Review the contribution of philosophers to the French Revolution. ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান :-

by - December 10, 2021

ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান পর্যালোচনা করো। 


ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান :-  


যেকোনো মহান বিপ্লবই প্রথমে জন্ম নেয় মানুষের অন্তরে , তার ভাবজগতে। ফ্রান্সের দার্শনিকগণ ফরাসি বিপ্লবে ফরাসিবাসীর মানসিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন - একথা বলা চলে। দার্শনিকগণ তাঁদের চিন্তাশক্তিকে লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করে তৎকালীন ফ্রান্সে প্রচলিত সামাজিক , অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের যে স্বরূপ তুলে ধরেছিলেন তার জন্যই ফরাসি বিপ্লবের সংঘটন সহজ হয়েছিল। ঐতিহাসিক রাইকার ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান প্রসঙ্গে বলেছেন -  বাস্তবিকই, ফ্রান্সে ভাবাবেগের প্রতিক্রিয়াই ছিল বিপ্লবের কারণ ( It was in fact , an emotional reaction which came to France that accounts for the revolution". 


মন্তেস্কু (১৬৮৯-১৭৫৫ খ্রি.)-র অবদান :- 

পেশায় আইনজীবী ব্যারন চার্লস ডি মন্তেস্কু এক অভিজাত পরিবারের সন্তানরপে উদারনৈতিক বুর্জোয়া মতাদর্শের পূজারী ছিলেন এবং ইংল্যান্ডের নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন। ব্রিটিশ সংবিধানের ক্ষমতা বিভাজন নীতির প্রতি অনুরক্ত হয়ে তিনি “দি স্পিরিট অব্ লজ’ গ্রন্থ রচনা করেন (১৭৪৮ খ্রি.)। এই গ্রন্থে তিনি রাজার ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতার সমালােচনা করেন এবং রাষ্ট্রের শাসন, আইন, বিচারবিভাগকে আলাদা করার প্রস্তাব রাখেন। এই গ্রন্থটির ১৮ মাসে ২২টি সংস্করণ শেষ হওয়ায় বােঝা যায়, এটি ফরাসিবাসীর কাছে কতটা জনপ্রিয় ছিল। তাঁর অপর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ ছিল ‘দি পার্সিয়ান লেটারস'। এই গ্রন্থটিতে তিনি ফ্রান্সে ভ্রমণ করতে আসা দুই ব্যক্তির কল্পিত চিঠিপত্রের দ্বারা ফ্রান্সে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও প্রচলিত সামাজিক কাঠামাের দোষত্রুটিগুলি মানুষের সামনে তুলে ধরেন।


ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮ খ্রি.)-এর অবদান : -

একাধারে দার্শনিক, ঐতিহাসিক, কবি, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক ভলতেয়ার (প্রকৃত নাম ফাঁসােয়া মারি আরােয়েৎ) ছিলেন সেসময়কার ফ্রান্স তথা ইউরােপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী। তিনিই প্রথম বলেন যে—ইতিহাস শুধুমাত্র সাম্রাজ্যের উত্থানপতনের কাহিনি নয়, এতে সভ্যতা ও সমাজ বিবর্তনের পরিচয় মেলে। অতীতের আলােকে বর্তমানকে যাচাইয়ের হাতিয়ার ইতিহাস। তিনি স্বাধীন চিন্তাশক্তি ও যুক্তিবাদের বিচারে সবকিছু গ্রহণ করতে বলতেন। প্রাশিয়া রাজ ফ্রেডারিক-দি-গ্রেট-এর এই সম্মানীয় অতিথিটি এবং রুশ সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ক্যাথারিনের পরিচিত ভলতেয়ার চেয়েছিলেন চার্চ বা গির্জার প্রতি মানুষের অন্ধ ধর্মবিশ্বাসে ফাটল ধরাতে। তিনি কাঁদিদ’ ও ‘লেতর ফিলজফিক’ নামক দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই দুটি গ্রন্থে তিনি অন্ধ ধর্মীয় কুসংস্কার ও ধর্মীয় অনাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরেন। ভলতেয়ার বলেন—লুথার বা কেলভিন অপেক্ষা আমার যুগে আমি কম করিনি।


রুশাে (১৭১২-১৭৭৮ খ্রি.)-র অবদান :-

ফ্রান্সের সবথেকে জনপ্রিয় দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ছিলেন ‘ঝড়ের পাখি’ ও ফরাসি বিপ্লবের জনক নামে খ্যাত জাঁ জ্যেকুইস রুশাে। রুশাের মূল আদর্শ ছিল সাম্যের ভিত্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রবর্তন। প্রাচীন রােমের ইতিহাস, জেনেভার রাজনৈতিকব্যবস্থা ও কেলভিনবাদের প্রভাবে প্রভাবিত রুশাের রাজনৈতিক ধারণার মূল কথা ছিল—  সামাজিক রাষ্ট্র তখনই সুবিধাজনক যখন প্রত্যেকেরই কিছু থাকে এবং কারােরই বেশি কিছু থাকে না। রুশাে তাঁর বিখ্যাত ‘Origin of Inequality' (অসাম্যের
সূত্রপাত) গ্রন্থে লেখেন—মানুষ সমানাধিকার নিয়েই জন্মায়, কিন্তু লােভী ও স্বার্থপর সমাজব্যবস্থা মানুষকে বঞ্চিত করে। তিনি আরও বলেন—মানুষ স্বাধীনভাবে জন্ম নেয়, কিন্তু সে সর্বত্র শৃঙ্খলাবদ্ধ (“Man is born free, but everywhere he is in chains”)। রুশাের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ছিল ‘সামাজিক
চুক্তি বা Social Contract । এই গ্রন্থে তিনি রাজার ঐশ্বরিক অধিকারের সমালােচনা করেন এবং জনগণের সার্বভৌমত্বের তত্ত্বকে সমর্থন করেন। ঐতিহাসিক হ্যাসাল বলেছেন - যদিও ফরাসি বিপ্লবের মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক, তথাপি রুশাের লেখনীর প্রচণ্ড প্রভাব কোনােমতেই অস্বীকার করা যায় না।

দেনিস দিদেরো ও দ্য এলেমবার্ট-এর অবদান : -

ফরাসি দার্শনিকদের প্রথম সারিতেই ছিলেন দেনিস দিদেরাে। একাধারে দার্শনিক, শিল্পী, সমালােচক, লেখক দেনিস দিদেরাে দ্য এলেমবার্টের সাহায্যে ৩৫ খণ্ডের (১৭৫১ থেকে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে) বিশ্বকোশ সংকলন করেন। অঙ্ক, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য ইত্যাদি বিভিন্ন দিক দিয়ে সমৃদ্ধ ছিল বিশ্বকোশ। দিদেরাে বলতেন—মানুষ তার জৈবিক সংগঠনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাঁর মতে - চারপাশের পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা মানুষের সহজাত। এই ক্ষমতাই মানুষকে মনুষ্যত্ব দিয়েছে, অন্য সমস্ত জীবের থেকে আলাদা করেছে।

মাবলি ও মরেলির অবদান :-

মাবলির ‘দে লা লেজিসলেশন’ ও মরেলি রচিত ‘কোড দে লা নেচার ' -  এই দুটি গ্রন্থে সম্পত্তির যৌথ মালিকানা বা উত্তরাধিকারের অবসানের প্রতি সমর্থন রয়েছে। মরেলি ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিকার বিলােপ ও দুঃস্থদের সরকারি সাহায্য দানের কথা বলেছেন। মাবলির মতে, আদিম সমাজ সুখী ছিল কারণ সেই সমাজে সাম্য ছিল। সাম্য ও সম্পত্তির সামাজিকীকরণ প্রজাসাধারণের সুখের এক অন্যতম শর্ত।

ফিজিওক্রাটস গােষ্ঠীর অবদান: - 

ফরাসি বিপ্লবের পর্বে ফ্রান্সে এক বিখ্যাত অর্থনৈতিক গােষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে, যার নাম ছিল ফিজিওক্রাটস। এই গােষ্ঠীর অন্যতম নেতা ছিলেন কুইসনে এবং অন্যান্য সদস্য ছিলেন তুর্গো, মিরাবাে প্রমুখ। কুইসনে ও তুর্গোর নেতৃত্বে এই গােষ্ঠী অবাধ বাণিজ্য ও বেসরকারি শিল্পস্থাপনের দাবি জানান। কুইসনে রচিত ‘থিওরি অক্ ট্যাক্সেশন’ ও মিরাবো রচিত ‘ফ্রেন্ড অব ম্যানকাইন্ড’ গ্রন্থে মার্কেন্টাইল মতবাদের বিরােধিতা করে অবাধ বাণিজ্য শিল্পনীতিকে সমর্থন করা হয়।


দার্শনিকদের অবদানের মূল্যায়ন : -

ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান আদৌ ছিল কি না বা থাকলেও কতটা ছিল এ বিষয়ে ঐতিহাসিক বা গবেষকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে।

পক্ষে যুক্তি : ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদানকে স্বীকার করে নিয়েছেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন—তেইন, রুস্তান, সেতেব্রিয়া, তকভিল, মাদেলা, রুদে, হল্যান্ড রােজ, বারনেভ প্রমুখ। এঁদের যুক্তি ছিল— 
[i] দার্শনিকেরা সেসময়কার রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাকে যুক্তিবাদের কষ্টিপাথরে বিচার করে অন্যায়, অবিচার ও অনাচারগুলিকে জনসমক্ষে তুলে ধরেছিলেন।
[ii] দার্শনিকরা শিক্ষাদর্শ, উদারনৈতিক মতবাদ ও ন্যায়নীতি তুলে ধরে জনগণের মনে বিপ্লব সম্পর্কে প্রেরণা জুগিয়েছিলেন। 
[iii] সমকালীন ইউরােপের বিভিন্ন দেশে, বিশেষত অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ায় স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা ও সামাজিক অসাম্য থাকলেও সেখানে বিপ্লব ঘটেনি দার্শনিকদের অভাবের জন্য, কিন্তু ফ্রান্সে দার্শনিকদের জন্যই বিপ্লব ঘটে। 
[iv] তৎকালীন ফ্রান্সে দার্শনিক মতবাদগুলি শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের আলােচনার মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল - সালোঁ (মধ্যবিত্তের বৈঠকখানা), কাফে (কফির দোকান), রেস্তোরাঁ, সভাসমিতিতে সাধারণ  ফরাসিবাসীর মধ্যে, যা তাদের উদ্বুদ্ধ করে। 

এরই পরােক্ষ প্রভাবস্বরূপ সর্বসাধারণের মনে বিপ্লবের প্রেরণা এসেছিল। ফরাসিবাসীদের ওপর দার্শনিকদের প্রভাব প্রসঙ্গে তেইন বলেছেন—ফ্রান্স দর্শনের বিষ পান করেছিল (“France drank the poison of philosophy") . 

বিপক্ষে যুক্তি : ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের কোনােরকম প্রভাব ছিল না বলে মনে করেন জোরেস ম্যালে দু-পা, মিশলে, নােফেভর, মাতিয়ে, মিগনে, লাবুস, থিয়ার্স, গুডউইন, মর্সস্টিফেনস, কোব্যান প্রমুখ। এঁদের যুক্তি ছিল—
[i] দার্শনিকরা তাঁদের রচনার মাধ্যমে পুরাতনতন্ত্রের সমালােচনা করলেও সরাসরি বিপ্লবের ডাক দেননি বা বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেননি। তাই বিপ্লবে তাঁদের কোনাে প্রভাব ছিল না।
[ii] ফরাসি বিপ্লব ঘটার ক্ষেত্রে দার্শনিকদের কোনাে অবদানই ছিল না। কেননা তারা লেখনী ধারণ করার অনেক আগেই বিপ্লবী ভাবধারার সঙ্গে ফরাসিবাসী পরিচিত ছিল।
[iii] দার্শনিকরা নন, সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই ফরাসি বিপ্লবের পটভূমি রচনা করেছিল।
[iv] দার্শনিকদের আদর্শগত কোনাে মিল ছিল না। রুশাের আদর্শ ছিল প্রজাতন্ত্র ও সাম্য, মন্তেস্কুর আদর্শ ছিল নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র, ভলতেয়ারের জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচার, ফিজিওক্রাটসদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বিরােধিতা ইত্যাদিতে বিপ্লবের কোনাে আহ্বান ছিল না।

উপসংহার :-
ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান কতটা এ বিষয়ে মতভেদ থাকলেও এটা ঠিক যে বিপ্লবের জন্য ফরাসিবাসীর মানসিক প্রস্তুতি গঠনে সাহায্য করেছিলেন দার্শনিকরাই। ফরাসি বিপ্লবের মূল্যায়ন  প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক সি. জে. হ্যাজেন বলেছেন—দার্শনিকদের জন্য নয়, জাতীয় জীবনের পরিস্থিতি ও অনাচারই বিপ্লব ঘটিয়েছিল। ("The revolution was not caused by the philosophers, but by the conditions and evils of national life")। তবে রুঁদের মতে—রাজনৈতিক দলের বিকল্পরূপে দার্শনিকরাই বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তত করেছিল।


You May Also Like

0 comments