causes of industrial revolution in england ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম শিল্প বিপ্লব ঘটার কারণ :-

by - December 10, 2021

ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম শিল্প বিপ্লব ঘটার কারণ :- 


ভূমিকা :- 
শিল্পবিস্তারের সঙ্গে ইংল্যান্ডের নাম বিশেষভাবে জড়িত। ১৭৪০ থেকে ১৮২০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বয়ন ও ধাতুশিল্পের উন্নতি হয়েছিল এবং ওয়াট-নির্মিত বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কৃত হয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বস্ত্র ও লৌহ বা ইস্পাত নির্মিত যন্ত্রপাতির উন্নতি হলেও প্রকৃতপক্ষে কলকারখানার উন্নতি এবং প্রচুর পরিমাণে শিল্পজাত সামগ্রীর উৎপাদন ঊনবিংশ শতাব্দীতেই ঘটে। ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত ইংল্যান্ডবাসী মেষচারণ ও বাণিজ্যের সঙ্গে অধিক জড়িত ছিল। কিন্তু এর পর থেকেই ইংল্যান্ডবাসী কোন-না-কোন শিল্প-কারখানার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। 

 
ফ্রান্সে অধিকতর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ইংল্যান্ডেই সর্বপ্রথম এই বিপ্লব ঘটে :- 
শিল্প-বিপ্লবের পূর্ববর্তী কালের ইওরােপের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় সেই সময় ফ্রান্সই ইংল্যান্ডের তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ ছিল। ইংল্যান্ডের ন্যায় ফ্রান্সেরও ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য ছিল এবং ফ্রান্সে ইতিপূর্বেই কিছু কিছু শিল্প-সংস্থা গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ফরাসী বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সের শিল্পগুলি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায় এবং এই কারণেই ফ্রান্স ইংল্যান্ডের পূর্বে শিল্প বিপ্লবের দ্বারে পৌছাতে পারল না। ঐতিহাসিক এল সি এ নােলেস্ (L. C. A. Knowless )-এর মতে ফরাসী বিপ্লবের ফলে ফরাসী শিল্পগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত না হলে ফ্রান্সই শিল্প-বিপ্লবের অগ্রদূত হত। (“But for the utter destruction of industrial and commercial life after the French Revolution, one is tempted to think that France and not England might have been the pioneering country in the Industrial Revolution"-Knowless )! কয়েকটি কারণে ইংল্যান্ডেই সর্বপ্রথম শিল্প বিপ্লবের সূত্রপাত হয়। যেমন :- 


১. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা :- 
ইংল্যান্ডের সমকালীন রাষ্ট্রনৈতিক স্থিতিশীলতা শিল্প বিপ্লবের অনুকূল ছিল। ১৬৮৮ খ্রীষ্টাব্দের পর যদিও ইংল্যান্ড নানা যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়েছিল, তথাপি এই যুদ্ধগুলি সংঘটিত হয়েছিল ইংল্যান্ডের বাইরে। ফলে যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক প্রভাব ইংল্যান্ডে পড়ে নি । এছাড়া ইংল্যান্ডের নৌবহর ছিল খুবই শক্তিশালী ; যার সঙ্গে ইওরােপের অন্যান্য দেশের নৌবহরের তুলনা করা যায় না। ফ্রান্স ও জার্মানীতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকায় সেখানে শিল্প বিপ্লব ঘটবার সুযােগ তখনও আসে নি । অপরদিকে ওয়ালপােলের ( Walpole) অর্থনৈতিক নীতির ফলে ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়।।

২. সামাজিক গতিশীলতা :- 
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইংল্যান্ডের সামাজিক গতিশীলতাও শিল্প-বিপ্লবের সহায়ক হয়। ইওরােপের অন্যান্য দেশে সামাজিক জড়ত্ব অর্থনৈতিক তথা শিল্পোন্নয়নের প্রতিবন্ধক ছিল। ফ্রান্স ছাড়া অন্য সকল দেশেই দাসত্ব-প্রথা তখনও অব্যাহত ছিল। ব্যক্তিস্বাধীনতার অভাবহেতু সেই সকল দেশে শিল্প-বিপ্লব ঘটবার সুযোেগ তখনও আসে নি ।

৩. প্রাকৃতিক সুযোগ - সুবিধা :- 
অনেকের মতে কতকগুলি প্রাকৃতিক সুযােগ-সুবিধাও ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের সহায়ক হয়। বিশেষ ভৌগােলিক অবস্থিতির ফলেই ইংল্যান্ড তার নৌ-বিদ্যা ও নৌবহরের উন্নতিসাধন করতে সক্ষম হয়েছিল। এছাড়া ইংল্যান্ডের উপকূল ছিল বন্দরে পূর্ণ ও নদীগুলি ছিল নৌ-চালনযােগ্য। তাছাড়াও ইংল্যান্ডে ছিল বিশাল লৌহ ও কয়লার ভাণ্ডার। ঐতিহাসিক হব্সবম ( Hobsbawm ) ইংল্যান্ডে শিল্প-বিপ্লবের মূলে প্রাকৃতিক সুযােগ-সুবিধার কারণগুলিকে ‘হাল্কা বিশ্লেষণ’ বলে মনে করেন। তার মতে জলবায়ু, ভূগােল, জনসংখ্যা বা অন্যান্য বাহ্য কারণগুলি কোনটিই এককভাবে গ্রহণযােগ্য নয় । তার মতে এগুলি আপনা-আপনি কাজ করে না। এদের সক্রিয় ভূমিকা দেখা দেয় সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রতিষ্ঠানিক কাঠামাের মধ্যে। ("Climate factor, geography, the distribution of natural resources operate not on their own ; but only within a given economic and institutional framework”—Hobsbawm-Industry and Empire ) ! 


৪. মূলধনের প্রাচুর্য :- 
শিল্পের প্রসারের জন্য যে সকল উপকরণের প্রয়ােজন হয় তা সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডেই পাওয়া গিয়াছিল,
যেমন—মূলধন, শ্রমিক, শিল্প-কৌশল, বিভিন্ন উপকরণ, শিল্পজাত সামগ্রীর বিক্রয়ের জন্য উপযুক্ত বাজার ইত্যাদি। কারখানা ও যন্ত্রপাতির নির্মাণ, শ্রমিকনিয়ােগ এবং কাঁচামাল খরিদ প্রভৃতি ব্যাপারে প্রচুর মূলধনের ( Capital ) প্রয়ােজন হইয়া থাকে। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে প্রচুর অর্থাগম হয়। কিছুসংখ্যক লােকের হাতে প্রচুর অর্থসম্পদ জমে ওঠে। এই শ্রেণীর লােকেরা কারখানা স্থাপন করে ও যন্ত্রপাতি ক্রয় করে শিল্পে অর্থ বিনিয়ােগ করে। ফলে শিল্পের প্রসার ঘটে। তাছাড়া মূলধন সংগ্রহের ব্যাপারে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড যথেষ্ট সাহায্য করে। শিল্পগুলিতে অর্থ-বিনিয়ােগ করার প্রয়ােজন দেখা দিলে ইংল্যান্ডের জয়েন্ট স্টক (Joint Stock) ব্যাঙ্কগুলিকে বৈধ করা হয় (১৮২৬ খ্রীঃ)। পরবর্তী কয়েক দশকের মধ্যে শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য বহু জয়েন্ট স্টক সংস্থা গড়ে ওঠে এবং এইগুলি খুব সহজ শর্তে শিল্পগুলিতে অর্থ-বিনিয়ােগ শুরু করে। সেইসঙ্গে স্বীকার করতে হয় যে ইংল্যান্ডের শিল্পপতিরা নিজেরাই মূলধন সৃষ্টি করত। ( “Much of England's industrial capital was self-generated”—Hayes---Contemporary Europe Since 1870–পৃঃ ৪)। ফলে অতি সহজেই ইংল্যান্ডে শিল্পের প্রসার সম্ভব হয়।

৫. সুলভ শ্রমিক :-  
সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ইংল্যান্ডের জনসংখ্যা অভাবনীয় ভাবে বৃদ্ধি পায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইওরােপ থেকে বহু শ্রমিক রােজগারের সন্ধানে ইংল্যান্ডে আগমন করে। তাছাড়া কৃষির পরিবর্তে মেষচারণ শুরু হলে বহু কৃষক বেকারে পরিণত হয়। তারা দলে দলে শহরে এসে কলকারখানায় শ্রমিকের কাজে নিযুক্ত হয়। সুতরাং কলকারখানার প্রসারের জন্য ইংল্যান্ডে শ্রমিকের কোন অভাব ছিল না।

৬. শিল্প কৌশল ও শিল্প উপকরণ :- 
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইংল্যান্ডে শিল্প ও যন্ত্রপাতির নির্মাণের কৌশল উন্নত হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে শিল্প-কৌশল (Techniques ) ও যন্ত্রপাতি নির্মাণের ব্যাপারে ইংল্যান্ড সকলের অগ্রণী হয়ে  ওঠে। শিল্পের প্রসার ও উন্নতির প্রয়ােজনীয় উপকরণ (যেমন—লৌহ, কয়লা ইত্যাদি) ইংল্যান্ডে প্রচুর পরিমাণেই ছিল। জন কে-র ‘মাকু’, হারগ্রিভস-এর ‘স্পীনিং জেনি’, আর্করাইট-এর ‘ওয়াটার ফ্রেম’, কার্টরাইট-এর ‘পাওয়ার লুম’ ইত্যাদির আবিষ্কার অষ্টাদশ শতকের পূর্বেই ঘটেছিল এবং কারখানায় এইগুলির প্রযুক্তিও শুরু হয়েছিল - যা প্রত্যক্ষভাবে শিল্পবিপ্লবে সহায়তা করে। 

৭. বাজার ও বিক্রয়কেন্দ্রের প্রসার :-   
১৭০৭ ও ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের সঙ্গে যথাক্রমে স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের সংযুক্তি ঘটলে  ইংল্যান্ডের বাজার প্রসারিত হয়। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের মধ্যে কোন প্রকার শুল্ক-প্রাচীর না থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণ অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের বণিকগণ উত্তর-আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার কিছু কিছু অঞ্চলে বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে তুলেছিল। উত্তর-আমেরিকা ছিল ইংল্যান্ডের শিল্পজাত সামগ্রীর বৃহৎ বিক্রয়কেন্দ্র। ভারতেও ইংল্যান্ডে নির্মিত যন্ত্রপতি ও সূতীবস্ত্রের প্রচুর চাহিদা ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ছিল ইংল্যান্ডের শিল্পজাত পণ্যের এক বিরাট বাজার। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকার আমদানির পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। ফরাসী-বিপ্লব ও নেপােলিয়নের সময় স্পেন-অধিকৃত আমেরিকার উপনিবেশগুলি ছিল ব্রিটিশ পণ্যের রমরমা বাজার। সমগ্র বিশ্বে, ক্যান্টন থেকে বুনাে আয়ার্স ( Buenos Aires), কেপটাউন থেকে নর্থ-কেপ পর্যন্ত ঊনবিংশ শতকে ব্রিটিশ ব্যবসা বাণিজ্য একরূপ অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল।

৮. কাঁচামালের সহজলভ্যতা :- 
ইংল্যান্ড তার সুবিশাল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য থেকে নিয়মিত শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহের সুযোগ পেয়েছিল। এমন সুবিশাল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলির না থাকায় তারা শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়। তাই প্রয়োজনীয় কাঁচামালের সহজলভ্যতা ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল। 

৯. বাণিজ্যের গুরুত্ব বৃদ্ধি :- 
ইংল্যান্ডে সপ্তদশ শতকের মধ্যেই কৃষিনির্ভর রাষ্ট্র থেকে বাণিজ্যনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ফলে ইংল্যান্ডের অর্থনীতি খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠায় তারা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলিতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ পায়। 

১০. যোগাযোগ ও পরিবহন :- 
সমুদ্রবেষ্টিত ইংল্যান্ডের নৌশক্তি ছিল বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ। পণ্যবোঝাই ব্রিটিশ জাহাজগুলি সমুদ্রপথে পৃথিবীর সকল দেশগুলিতে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারত। দেশের উপকূলে অবস্থিত অসংখ্য বন্দর থেকে খাল ও নদীপথে দেশের অভ্যন্তরে পণ্য পরিবহণের সুবিধা ছিল যথেষ্ট উন্নত। যোগাযোগ ব্যবস্থার দিক দিয়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলি ইংল্যান্ডের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল।  



You May Also Like

0 comments