নেপোলিয়নের মহাদেশীয় ব্যবস্থা আলোচনা কর। মহাদেশীয় ব্যবস্থার ব্যর্থতার কারণগুলি আলোচনা কর।

by - January 03, 2022

নেপোলিয়নের মহাদেশীয় ব্যবস্থা আলোচনা কর। মহাদেশীয় ব্যবস্থার ব্যর্থতার কারণগুলি আলোচনা কর।  


নেপোলিয়নের মহাদেশীয় ব্যবস্থা :- 


ব্রিটেন ফ্রান্স অপেক্ষা নৌশক্তিতে বরাবর উন্নত ছিল। কিন্তু বাণিজ্যিক ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে সমুদ্রের ওপর প্রভাব বিস্তার ও ব্রিটেনের ওপর অধিকার স্থাপন করা একান্ত প্রয়োজন ছিল। কিন্তু নৌ শক্তিতে বলীয়ান ব্রিটেনকে দমন করা ফ্রান্সের পক্ষে সেইসময়ে সম্ভব ছিল না। ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে ইংল্যান্ড আক্রমণ করা ফ্রান্সের পক্ষে কার্যত অসম্ভব ছিল। তাই নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। নেপোলিয়নের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপীয় অর্থনীতির মূল স্রোত থেকে ইংল্যান্ডকে দূরে রাখা। 


বার্লিন ডিক্রি ১৮০৬ :- ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের লক্ষ্যে নেপোলিয়ন ১৮০৬ এর নভেম্বরে বার্লিন ডিক্রি জারি করেন। এই নির্দেশনামার মূল বিষয়গুলি ছিল - 
(i) ইংল্যান্ডের ওপর নৌ - অবরোধ ঘোষণা করা হয়। 
(ii) ফ্রান্স অধিকৃত অঞ্চলগুলি থেকে ব্রিটিশ নাগরিকদের গ্রেপ্তারের আদেশ দেওয়া হয়। 
(iii) ফ্রান্স বা তার অধিকৃত কোনো দেশ বা ফ্র্রান্সের মিত্রপক্ষের কোনো দেশে ইংল্যান্ডের জাহাজ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। 
(iv) এই সমস্ত অঞ্চলগুলিতে ইংল্যান্ডের পণ্য বিক্রয়ও নিষিদ্ধ হয়। 

ব্রিটেনের প্রত্যুত্তর : অর্ডার - ইন - কাউন্সিল (১৮০৭) :- নেপোলিয়নের বার্লিন ডিক্রির প্রত্যুত্তরে ইংল্যান্ড অর্ডার - ইন - কাউন্সিল ঘোষণা করে। এর মূল বিষয়গুলি ছিল - 
(i) ইংল্যান্ড ও তার মিত্ররাষ্ট্রগুলিতে ফ্রান্সের সকল প্রকার পণ্য নিষিদ্ধ হয়। 
(ii) ফ্রান্স ও তার মিত্রশক্তিগুলির ওপর ইংল্যান্ডের নৌ - অবরোধ ঘোষিত হয়। 
(iii) নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলিকে ব্রিটেনের সাথে শর্তসাপেক্ষে বাণিজ্যের অধিকার দেওয়া হয়। 
(iv) নিরপেক্ষ কোনো জাহাজ ফ্রান্স বা তার মিত্ররাষ্ট্রে যেতে চাইলে তাকে ইংল্যান্ডের অনুমতি নিতে হবে। 
(v) উক্ত শর্ত না মানলে নিরপেক্ষ দেশের জাহাজ সহ পণ্য সামগ্রী ইংল্যান্ড বাজেয়াপ্ত করবে। 


মিলান ডিক্রি (১৮০৭) :- ইংল্যান্ডের অর্ডার - ইন - কাউন্সিলের প্রত্যুত্তরে নেপোলিয়ন ১৮০৭ সালে মিলান ডিক্রি জারি করেন। এই নির্দেশনামার মূল বক্তব্য ছিল - কোনো নিরপেক্ষ রাষ্ট্র অর্ডার - ইন - কাউন্সিল অনুযায়ী ইংল্যান্ডের কাছ থেকে লাইসেন্স নিলে সেই দেশ এবং তার জাহাজ ব্রিটিশ সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করে ফ্রান্স তা দখল করবে এবং সেই দেশ ও তার জাহাজকে ফ্রান্স শত্রু রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করবে। 

ওয়ারস ডিক্রি :- শুধুমাত্র মিলান ডিক্রি জারি করে নেপোলিয়ন সন্তুষ্ট হননি। তিনি এরপর ওয়ারস ডিক্রি জারি করেন। এটি মূলতঃ ছিল মিলান ডিক্রির একটি পরবর্তী স্তর। এতে বলা হয় , কোনো দেশ বা জাহাজ মিলান ডিক্রির নির্দেশগুলি অমান্য করলে তার পণ্য সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করে তা পুড়িয়ে ফেলা হবে। 

Fontainebleau Decree :- ওয়ারস ডিক্রির পর ১৮১০ সালে তিনি Fontainebleau Decree জারি করেন। এই নির্দেশনামাতেও অধিকৃত ইংরেজ পণ্য পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ বহাল রাখা হয় এবং ফ্রান্স কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশগুলি অমান্যকারী ব্রিটিশ বা বন্ধুরাষ্ট্রের বণিকদের বিচারের জন্য বিশেষ আদালত স্থাপনের ঘোষণা করা হয়। 

লাইসেন্স প্রথা :- উপরোক্ত বিভিন্ন বিধি ব্যবস্থা গ্রহণ করা স্বত্তেও নেপোলিয়নের মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা সফল হয়নি। এই পরিস্থিতিতে নেপোলিয়ন উপলব্ধি করেন , সম্পূর্ণরূপে ইংল্যান্ড থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ করা সম্ভব নয়। এরপর নেপোলিয়ন ইংল্যান্ড থেকে পণ্য আমদানিকারক বণিকদের জন্য লাইসেন্স প্রথা চালু করেন। মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা যে কার্যকরী হয়নি , লাইসেন্স প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে নেপোলিয়ন কার্যত তা মেনে নেন।  


মহাদেশীয় ব্যবস্থার ব্যর্থতার কারণ :- 

নেপোলিয়ন কর্তৃক ইংল্যান্ডের ওপর আরোপিত মহাদেশীয় ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়। এর কারণগুলি ছিল :- 

১. ইউরোপের উপকূলরেখা ছিল সুদীর্ঘ। এই বিরাট উপকূল বরাবর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার মত ব্যাপক নৌ শক্তি ইংল্যান্ডের ছিল না। 

২. ইংল্যান্ডের নৌশক্তি ছিল প্রচন্ড শক্তিশালী। এই শক্তিশালী নৌ - বহরের সাহায্যে ইংল্যান্ড সহজেই নিজ অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে আধিপত্য রক্ষা করতে এবং ফ্রান্সের দুর্বল নৌ - প্রতিরোধকে প্রতিহত করতে সমর্থ হয়েছিল। 

৩. ইংল্যান্ডে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী - যেমন - বস্ত্র , চিনি - ইত্যাদির ব্যাপক চাহিদা ছিল পুরো ইংল্যান্ড জুড়ে। তাই ইংল্যান্ডে উৎপাদিত পণ্য সামগ্রীর ওপর নিষেধাজ্ঞা সফল হয়নি। 

৪. নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডের পণ্যসামগ্রীর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে ফ্রান্সের বিভিন্ন মিত্ররাষ্ট্র চোরাচালানের মাধ্যমে ইংল্যান্ড থেকে পণ্য আমদানি শুরু করে। এতে তাদের খরচ বহুগুন বেড়ে যায় এবং তারা নেপোলিয়নের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়। 

৫. শক্তিশালী নৌবহরের অভাবে ফ্রান্স বার্লিন ডিক্রি , মিলান ডিক্রি - ইত্যাদি ইংল্যান্ড বিরোধী নির্দেশগুলি কার্যকর করতে ব্যার্থ হয়। কিন্তু অপরদিকে শক্তিশালী নৌ - বহর থাকায় ইংল্যান্ড ফ্রান্সের বিরুদ্ধে অর্ডার - ইন - কাউন্সিল সফলভাবে প্রয়োগ করে। 

৬. ব্রিটেন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ফ্রান্সের তুলনায় বহুগুন উন্নত ছিল। শিল্পবিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ড প্রভূত ধন - সম্পদের অধিকারী হয়েছিল। পক্ষান্তরে ফ্রান্স ছিল একটি বিপ্লব জর্জরিত দেশ। নেপোলিয়নের আমলে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটলেও ইংল্যান্ডের তুলনায় তা ছিল নগন্য। 

৭. বিরোধিতা যে শুধুমাত্র ফ্রান্সের বাইরে থেকেই এসেছিল - তা নয়। একদল ফরাসি বণিক ও শিল্পপতিরাও নেপোলিয়নের মহাদেশীয় অবরোধের তীব্র বিরোধিতা করতে থাকেন। 

৮. সামরিক ব্যবস্থার উৎকর্ষ সাধনে ও মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা কার্যকর করতে নেপোলিয়ন বণিক , শিল্পপতি ও বাণিজ্যিক পণ্যের ওপর চড়া হারে শুল্ক ধার্য করেন। ফলে তারাও নেপোলিয়নের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। 

৯. নেপোলিয়নের নীতির ফলে নিরপেক্ষ দেশগুলি বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে প্রচন্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল। তাই তারা নেপোলিয়নের প্রতি বিরোধী মনোভাব পোষণ করতে শুরু করে।  

     

You May Also Like

0 comments