প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণগুলি আলোচনা কর।

by - January 06, 2022

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণগুলি আলোচনা কর। 

Causes of First World War ( In Bengali ) 



প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ :- 


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে বিগত কয়েক দশক ধরে বিশেষতঃ ১৮৭১ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত সময়কালে বিশ্ব রাজনীতিতে আপাত শান্তি বজায় থাকলেও একাধিক ঘটনা বিশ্ব যুদ্ধের পট - প্রস্তুত করে। সেজন্য এই সময়কালকে '' সশস্ত্র শান্তির যুগ '' বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য একাধিক কারণ - যেমন বিভিন্ন চুক্তি , বিভিন্ন জোট গঠন , প্রতিক্রিয়াশীল নীতি - ইত্যাদি সংঘর্ষকে অনিবার্য করে তোলে। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের প্রাক্কালে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাও এর জন্য দায়ী। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের বিভিন্ন কারণগুলি হল - 


১. উগ্র জাতীয়তাবাদ :- বিভিন্ন কারণে উনিশ শতকের শেষ দিকে ও বিংশ শতকের শুরুর দিকে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে দাবী করতে থাকে এবং সেই দাবী প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল নীতি গ্রহণ করে। ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশ , এমনকি রাশিয়া , জাপান - ইত্যাদি দেশের মধ্যেও এই উগ্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ লক্ষ্য করা যায়। এইভাবে পরস্পরের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ এবং জাতিগত বৈরিতা বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি রচনা করে। 

২. অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ :- ফরাসি বিপ্লবের ফলে তিনটি নতুন আদর্শের জন্ম হয় - সাম্য , মৈত্রী ও স্বাধীনতা। এই নতুন আদর্শের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি জাতির মধ্যে জাতীয়তাবোধের প্রসার ঘটে। কিন্তু ভিয়েনা সম্মেলন এই নতুন আদর্শের প্রসারের পথে অন্তরায় হয়ে ওঠে। ফলে বিভিন্ন জাতির জাতীয়তাবোধ ও স্বাধীনতার স্পৃহা অতৃপ্ত থেকে যায়। এই অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে। 


৩. পরস্পর - বিরোধী শক্তিজোট :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে গড়ে ওঠা পরস্পর বিরোধী শক্তিজোট ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ। প্রধানতঃ দুটি পরস্পর বিরোধী শিবিরের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর শক্তিগুলি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। 
(ক) একটি জোট ছিল ত্রিশক্তি চুক্তি জোট। জার্মানির প্রধানমন্ত্রী বিসমার্কের উদ্যোগে জার্মানি , অস্ট্রিয়া ও ইতালির মধ্যে এই জোট গঠিত হয়। এই জোটের মূল উদ্দেশ্য ছিল ফ্রান্সকে অবদমিত রাখা। 
(খ) দ্বিতীয় জোট ছিল ত্রিশক্তি আঁতাঁত। ইংল্যান্ড , ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে ত্রিশক্তি আঁতাঁত গঠিত হয়। এই জোট তৈরী হয় ত্রিশক্তি চুক্তির বিরোধী হিসেবে। 
এই দুই পরস্পর শক্তিজোট প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে। 

৪. বলকান জাতীয়তাবাদ :- পূর্ব ইউরোপের বলকান অঞ্চলে অটোমান তুর্কিদের শাসনকালে বলকান অঞ্চলের বিভিন্ন জাতি স্বাধীনতার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। বার্লিন চুক্তিতে বসনিয়া প্রদেশটি জোর করে অস্ট্রিয়ার সাথে যুক্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু সার্ব জাতিভুক্ত বসনিয়া সার্বিয়ার সাথে যুক্ত হতে চেয়েছিল। এর প্রতিবাদে বসনিয়াতে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে তীব্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। 

৫. সামরিক প্রতিযোগিতা :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশ যেন অস্ত্রের কারখানাতে পরিণত হয়েছিল। প্রতিটি দেশে সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। জাতীয় আয়ের সিংহভাগ অর্থ যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণের কাজে ব্যয় করা হয়। প্রতিটি দেশ অধিক সংখ্যায় মারণাস্ত্র নির্মাণে প্রবৃত্ত হলে তা এক ভীতির পরিবেশের জন্ম দেয়। এই ভীতি ইউরোপীয় শক্তিগুলিকে আরো বেশি করে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত করায়। 

৬. অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা :- বিংশ শতকের একেবারে শুরুতেই ব্রিটেন উপলব্ধি করে শিল্প ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে জার্মানি ব্রিটেনের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। ফলে ব্রিটেন ও জার্মানির মধ্যে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা তীব্র হয়। জার্মানির নৌ শক্তি তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেলে উত্তর সাগর ও ইংলিশ চ্যানেলে ব্রিটেনের স্বার্থ বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। ফলে উভয় দেশের মধ্যে বিরোধ চরমে ওঠে। 


৭. জার্মান সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা :- উনিশ শতকের শেষে ও বিংশ শতকের শুরুর দিকে জার্মানি উপলব্ধি করে যে বিশ্বের সকল গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশগুলির ওপর ফ্রান্স ও ব্রিটেনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। ফলে জার্মানি ওয়েল্ট পলিটিক নীতি গ্রহণ করে সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ঘটাতে চাইলে ফ্রান্স ও ব্রিটেন জার্মানিকে প্রতিরোধ করতে বদ্ধপরিকর হয়ে পড়ে এবং পরস্পর বিরোধী রাষ্ট্রজোট গঠনের সূচনা ঘটে। 

৮. বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক সংঘাত :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বহু পূর্ব থেকেই ইউরোপীয় শক্তিগুলির মধ্যে বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক সংঘাত শুরু হয়েছিল। এই সংঘাতের মূলে ছিল বাজার দখল , বাণিজ্যের বিস্তার ও ঔপনিবেশিক আধিপত্য বিস্তার। এমনকি শিল্পোন্নত দেশগুলি সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহের জন্যও ঔপনিবেশিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে ইংল্যান্ড , ফ্রান্স , রাশিয়ার সাথে জার্মানি ও ইতালির সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। 

৯. কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামের ভূমিকা :- সমগ্র ইউরোপ যে অস্ত্রের কারখানায় পরিণত হয়েছিল - তার রূপকার ছিলেন কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম। প্রায় ৫৬ মিলিয়ন জার্মান জনসংখ্যাকে দ্বিতীয় উইলিয়াম দক্ষতার সাথে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে কাজে লাগিয়েছিলেন। অস্ট্রিয়ার সাথে মিত্রতার ফলে জার্মান সামরিক শক্তির অভাবনীয় বৃদ্ধি ঘটেছিল। অন্যদিকে নৌ বাহিনীকেও পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী করে তিনি ইউরোপে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরী করেছিলেন। এছাড়াও তিনি শান্তির জন্য ব্রিটেনের নিরস্ত্রীকরণ প্রস্তাব বারবার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। 

১০. গুজব ও সংবাদপত্রের ভূমিকা :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে কিছু গুজব ও সংবাদপত্র কর্তৃক পরিবেশিত সংবাদ যুদ্ধের জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী। বিভিন্ন মিথ্যা , বিকৃত ও উস্কানিমূলক সংবাদ ইউরোপে পারস্পরিক অসহিষ্ণুতার পরিবেশ রচনা করেছিল। সেরাজেভো হত্যাকান্ডের পর এই ধরণের সংবাদগুলি পরিস্থিতি যুদ্ধের জন্য অনুকূল করে তোলে। 

প্রত্যক্ষ কারণ : সেরাজেভো হত্যাকান্ড :-

অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফার্দিনান্দ ও তাঁর স্ত্রী সোফিয়া বসনিয়া সফরে এলে সেরাজেভো শহরে এক এক বসনিয়ার এক বিপ্লবী ছাত্র কর্তৃক নিহত হন  ২৮ শে জুন ১৯১৪ তারিখে। এই ঘটনার জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে অস্ট্রিয়া এক চরমপত্র পাঠায়। কিন্তু সার্বিয়া নিজের সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হবে এমন কিছু দাবী মানতে অস্বীকার করে এবং আলোচনার প্রস্তাব পেশ করে। কিন্তু ইতিমধ্যেই অস্ট্রিয়া ২৮ শে জুলাই সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড আক্রমণ করে। এই আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন শক্তিগুলি পরস্পর মিত্র শিবিরে অংশগ্রহণ করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ফলে শুরু হয় বিশ্বযুদ্ধ।


  

You May Also Like

0 comments