economic causes of french revolution ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণগুলি আলোচনা করো।

by - December 10, 2021

ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণগুলি আলোচনা করো। 


ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ। 


ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুইয়ের আমল থেকে ফ্রান্সের বুকে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয় তা ফরাসি বিপ্লবের জন্য অনেকটাই দায়ী ছিল। মূলতঃ অষ্টাদশ শতকের শেষের দিক থেকে ফ্রান্সের রাজকোষ অর্থশূন্য হয়ে পড়ে। বিভিন্ন প্রকার ত্রুটিপূর্ণ কর ব্যবস্থা , রাজপরিবারের বিলাসব্যসন , মুদ্রাস্ফীতি - প্রভৃতি ফ্রান্সে আর্থিক বিপর্যয় ডেকে আনে। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ ফ্রান্সের এই সময়কার অর্থনীতি প্রসঙ্গে বলেছেন—ফ্রান্স ছিল ভ্রান্ত অর্থনীতির এক বিশাল জাদুঘর (“France was a vast museum of economic errors) । ফরাসি বিপ্লবের বিভিন্ন অর্থনৈতিক কারণগুলি ছিল - 


১. কর আরােপে বৈষম্য :-
সেসময়ে ফরাসিবাসীর ওপর সমানভাবে কর বণ্টিত হয়নি। ফ্রান্সের প্রথম শ্রেণিভুক্ত ধর্মযাজক এবং দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত অভিজাতদের কর দেওয়ার সামর্থ্য থাকলেও তাদের কর প্রদানের হাত থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছিল। ফ্রান্সে তৃতীয় সম্প্রদায়কে শতকরা ৯৬ ভাগ রাজস্ব দিতে হত, আর বাকি ৪ ভাগ রাজস্ব দিতে হত প্রথম ও দ্বিতীয় সম্প্রদায়কে। সমস্ত কর দেওয়ার পর তাদের হাতে থাকত মােট আয়ের এক-পঞ্চমাংশ, যা দিয়ে তাদের পক্ষে জীবনধারণ করা অসম্ভব ছিল। কার্লাইল-এর মতে—এক-তৃতীয়াংশ কৃষক বছরের তিন ভাগের একভাগ সময় শুধুমাত্র আলু খেয়ে জীবনধারণ করত। তৃতীয় সম্প্রদায়ের মানুষ এই বিশাল করের বােঝা থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল।

২. কর আদায়ে নিপীড়ন ও নির্যাতন :-
ফরাসিবাসীর ওপর বিভিন্ন করের বােঝা চাপানাে হয়েছিল যেগলি ছিল ত্রুটিপূর্ণ। যেমন—ক্যাপিটেশন (উৎপাদনকর), টেইল (ভূমিকর), গ্যাবেলা (লবণ কর), ভিটিংয়েমে (আয়কর), টাইদ (ধর্ম কর), এডস (মদ, তামাকের ওপর কর), করভি (শ্রম কর)। এ ছাড়াও সামন্তপ্রভুকে দিতে হত ত্যারাজ, সস, শপার , বানালিতে - ইত্যাদি কর। এইসব কর ফরাসিবাসীর কাছ থেকে জোরজবরদস্তি করে আদায় করা হত। এককালীন কিছু অর্থের বিনিময়ে নিযুক্ত ব্যক্তিদের কর সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হত। তারা অতিরিক্ত মুনাফার লােভে কর সংগ্রহের নামে নিপীড়ন ও নির্যাতন চালাত, এতে ফরাসিবাসী ক্ষুদ্ধ হয়।


৩. রাজপরিবারের বিলাসব্যসন :- 
চতুর্দশ লুই-এর আমল থেকেই ফরাসি রাজপরিবারের বিলাসব্যসন রূপকথায় পরিণত হয়। রমণীরঞ্জন প্রজাপতি রাজা পঞদশ লুই বিলাসিতায় ডুবে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে অর্থ নষ্ট করেন। ঐতিহাসিক গুডউইনের লেখা থেকে জানা যায় রানি মেরি আঁতােয়ানেতের ভৃত্যের সংখ্যা ছিল ৫০০। আর ভার্সাই রাজপ্রাসাদে কাজের জন্য নিয়ােজিত ছিল ১৬ হাজার কর্মচারী। রাজপরিবারের সদস্যরা নিত্যনতুন পােশাক পরিধান করতেন এবং ভােজসভায় প্রচুর খাদ্য নষ্ট করে অর্থের অপচয় ঘটাতেন। আসলে রাজকৰ্তব্য ভুলে বিলাসিতায় মত্ত হয়ে থাকা রাজাদের অপদার্থতাই অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়। যার ফলে রাজা ও রাজ পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে প্রজাদের মনে বিরূপ ধারণা জন্মায়। রাজপরিবারের বিলাসিতা প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক গুডউইন তাঁর ‘French Revolution' গ্রন্থে লিখেছেন—বিপ্লবের প্রাক্কালে অর্থনৈতিক সমস্যার মূল কথা ছিল বিশাল খরচের বােঝা কমানোের অসম্ভাব্যতা ("The essence of the financial problem on the eve of the Revolution was the impossibility of reducing this heavy expenditure")

৪.  ভ্রান্ত যুদ্ধনীতি: -
চতুর্দশ লুই-এর আমল থেকেই ভ্রান্ত যুদ্ধনীতি ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছিল। বুরবোঁ রাজা চতুর্দশ লুই পশ্চিম ইউরােপে প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারের লক্ষ্যে বারবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন এবং রাজকোশকে শূন্য করেছেন। পরবর্তী রাজা পঞ্চদশ লুই-এর আমলেও অকারণ যুদ্ধনীতি প্রচুর অর্থ নষ্ট করে। ষােড়শ লুই আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে উপনিবেশবাসীদের অর্থ সাহায্য করলে ফ্রান্স দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এই অর্থনৈতিক সংকটমােচনের লক্ষ্যে সরকার বাধ্য হয়ে ঋণ নেয়। যুদ্ধের জন্য অন্যান্য খাতে খরচের যে ঘাটতি দেখা দেয় তা মেটানাের লক্ষ্যে ২০০ কোটি লিভ্র ঋণ নিতে হয় (১৭৮৯ খ্রি.)। এর আগের বছর ফরাসি সরকার ঋণের সুদ বাবদ ৩১ কোটি ৮০ লক্ষ লিভ্র অর্থ খরচ করে। এসময়ে ফ্রান্সের মােট আয়ের শতকরা ৭৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা ও সুদ বাবদ সরকারকে খরচ করতে হত। যুদ্ধ ব্যয় সম্পর্কে রাজা যােড়শ লুই-এর অর্থমন্ত্রী টুর্গো বলেছিলেন—আর-একটি কামান দাগা হলেই রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে যাবে।


৫. মুদ্রাস্ফীতি : - 
ফ্রান্সের অর্থনীতিকে শােচনীয় করার ক্ষেত্রে মুদ্রাস্ফীতিরও ভূমিকা ছিল। উত্তরােত্তর মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধির জন্যই নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র ও খাদ্যশস্যের দাম অত্যন্ত বেড়ে যায়। জিনিসপত্রের দাম শতকরা ৬৫ ভাগ বাড়লেও সেই অনুপাতে শ্রমিক বা মজুরদের বেতন বা মজুরি বাড়েনি। ফরাসি বিপ্লবের সূচনার এক যুগ আগে থেকেই প্যারিস, লায়নস শহরে রুটির জন্য দাঙ্গা বেধেছিল। ষােড়শ লুই ফরাসিবাসীর খাদ্য সমস্য মেটাতে ব্যর্থ হওয়ায় বহু মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসে। আসলে রাজস্ব মূল্যমানের ওঠানামা ১৮ শতকের ফ্রান্সে অর্থনীতির একটি মূল বৈশিষ্ট্য ছিল। এই মুদ্রাস্ফীতিতে জর্জরিত হয়ে ফরাসিবাসী বিপ্লবের রাস্তায় যায়।।

 ৬. অনুন্নত কৃষি অর্থনীতি :- 
ফ্রান্সে কৃষি ছিল অর্থনীতির মূল ভিত্তি। এখানকার শতকরা ৮০ ভাগ লােক কৃষক হলেও কৃষিব্যবস্থা অনুন্নত ছিল। অনাবাদী জমিতে কৃষিজ ফসল উৎপাদিত হওয়ায় একর প্রতি উৎপাদন বাড়েনি। সরকারি তরফে কৃষি ব্যবস্থার উন্নতির জন্য সেরকম কোনাে প্রয়াসও লক্ষ করা যায়নি। কৃষকদের রক্ষণশীল মনােভাব এবং বিভিন্ন কৃষিজ উপকরণও যন্ত্রপাতির অভাবে ফ্রান্সের কৃষি ব্যবস্থা উন্নত হতে পারেনি। এইরকম কৃষিজ কাঠামােয় অষ্টাদশ শতকের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়লে কৃষকদের অবস্থা শােচনীয় হয়ে পড়ে। তাই ঐতিহাসিক সি. ই. লাব্রজ বলেছেন—অষ্টাদশ শতাব্দীতে মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষকরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

উপসংহার :-
ফরাসি বিপ্লবের কারণগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক কারণ ছিল অন্যতম। মূলত ১৭৩০ থেকে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ফ্রান্সের যে আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটেছিল, পরবর্তী দশ বছরের মধ্যেই তা অবক্ষয়ের পথে চলে যায়। আর্থিক শােষণে জর্জরিত ফরাসিবাসী সহজ সরল স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য বিপ্লবের রাস্তায় গিয়েছিল। অবশেষে রাজা ষােড়শ লুই রাষ্ট্রের তীব্র অর্থসংকট মেটানাের লক্ষ্যে স্টেটস জেনারেল বা জাতীয় মহাসভার অধিবেশন ডাকলে বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। ফরাসি বিপ্লবের জন্য অর্থনৈতিক কারণকে দায়ী করে ঐতিহাসিক রাইকার বলেছেন—বিপ্লবের মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক ("The fiscal causes lay at the root of the Revolution")



You May Also Like

0 comments