শিল্পবিপ্লবের ফলাফল আলোচনা করো। Discuss the consequences / effects of the Industrial Revolution.

by - December 20, 2021

Discuss the consequences / effects of the Industrial Revolution.

শিল্পবিপ্লবের ফলাফল আলোচনা করো। 


শিল্পবিপ্লবের ফলাফল :- 


আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসে শিল্পবিপ্লব ছিল একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এটির প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী ছিল যে , তা আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। শিল্পবিপ্লবের ফলে ইউরোপীয় দেশগুলিতে যে বিপুল পরিমান পণ্য সামগ্রী উৎপাদিত হতে থাকে , তা পরোক্ষভাবে সাম্রাজ্যবাদী প্রসার , পুঁজিবাদের প্রসার , উপনিবেশ স্থাপন , সারা পৃথিবী জুড়ে বাজার দখল - ইত্যাদি বিষয়গুলিকে উৎসাহ প্রদান করে। ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় যে , যেসকল দেশগুলি শিল্পোন্নত ছিল তারাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে লিপ্ত হয়। এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম সফলরূপে শিল্পবিপ্লব সংগঠিত হয় এবং তার পরবর্তীকালে ইংল্যান্ড সাম্রাজ্যবাদের প্রসারে লিপ্ত হয়। শিল্পবিপ্লবের সামগ্রিক ফলাফলগুলি হল - 


১. অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন :- শিল্পবিপ্লব সংগঠিত হওয়ার পূর্ববর্তী সমাজ ও অর্থনীতি ছিল মূলতঃ কৃষি নির্ভর। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে শুরু হওয়া শিল্পবিপ্লবের পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। যেহেতু শিল্পজাত পণ্যগুলির উৎপাদন ব্যাপক হারে হতে থাকে সেহেতু অর্থনীতি ধীরে ধীরে শিল্পনির্ভর হয়ে পড়ে। এই পরিবর্তন সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দেয়। 

২. গ্রাম সমাজের অবক্ষয়ের সূচনা :- শিল্প কলকারখানাগুলিতে প্রয়োজন ছিল প্রচুর সুলভ শ্রমিকের। অন্যদিকে গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থায় রোজগার ছিল অনিয়মিত ও অনিশ্চিত। কিন্তু শিল্প কলকারখানাগুলিতে ব্যাপক হারে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হয়ে পরে। তাই গ্রামীণ মানুষ অনিশ্চিত কৃষিকাজ ত্যাগ করে শহরগুলিতে চলে আসতে শুরু করে শ্রমিক হিসাবে কর্মপ্রাপ্তির আশায়। এর ফলে গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীতির অবক্ষয়ের সূচনা ঘটে। 


৩. নগর জীবনের বিকাশ :- শিল্প , কলকারখানা - এই বিষয়গুলি ছিল নগরকেন্দ্রিক। যেহেতু গ্রামের বহু মানুষ শ্রমিক হিসাবে কলকারখানাগুলিতে যোগদান করার জন্য দলে দলে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসতে শুরু করে সেহেতু শিল্প - কলকারখানাগুলির দ্রুত বিকাশ ঘটতে থাকে। এর পরোক্ষ ফল হিসাবে নগরের অর্থনীতি মজবুত হয় এবং নাগরিক জীবনের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। 

৪. সমাজে দুটি নতুন শ্রেণীর উদ্ভব :- শিল্পায়নের হাত ধরে ইউরোপীয় সমাজগুলিতে দুটি নতুন শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। একটি হল মালিক শ্রেণী এবং অপরটি হল শ্রমিক শ্রেণী। মালিক শ্রেণী পুঁজি বিনিয়োগ করে শিল্প - কলকারখানাগুলিতে এবং শ্রমিক শ্রেণী সেই সকল কলকারখানাগুলিতে উৎপাদনের ধারা বজায় রাখে। এই দুই শ্রেণীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য ছিল। একদিকে মালিকরা ছিল প্রভূত সম্পত্তি ও সামাজিক ক্ষমতার অধিকারী এবং অন্যদিকে শ্রমিকরা ছিল অধিকারহীন , বঞ্চিত শ্রেণী। 

৫. শোষিত ও নির্যাতিত শ্রমিক সমাজ :- গ্রাম ছেড়ে কাজের আশায় বহু মানুষ শহরের কলকারখানাগুলিতে যোগদান করলেও , শহরে এবং কর্মক্ষেত্রে তাদের শোষণ ও নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়। প্রথমতঃ তাদের দিয়ে প্রয়োজনের বেশি শ্রম করানো হত। দিনে প্রায় ১৬ ঘন্টা থেকে ১৮ ঘন্টা তাদের কলকারখানায় কাজ করতে হত। এর পরিবর্তে ন্যায্য মজুরি তারা পেতনা। শ্রমিকদের জন্য চিকিৎসা , তাদের সন্তানদের জন্য শিক্ষা - এসব কোনো কিছুরই ন্যুনতম বন্দোবস্ত ছিল না। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলিও তাদের স্বল্প ও অনিয়মিত বেতনে সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। 

৬. পুঁজিবাদী অর্থনীতির উদ্ভব :- শিল্পায়নের হাত ধরে যেহেতু গ্রামীণ অর্থনীতির বিনাশ ঘটে , সেহেতু তার অনিবার্য ফল হিসাবে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে পুঁজিবাদ বিস্তারলাভ করে। মালিক শ্রেণী পণ্য উৎপাদনে প্রচুর পুঁজি বিনিয়োগ করে এবং মুনাফা অর্জন করে। ক্রমে এই ধারা ইউরোপীয় অর্থনীতিতে প্রধান হয়ে ওঠে। ক্রমে পুঁজিবাদের অনুকূলেই রাষ্ট্রীয় নীতি প্রবর্তিত হয়। 

৭. অর্থনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক : মালিক শ্রেণী :- শিল্পবিপ্লবের সময়কালে পুঁজির বিনিয়োগ অর্থনীতিকে পুঁজিনির্ভর করে তোলে। যেহেতু পুঁজির নিয়ন্ত্রণ ছিল শিল্পপতি বা মালিক শ্রেণীর হাতে , তাই ধীরে ধীরে তারাই অর্থনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন। পুঁজিবাদের বিস্তার সহজ করার জন্য তারা সরকারি নীতিকে প্রভাবিত করতে থাকেন। 

৮. অভিজাত , সামন্ত ও ভূস্বামী : - শ্রেণীর ক্ষমতার হ্রাস :- শিল্পবিপ্লবের পূর্ববর্তী সময়কাল পর্যন্ত সমাজের সকল ক্ষমতা অভিজাত , সামন্ত ও ভূস্বামীদের হাতে নিহিত ছিল। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের সময়কালে যেহেতু পুঁজিবাদের ব্যাপক প্রসার ঘটে সেহেতু সমস্ত ক্ষমতা চলে যায় মালিক ও শিল্পপতিদের হাতে এবং উপরোক্ত তিন শ্রেণীর ক্ষমতা ব্যাপক ভাবে হ্রাস পায়। মালিক শ্রেণী অর্থনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে এবং তাদের স্বার্থেই রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালিত হতে থাকে। 


৯. এক বিশৃঙ্খল সামাজিক পরিস্থিতির উদ্ভব :- একদিকে মালিক শ্রেণী শ্রমিকদের কতটা শোষণ করে কতটা মুনাফা অর্জন করা যায় সেই প্রচেষ্টায় ব্যস্ত ছিল এবং অন্যদিকে শ্রমিকদের অবস্থা হয়ে পড়েছিল মনুষ্য জীবন ধারণের অনুপযোগী। তাই ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলিতে মালিক ও শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে শত্রুতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। যার ফল হিসাবে শ্রমিক অসন্তোষ , দাঙ্গা - ইত্যাদির উদ্ভব ঘটে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র মালিক শ্রেণির অনুকূলে থাকায় শ্রমিক শ্রেণীকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। 

১০. মালিক - শ্রমিক দ্বন্দ্ব ও আন্দোলনের সূচনা :- মালিক পক্ষ কোনো মূল্যেই শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা দিতে রাজি ছিল না। শ্রমিকেরা দিনে দিনে শোষিত ও নির্যাতিত হয়ে আসছিল। এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের একমাত্র ভরসার জায়গা ছিল রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ। কিন্তু যেহেতু পুঁজিবাদ রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিল তাই রাষ্ট্রের অবস্থান ছিল শ্রমিকদের বিরুদ্ধে। এই অবস্থায় শ্রমিকদের সামনে আন্দোলন ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা ছিল না। 

১১. সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার :- ইউরোপীয় দেশগুলিতে শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে প্রচুর পণ্য উৎপাদিত হতে থাকে। এই পণ্য বিক্রয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল বিরাট বাজারের। এই সমস্যার সমাধান করতে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ অন্যান্য পাশ্চাত্যদেশসহ বিশেষ করে পূর্বের দিকে সাম্রাজ্যবাদের প্রসারে অগ্রসর হতে থাকে। এর একমাত্র লক্ষ্য ছিল প্রাচ্য দেশগুলির বিরাট বাজার দখল করা। এই বাজার দখল করতে গিয়ে আবার সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও শুরু হয়। যেমন ভারত তথা বাংলাকে কেন্দ্র করে ইঙ্গ - ফরাসি দ্বন্দ্ব। 

১২. উপনিবেশগুলি কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয় :- বাজার দখলের উদ্দেশে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি ভারত , আফ্রিকা - ইত্যাদি বিভিন্ন দেশে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করে। এই সমস্ত উপনিবেশগুলোতে একদিকে তারা যেমন তাদের পণ্য বিক্রয়ের জন্য তথাকার শিল্প ও কুটিরশিল্পগুলিকে ধ্বংস করে এবং অন্যদিকে সেই সমস্ত উপনিবেশগুলিকে নিজেদের প্রয়োজনে কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশে পরিণত করে। 

পরিশেষে বলা যায় , শিল্পবিপ্লব শুধুমাত্র যে ইউরোপীয় দেশগুলিকেই প্রভাবিত করেছিল - এমনটা নয়। উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে , শিল্পবিপ্লবের সারা পৃথিবীকেই প্রভাবিত করেছিল। একদিকে যেমন ইউরোপীয় দেশগুলিতে সমাজ ও অর্থনীতির পরিবর্তন ঘটেছিল তেমন অন্যদিকে শিল্পবিপ্লব সাম্রাজ্যবাদকে উৎসাহ দিয়ে সারা পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দিয়েছিল।   



You May Also Like

0 comments