প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানি কতটা দায়ী ছিল সে বিষয়ে আলোচনা কর।

by - January 07, 2022

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানির দায়িত্ব আলোচনা কর। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানি কতটা দায়ী ছিল সে বিষয়ে আলোচনা কর। 

Discuss how much Germany was responsible for the First World War.


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানির দায়িত্ব :- 


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ দুটি প্রধান শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একদিকে ছিল জার্মানি , অস্ট্রিয়া ও ইতালির ত্রিশক্তি চুক্তি ও অন্যদিকে ছিল ইংল্যান্ড , ফ্রান্স ও রাশিয়ার ত্রিশক্তি মৈত্রী। এই দুই পরস্পর বিরোধী জোটের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ। কিন্তু তাদের মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানির ভূমিকাকে তীব্র সমালোচনা করেছেন ঐতিহাসিক ফিশার , লর্ড অক্সফোর্ড - প্রমুখ। আবার এর বিপরীত মতও দেখা যায় যাঁরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানিকে দায়ী করেন না। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন - ঐতিহাসিক বার্নেস , গুচ , জেচলিন - প্রমুখ। 


১. ওয়েল্ট পলিটিক নীতি গ্রহণ :- কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম ওয়েল্ট পলিটিক নীতি গ্রহণ করলে তা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কাইজারের নীতি ছিল " Either whole or nothing '' - এই চরম প্রতিক্রিয়াশীল নীতি গ্রহণের ফলে ইউরোপের বৃহৎ শক্তিগুলি জার্মানির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে পড়ে ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি প্রস্তুত করে। 

২. বিসমার্ক অনুসৃত Satiation নীতির পরিত্যাগ :- ইতিপূর্বে বিসমার্ক আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে Satiation বা আত্মতৃপ্তির নীতি গ্রহণ করেছিলেন। বিসমার্কের নীতি ছিল অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির সাথে যোগ দিয়ে ঔপনিবেশিক নীতি গ্রহণ করা। কিন্তু কাইজার উইলিয়াম এই নীতি পরিত্যাগ করে চরম প্রতিক্রিয়াশীল নীতি গ্রহণ করলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যায়। 


৩. কাইজার কর্তৃক অস্ট্রিয়া তোষণ :- কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম রাশিয়ার সঙ্গে স্বাক্ষরিত রি - ইন্স্যুরেন্সের চুক্তিকে গুরুত্ব না দিয়ে অস্ট্রিয়া তোষণ নীতি গ্রহণ করলে তা জারের নিকট বিরক্তির কারণ হয়। উপরন্তু কাইজার বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে রাশিয়ার ওপর কঠোর শর্ত আরোপ করলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে ওঠে। অন্যদিকে , বলকান অঞ্চলে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গ্রহণ রাশিয়ার পক্ষে অনিবার্য ছিল। এই অবস্থায় জার মনে করেছিলেন , জাৰ্মানির আসল উদ্দেশ্য ছিল ফ্রাঙ্কো - রুশ মৈত্রী জোট ভেঙে ফেলা।     

৪. ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব :- ওয়েল্ট পলিটিক নীতি গ্রহণের পর থেকেই জার্মানি তীব্র ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব পোষণ করতে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নৌ - শক্তিতে ব্রিটেনের থেকে এগিয়ে থাকার প্রয়াস। জার্মানি নৌ - শক্তি বৃদ্ধি করলে তা ব্রিটেনের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে মনে করা হয়। ফলে ব্রিটেন বাধ্য হয়ে জোট গঠন করে। 

৫. স্লিফেন পরিকল্পনা :- পরস্পর বিরোধী শক্তিজোট গঠনের বহু পূর্বেই জার্মান সেনাপতি স্লিফেন একটি পরিকল্পনা তৈরী করেন। এই পরিকল্পনা অনুসারে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ফ্রান্সের ওপর আক্রমণ ও রাশিয়াকে নিরস্ত্র রাখার কথা বলা হয়। কাইজার উইলিয়াম শেষ পর্যন্ত ১৯১৪ সালে এই নীতি প্রয়োগ করেন। এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে মিত্রশক্তি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য ছিল। 

৬. প্যান - জার্মানিজম :- আত্মগর্বে গর্বিত জার্মানি সর্বদা সারা বিশ্বের উপর নিজ আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা করেছিল। তারা জার্মান টিউটনিক জাতিকে শ্রেষ্ঠ জাতি বলে মনে করত। এই শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত করতে তারা সমগ্র বিশ্বের ওপর প্রভুত্ব বিস্তার করার তাগিদে চরম প্রতিক্রিয়াশীল নীতি গ্রহণ করে। কাইজারের এই নীতিই মিত্রশক্তিকে যুদ্ধের জন্য বাধ্য করে। 

৭. কাইজারের ঔপনিবেশিক নীতি :- কাইজারের আগ্রাসী ঔপনিবেশিক নীতি ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করে। পরস্পর বিরোধী শক্তিজোট গঠিত হলেও ব্রিটেন যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিল। কিন্তু কাইজার ইংল্যান্ড কর্তৃক প্রস্তাবিত '' ইঙ্গ - জার্মান মৈত্রী প্রস্তাব '' অগ্রাহ্য করেন। বুয়রদের সমর্থন , মরক্কো সংকটে মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান , বার্লিন - বাগদাদ রেলপথ পরিকল্পনা , আগ্রাসী সামরিক ও নৌ - শক্তি বৃদ্ধি - এসবের মাধ্যমে কাইজার এককভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে আহ্বান করেছিলেন। 

তবে , প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানি যে এককভাবে দায়ী নয় - এবিষয়েও ঐতিহাসিকগণ বেশ কিছু যুক্তির অবতারণা করেছেন। যেমন - 

প্রথমতঃ বলকান অঞ্চলের রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য জার্মানিকে কোনোভাবেই দায়ী করা যায় না। কেননা , এক্ষেত্রে অস্ট্রিয়া এককভাবে সার্বিয়ার উপর দায় চাপিয়ে দিয়ে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরী করে। 

দ্বিতীয়তঃ আধুনিক ঐতিহাসিকগণ মনে করেন , প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য ইউরোপের সবগুলি রাষ্ট্রই কম - বেশি দায়ী। শক্তিজোট গঠন , অস্ত্রভান্ডার মজুত করা , পারস্পরিক প্রতিক্রিয়াশীল নীতি গ্রহণ করা - ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইউরোপের সবগুলি রাষ্ট্রই সমানভাবে দোষী ছিল। 

তৃতীয়তঃ অস্ট্রিয়া কোনোভাবেই জার্মানির নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল না। তাই বলকান সংকট ও সার্বিয়ার প্রশ্নে জার্মানিকে কোনোভাবেই দায়ী করা যায়না। 

চতুর্থতঃ জার্মানি নৌ শক্তি বৃদ্ধি করলে ব্রিটেনেও নিজের সুরক্ষার তাগিদে জার্মানিকে যেকোনো মূল্যে ধ্বংস করতে তৎপর ছিল। 


পঞ্চমতঃ জার্মান ঐতিহাসিক Wolfgang Haig মনে করেন - ব্রিটেন , ফ্রান্স , রাশিয়া - ইত্যাদি ইউরোপীয় শক্তিগুলি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের কায়েমী স্বার্থকে চরিতার্থ করতে বদ্ধপরিকর ছিল। তাই এক্ষেত্রে জার্মানিকে এককভাবে দায়ী করা যুক্তিযুক্ত নয়। 

ষষ্ঠতঃ মার্কিন ঐতিহাসিক জন ফে তাঁর '' Origins of the First World War '' গ্রন্থে বলেছেন , ইংল্যান্ড কর্তৃক মিত্রশক্তি জোট গঠিত হলে জার্মানি বিপন্ন হয়। এই সময় মিত্রশক্তি অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় না মেতে উঠে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে পারত। কিন্তু মিত্রশক্তি তা করেনি। 

পরিশেষে বলা যায় যে , প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানি এককভাবে দায়ী ছিল না। ইউরোপীয় শক্তিবর্গের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা , অস্ত্রের প্রতিযোগিতা , ঔপনিবেশিক কায়েমী স্বার্থ , উগ্র জাতীয়তাবাদী চরিত্র - এইসকল বিষয়গুলি এক অভূতপূর্ব পরিবেশ রচনা করে যার ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।     


You May Also Like

0 comments