নেপোলিয়নের পতনের কারণগুলি আলোচনা কর।

by - January 04, 2022

নেপোলিয়নের পতনের কারণগুলি আলোচনা কর। 

Discuss the reasons for Napoleon's fall ( In Bengali ) 



নেপোলিয়নের পতনের কারণ :- 


সামান্য একজন সৈনিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে মাত্র কিছু সময়ের মধ্যেই সমগ্র ইউরোপের ভাগ্যবিধাতায় পরিণত হয়েছিলেন নেপোলিয়ন। কিন্তু ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ওয়াটারলু - র যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তার রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটে। কিন্তু ওয়াটারলু - র যুদ্ধের বহু পূর্ব থেকেই বিভিন্ন ঘটনা নেপোলিয়নের পতনের সূচনা ঘটিয়েছিল। নেপোলিয়নের শাসননীতি ও রাষ্ট্রীয় সংগঠনের মধ্যেই তাঁর পতনের বীজ লুকিয়ে ছিল। নেপোলিয়নের পতনের কারণগুলোকে বিভিন্নভাবে আলোচনা করা যায়। 


১. সীমাহীন উচ্চাকাঙ্খা ও আত্মবিশ্বাস :- নেপোলিয়ন সমগ্র ইউরোপে ফ্রান্স তথা নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। গ্রীক বীর আলেকজান্ডার ও রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের দিগ্বিজয় নীতি তাঁকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। ফ্রান্সের সর্ব্বাধিনায়করূপে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিলেও তাঁর সাম্রাজ্যবাদী নীতি তাঁর পতনের পথ উন্মুক্ত করে। ফ্রান্সের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে সমগ্র ইউরোপে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব ছিল না - একথা তিনি অনুধাবন করতে পারেননি। 

২. স্বৈরতান্ত্রিক শাসন :- ১৭৯৯ থেকে ১৮১৪ সালের মধ্যে নেপোলিয়নের ভূমিকার ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। ১৭৯৯ তে নেপোলিয়ন ছিলেন বিপ্লবের রক্ষাকর্তা , সংস্কার ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার অন্যতম কান্ডারি। কিন্তু ১৮১৪ সালে নেপোলিয়ন হয়ে উঠেছিলেন ইউরোপের ঘৃণার পাত্র। এজন্য দায়ী ছিল নেপোলিয়নের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি। ডেভিড থমসন নেপোলিয়নের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ''পুলিশ রাষ্ট্র ''- র সাথে তুলনা করেছেন। জনকল্যাণকর শাসন প্রবর্তনের মধ্যে দিয়ে নেপোলিয়ন ইউরোপের সর্বাধিক জনপ্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু পরের দিকে তাঁর স্বৈরশাসন ও বলপ্রয়োগের নীতি তাঁর জনপ্রিয়তাকে ধূলিস্যাৎ করে দেয়। 


৩. সামরিক ব্যর্থতা :- উন্নত সামরিক শক্তি ও রণকৌশল দ্বারা নেপোলিয়ন ইউরোপের একের পর এক রাষ্ট্রে আধিপত্য বিস্তার করতে সফল হয়েছিলেন। একমাত্র ইংল্যান্ড ছাড়া অন্য কোনো ইউরোপীয় রাষ্ট্রই নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। কিন্তু নেপোলিয়নের রণকৌশল অন্যান্য শক্তিবর্গগুলিও যখন আয়ত্ত করতে শুরু করলো , ঠিক তখন থেকে নেপোলিয়ন বিরোধী শক্তিবর্গ ঐক্যবদ্ধ হয় ও নেপোলিয়নের পতনকে সুনিশ্চিত করে। 

৪. পেনিনসুলার এবং রুশ যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিক্রিয়া :- এরপর নেপোলিয়ন পেনিনসুলার ও রুশ যুদ্ধে পরাজিত হলে তাঁর অজেয় ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়। ইউরোপ তথা ফ্রান্সে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। নেপোলিয়নের বহু কর্মচারীও এই বিক্ষোভে সামিল ছিলেন। এমনকি নিজ ভ্রাতা জোসেফ বোনাপার্টও নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে চক্রান্তে সামিল হন। এইভাবে ফ্রান্সের মধ্যেই নেপোলিয়ন বিরোধী একটি চক্রান্ত তৈরী হয়। 

৫. ফ্রাঙ্কফুর্ট প্রস্তাব :- নেপোলিয়নের রাজনৈতিক জীবনের একটি মারাত্মক ভুল হল ফ্রাঙ্কফুর্ট প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা। লাইপজিগের যুদ্ধে পরাজয়ের পর বিজয়ী শক্তিবর্গ নেপোলিয়নের নিকট ফ্রাঙ্কফুর্ট প্রস্তাব পেস করেন। এই প্রস্তাব নেপোলিয়নের পক্ষে যথেষ্ট সম্মানজনক ছিল। তাঁকে শুধু বেলজিয়াম ও হল্যান্ডের উপর অধিকার ত্যাগ করতে বলা হয়। কিন্তু এই সম্মানজনক প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নেপোলিয়ন চরম অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। 

৬. স্ববিরোধিতা ও জনপ্রিয়তা হ্রাস :- ফ্রান্সের সিংহাসনারোহন করে তিনি মুক্তিদাতা হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন এবং সমগ্র ইউরোপে জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু শীঘ্রই ফ্রান্সের জনগণ নেপোলিয়নের শাসনের বাস্তব প্রকৃতি উপলব্ধি করতে পারে। তাঁরা বুঝতে পারেন বিপ্লব পূর্ববর্তী ফরাসি শাসন ও নেপোলিয়নের শাসনের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য ছিল না। সীমাহীন কর , সৈন্যদলে যোগদান করতে বাধ্য করা , সাম্রাজ্যবাদী নীতি , মহাদেশীয় ব্যবস্থা - এগুলি ফরাসিবাসীদের বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। 


৭. মিত্রশক্তির জোট - গঠন :- ইউরোপীয় রাজনীতিতে ইংল্যান্ডের নেতৃত্বে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে চতুর্থ শক্তিজোট গঠিত হয়। ইতিপূর্বের যুদ্ধগুলিতে নেপোলিয়নের জয়লাভের প্রধান কারণ ছিল নেপোলিয়ন বিরোধী শক্তিগুলি পরস্পর ঐক্যবদ্ধ না থাকা। কিন্তু চতুর্থ শক্তিজোট গঠিত হওয়ার পর তাদের মিলিত শক্তির সামনে নেপোলিয়নের ফরাসি বাহিনী অত্যন্ত দুর্বল ছিল। এই চতুর্থ শক্তিজোট শেষ পর্যন্ত নেপোলিয়নের পতনকে ত্বরান্বিত করে। 

৮. স্পেনীয় ক্ষত :- স্পেন সংক্রান্ত নীতিকে নেপোলিয়ন নিজেই '' স্পেনীয় ক্ষত '' বলে অভিহিত করেছেন। স্পেন অধিকার করার পর তিনি স্পেনের সিংহাসনে নিজ ভ্রাতা জোসেফ বোনাপার্টকে স্পেনের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন। কিন্তু এটি ছিল নেপোলিয়নের মারাত্মক ভুল। নেপোলিয়নের এই নীতির ফলে সমগ্র স্পেন জাতি নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। এই প্রথম নেপোলিয়নকে একটি সমগ্র জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। স্পেনের সাথে যুদ্ধে নেপোলিয়নের প্রায় পাঁচ লক্ষ সেনা নিহত হয়। 

৯. রাশিয়া অভিযানে ব্যর্থতা :- একদিকে নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের ভিত্তি ছিল দুর্বল। ফ্রান্সেই নেপোলিয়নের নীতির বিরোধিতা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। অন্যদিকে ইংল্যান্ডে অপরাজেয় রেখে রাশিয়া আক্রমণ করা ছিল নেপোলিয়নের মারাত্মক ভুল। প্রবল শীত , রুশ বাহিনীর গেরিলা রণকৌশল ও পোড়ামাটির নীতি - ইত্যাদির ফলে নেপোলিয়নের বাহিনী চরমভাবে ব্যর্থ হয়। এই পরাজয়ের ফলে ইউরোপের সর্বত্র নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা যায়। 

১০. মহাদেশীয় অবরোধ ও তার ব্যর্থতা :- ইউরোপে ইংল্যান্ডের আধিপত্য খর্ব করতে ও ইংল্যান্ডকে অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস করতে নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এই ব্যবস্থা কার্যকর করতে নেপোলিয়নকে একের পর এক নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলিকে জয় করতে হয় এবং তীব্র প্রতিক্রিয়াশীল নীতি গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু দুর্জেয় নৌ- শক্তিতে বলীয়ান ইংল্যান্ড সহজেই নেপোলিয়নের মহাদেশীয় অবরোধ ভেঙে ফেলে। সমগ্র ইউরোপে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষের সঞ্চার হয় এবং এই বিদ্বেষ নেপোলিয়ন বিরোধী শক্তিগুলিকে একজোট হতে সাহায্য করে। 

পরিশেষে বলা যায় , কোনো একটি কারণ বিশেষভাবে নেপোলিয়নের পতনের জন্য দায়ী ছিলনা। উল্লিখিত বিভিন্ন কারণগুলি সমবেতভাবে নেপোলিয়নের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল।   


 

You May Also Like

0 comments