন যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারে পরিণত হওয়ার প্রবণতা দেখা দিলে তা একই সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন অংশের পরিবর্তন ঘটায় এবং সমাজের মৌলিক কাঠামোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসে।  
(গ ) সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ফলে মানুষের চিন্তাজগৎ , নীতি , মূল্যবোধ , আদর্শ - ইত্যাদি সবক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটে। এই ধরণের মানসিক পরিবর্তনের ফলে সামগ্রিকভাবে সমাজের পরিবর্তনের সূচনা ঘটে।
(ঘ ) সাংস্কৃতিক পরিবর্তন মানুষের জীবনধারা , রুচি ও অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটায়। এর ফলে মানুষের জীবন গতিশীলতার দিকে ধাবিত হয় এবং সামাজিক বিবর্তন সাধিত হয়। 
(ঙ ) সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সর্বদা পরিবর্তনশীল। তবে সমাজের অন্যান্য উপাদানের পরিবর্তনের তুলনায় সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ধীরগতিসম্পন্ন হয়। 
(চ ) প্রযুক্তিবিদ্যা সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। প্রযুক্তিবিদ্যার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিকাশ দ্রুততর হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন সমাজে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। এক্ষেত্রে ইন্টারনেটের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। 
(ছ ) সাংস্কৃতিক পরিবর্তন মানুষের ধর্মীয় জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে। সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় আচার - অনুষ্ঠান , রীতিনীতি - ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় স্বাধীনতার পরবর্তী সময়কালে ভারতে ব্যাপক সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ফলে ধর্মীয় গোঁড়ামি , রীতিনীতি , প্রথা , জাতপাত - ইত্যাদির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। 
(জ ) সাংস্কৃতিক পরিবর্তন মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনেও পরিবর্তন নিয়ে আসে। নাচ - গান , চিত্রকলা , সাহিত্য ও বিজ্ঞানচর্চা , নাটক , চলচ্চিত্র - ইত্যাদি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদানের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। 
(ঝ ) সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ব্যক্তিজীবনেও পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। আধুনিক সংস্কৃতির দাবী মেনে মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে দ্রুতগতি সম্পন্ন। ক্রমশঃ তারা পাশ্চাত্যের অনুগামী হয়ে উঠছে। 

পরিশেষে বলা যায় , প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিক উপাদান পরস্পর নিরপেক্ষ নয়। প্রযুক্তি যেমন সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে সহায়তা করে ও তাকে দ্রুতগামী করে তোলে ; ঠিক তেমনভাবেই সংস্কৃতিও প্রযুক্তির উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। সাংস্কৃতিক জগতে পরিবর্তনের তাগিদেই প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন প্রেষণা লাভ করে।   

 

You May Also Like

0 comments