Mansabdari System and it's features . মনসবদারি ব্যবস্থা কী? মােগল আমলে এই প্রথা প্রবর্তনের উদ্দেশ্য, বৈশিষ্ট্য ও তার মূল্যায়ন

by - December 09, 2021

Mansabdari System and it's features .

মনসবদারি ব্যবস্থা কী? মােগল আমলে এই প্রথা প্রবর্তনের উদ্দেশ্য, বৈশিষ্ট্য ও তার মূল্যায়ন করাে।




সূচনা : মােগল সম্রাট আকবর তার শাসনকালে যেসকল শাসনতান্ত্রিক পরীক্ষানিরীক্ষা করেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল মনসবদারি প্রথার প্রচলন। এই প্রথা ছিল একটি পারসিক প্রথা। আকবর সাম্রাজ্যের সামরিক ও বেসামরিক কাজকর্মের ভিত্তি হিসেবে ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে মনসবদারি প্রথা চালু করেন। মনসব’ কথাটির অর্থ হল ‘পদমর্যাদা’ বা ‘Rank'। এই পদমর্যাদার অধিকারী ব্যক্তিরা মনসবদার’ নামে পরিচিত ছিলেন।


মনসবদারি প্রথা প্রবর্তনের উদ্দেশ্য : 


ভারতবর্ষে সম্রাট আকবর প্রবর্তিত মনসবদারি ব্যবস্থা যেমন জটিল ছিল তেমনি ছিল অভিনব। তবুও আকবর মূলত কয়েকটি কারণে এই প্রথা প্রবর্তন করেন। যেমন : -
১. আকবর সামরিক ও বেসামরিক সরকারি কর্মচারীদের সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে মনসবদারি প্রথার প্রবর্তন করেন। 
২. মােগল সম্রাট বাবর ও হুমায়ুনের সময়ে মােগল সেনাবাহিনীতে বিদেশি সৈনিকদের প্রাধান্য ছিল। বিভিন্ন গােষ্ঠীতে বিভক্ত এই সেনাদের বেতনের পরিবর্তে জায়গির প্রদান করা হত। বিনিময়ে জায়গিরদারদের নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্য সৈন্য রাখতে হত ও যুদ্ধের সময় সম্রাটকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে হত। কিন্তু তারা তা না-করায় মােগল সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা প্রকট হয়। ফলে আকবর এক নতুন প্রথা প্রবর্তনের প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেন। 
৩. জায়গিরদারি প্রথার ব্যাপক প্রসারের ফলে সম্রাটের ‘খালিসা’ জমির পরিমাণ কমে গিয়ে সরকারি আয় কমে যায়। 
৪. মােগল আমলের প্রথমদিকে জায়গিরদারি প্রথা বংশানুক্রমিক হয়ে গেলে নিজ নিজ এলাকায় জায়গিরদারদের ক্ষমতা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। কখনাে-কখনাে তারা সম্রাটের বিরুদ্ধেই ক্ষমতা প্রদর্শন করতেন। এইসব কারণে আকবর জায়গিরদারি প্রথার অবসান ঘটিয়ে মনসবদারি প্রথা চালু করেন।


মনসবদারি প্রথার বৈশিষ্ট্য : 


মােগল সম্রাট আকবর প্রবর্তিত মনসবদারি ব্যবস্থার বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন : -

[১]জাট ও সওয়ার : জাট’ ও ‘সওয়ার’ বলতে কী বােঝায় তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক থাকলেও এ কথা ঠিক যে প্রত্যেক মনসবদারকে ‘জাট’ ও ‘সওয়ার’ বাহিনী রাখতে হত। মােটামুটি ধরে নেওয়া হয় ‘জাট’ ছিল পদাতিক বাহিনী এবং ‘সওয়ার’ ছিল অশ্বারােহী বাহিনীর সূচক। প্রতিটি মনসবদার তার পদমর্যাদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সংখ্যক পদাতিক ও অশ্বারােহী সৈন্য রাখতেন এবং সম্রাটের সামরিক প্রয়ােজনে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতেন।

[২]বিভিন্ন স্তর : আকবর মনসবদারদের সৈন্য ও অশ্ব সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে সমগ্র ব্যবস্থাটিকে ৩৩টি স্তরে বিভক্ত করেন। সর্বনিম্ন ১০ জন থেকে সর্বোচ্চ ১২,০০০ সৈন্য পােষণের অধিকারী ছিলেন মনসবরা। তবে ৫০০-র ওপরে পদমর্যাদার অধিকারীদেরই মনসবদার বলা হত। ৫০-২৫০০ পর্যন্ত পদমর্যাদাভুক্ত মনসবদাররা ‘আমির’ এবং ২৫০০-৫০০০ পদমর্যাদাভুক্ত ‘আমির-ই-আজম' নামে পরিচিত ছিলেন। সাধারণত, ৫০০০-১০০০০ পর্যন্ত উচ্চ মনসবদারের দায়িত্ব পেতেন সম্রাটের নিকটাত্মীয় ও বিশ্বসভাজন ব্যক্তিরা।

[৩] নিয়ােগ, অপসারণ ও বেতন : মনসবদারদের নিয়ােগ, পদোন্নতি, বদলি, অপসারণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে সম্রাটের ইচ্ছাই ছিল শেষ কথা। যেমন : 
ক) মনসবদারি পদ বংশানুক্রমিকভাবে বা উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করা যেত না। এর জন্য প্রয়ােজন ছিল কর্মদক্ষতার। ফলে বিভিন্ন জাতিগােষ্ঠীর মানুষ মনসবদারি পদ পেতে পারত।
(খ) কোনাে কোনাে মনসবদারদের নগদে কোশাগার থেকে বেতন দেওয়া হত। তাদের বলা হত মনসবদার-ই-নগদি। আবার অনেক মনসবদারদের নগদ বেতনের পরিবর্তে জায়গির বা জমি দেওয়া হত। তাদের বলা হত জায়গিরদার। ওই বেতন থেকে মনসবদারকে তার সেনাদলের বেতন হাতি ও ঘােড়া ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়ভার বহন করতে হত। 
গ) জায়গিরদারদের জমির ওপর কোনাে স্থায়ী অধিকার ছিল না । সম্রাট দু-চার বছর পর পর তাদের নিয়মিত বদলি করে দিতেন। 
ঘ) সম্রাট ইচ্ছা করলে যে-কোনাে সময় যে-কোনাে মনসবদারকে পদচ্যুত করতে পারতেন।

[৪] দাগ ও হুলিয়া প্রথার প্রবর্তন : আকবর মনসবদারি প্রথার মধ্যে আলাউদ্দিন খলজি প্রবর্তিত ‘দাগ’ ও ‘হুলিয়া’-প্রথা পুনঃপ্রবর্তন করে সেনাবাহিনীতে দক্ষ সেনা ও ঘােড়া রাখার ব্যবস্থা করেন। যেসকল মনসবদার বেশিসংখ্যক সওয়ার রাখতেন তাদের পুরস্কৃত করা হত।

[৫]দু-আসপা ’ ও ‘শি-আসপা ’-প্রথার প্রর্বতন: সম্রাট জাহাঙ্গির মনসবদারদের ঘােড়সওয়ার সেনাদের ভরণ-পােষণের জন্য অর্থ বরাদ্দ হ্রাস করেন। এ ছাড়া তিনি দু-আসপা ’ (দুই ঘােড়ার সওয়ারি) এবং ‘শি-আসপা ’ (তিন ঘােড়ার সওয়ারি)-প্রথা চালু করেন।


মূল্যায়ন ও সীমাবদ্ধতা : 

আকবর শুভ উদ্যোগ নিয়ে মনসবদারি ব্যবস্থার প্রবর্তন করলেও এই ব্যবস্থা অনেকাংশেই ত্রুটিপূর্ণ ছিল। যেমন : - 
১) মনসবদারদের একইসঙ্গে প্রশাসনিক ও সামরিক দায়িত্ব পালন করতে হত। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই এই দুটি দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হত না। 
(২) মনসবদারদের অধীন সেনাদের আনুগত্য ছিল মনসবদারদের প্রতি। মােগল বাদশাহের সঙ্গে তাদের কোনাে সংযােগ না থাকায় জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠেনি। 
(৩) মনসবদারি ব্যবস্থায় সৈন্যদের ওপর কোনাে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সৈন্যবাহিনীর মধ্যে কোনাে সংহতি ও ঐক্য গড়ে তােলা সম্ভব হয়নি। এর ফলে এক-একজন মনসবদারের অধীনস্থ সৈন্যবাহিনীর দক্ষতায় তারতম্য দেখা দেয়।
৪) মনসবদারি ব্যবস্থার দুর্বলতার অন্যতম কারণ ছিল মনসবদারদের দুর্নীতি। বদাউনির রচনা থেকে জানা যায় যে, মনসবদারদের যত ঘােড়া ও সেনা রাখার কথা তারা তা রাখতেন না। আকবর এই দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য দাগ ও হুলিয়া’ প্রথা চালু করলেও সম্পূর্ণ দুর্নীতি দূর করতে পারেননি। 
৫) সম্রাটের ব্যক্তিত্বের ওপর এই প্রথার সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করত। তাই আকবরের পরবর্তী অযােগ্য শাসকদের আমলে এই প্রথায় ভাঙন ধরে। 
তাই অধ্যাপক কুরেশি, অরভিন প্রমুখ মােগল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য এই মনসবদারি প্রথাকে তাই অনেকাংশে দায়ী করে থাকেন।

মনসবদারি প্রথার গুরুত্ব বা অবদান :-


মনসবদারি ব্যবস্থায় দোষত্রুটি থাকলেও এই প্রথাকে মােগল যুগে সবচেয়ে কার্যকর ও সফল প্রথা বলা  যায়। কারণ :
(১) মনসবদারি প্রথার মাধ্যমে সামরিক, প্রশাসনিক ও অভিজাততন্ত্রের সমন্বয়সাধন করা সহজ হয়। এরই ফলশ্রুতিতে মােগল সাম্রাজ্য দীর্ঘ ২০০ বছরের অধিক সময় ভারতে স্থায়ী হয়েছিল।
(২) আকবর ও তার পরবর্তী মােগল সম্রাটগণ মনসবদারি প্রথার মাধ্যমে এক বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। 
৩) মনসবদার পদলাভের ক্ষেত্রে যােগ্যতা একমাত্র মাপকাঠি হওয়ায় মােগল শাসকদের পক্ষে একটি শক্তিশালী অথচ সুবিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তােলা সম্ভব হয়েছিল। 
৪) মনসবদারি পদ বংশানুক্রমিক না-হওয়ায় মােগল যুগে সামন্তপ্রথার উদ্ভব ঘটেনি। 
৫) জাতিভিত্তিক মনসবদারি প্রথা চালু হওয়ায় ঐক্যবদ্ধভাবে বিভিন্ন জাতি-কর্তৃক সম্রাটের বিরােধিতার পথ বন্ধ হয়। এই প্রথার দ্বারা বিদেশি অভিজাতদের আধিপত্যও নষ্ট হয়। 

সুতরাং, বলা যায় আকবর প্রবর্তিত মনসবদারি ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ নতুনভাবে উপস্থাপিত পুরােনাে একটি প্রথা। মােগল সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তি ও স্থায়িত্ব অনেকাংশেই নির্ভরশীল ছিল মনসবদারি প্রথার ওপরে।


You May Also Like

0 comments