বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠন : সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট।
বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠন কাকে বলে ? বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনের বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর।
বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনের বৈশিষ্ট।
বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠন :-
বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনের ধারণার আত্মপ্রকাশ ঘটে ম্যাক্স ওয়েবারের সমাজ - দর্শনের সূত্র ধরে। যেসকল সামাজিক সংগঠন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে কৃত্রিমভাবে তৈরী হয় তাদের বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠন বলে। বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠন সর্বদা পূর্বপরিকল্পনাভিত্তিক। বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনগুলিতে সাধারণ উদ্দেশ্যের পরিবর্তে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই জাতীয় সংগঠনের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক হল গৌণ অর্থাৎ বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আবর্তিত হয় শুধুমাত্র উদ্দেশ্য ও চাহিদার ভিত্তিতে।
বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনের বৈশিষ্ট :-
১. উৎপত্তিগতভাবে কৃত্রিম :-
প্রতিটি বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠন মানুষের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বা প্রয়োজন পূরণের তাগিদে কৃত্রিমভাবে জন্ম নেয়। মানুষ সচেতনভাবে বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনগুলির জন্ম দেয়। মানব সমাজের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত এমন একটিও বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনের উদাহরণ পাওয়া যাবেনা যার উৎপত্তি কৃত্রিমভাবে হয়নি।
২. পূর্বপরিকল্পিত :-
প্রতিটি বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠন মানুষের পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে জন্ম গ্রহণ করে। মানুষ তার নিজের এবং সমাজের প্রয়োজন পূরণের জন্য নির্দিষ্ট সামাজিক সংগঠনের তাগিদ অনুভব করে। তারপর সম্পূর্ণ একটি নতুন বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনের জন্ম দেয় পূর্বপরিকল্পনার ভিত্তিতে।
৩. সদস্যপদ :-
প্রতিটি বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনের সদস্যপদ ঐচ্ছিক ; অর্থাৎ সদস্যপদ গ্রহণ করা বা না করা সম্পূর্ণ ব্যক্তির ইচ্ছাধীন হয়ে থাকে। ব্যক্তি তার প্রয়োজন এবং চাহিদা অনুসারে এক বা একাধিক বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনের সদস্যপদ গ্রহণ করে। তাছাড়া , সদস্যপদ বর্জন করাটাও ব্যক্তির ইচ্ছাধীন। অন্যদিকে বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনগুলিও তার সদস্যদের সদস্যপদ বাতিল করতে পারে।
৪. উদ্দেশ্য :-
বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনগুলি সাধারণ উদ্দেশ্যের পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে গঠিত হয়। যেমন , বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে , ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় মানুষকে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা প্রদানের জন্য। বিদ্যালয়ের পক্ষে মানুষকে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা দেওয়া সম্ভব নয় ; আবার , ব্যাঙ্কের পক্ষে শিক্ষা প্রসারের কাজ করা সম্ভব নয়। তাই প্রতিটি বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনের উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট।
৫. সাংগঠনিক দিক :-
প্রতিটি বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠন পরিচালনার জন্য একটি সংগঠনের প্রয়োজন হয়। বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনগুলি তার সংগঠনের মাধ্যমে তার সদস্যদের চাহিদা পূরণ করে এবং নিজ উদ্দেশ্য সফল করে। সংগঠনগুলি বিভিন্ন স্তরবিশিষ্ট হয় এবং প্রতিটি স্তরের নির্দিষ্ট ভূমিকা থাকে। বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনগুলির সফলতা নির্ভর করে সংগঠনের প্রতিটি অংশের নির্দিষ্ট ভূমিকা যথাযথভাবে পালনের উপর।
৬. কর্তৃত্ব :-
বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনগুলির প্রতিটি স্তরে নির্দিষ্ট কর্তৃত্বের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। নির্দিষ্ট কর্তৃত্ব তার নির্দিষ্ট দায়িত্বের জন্য দায়বদ্ধ থাকেন। নির্দিষ্ট কর্তৃত্ব তার নির্দিষ্ট দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করলে বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনগুলির উদ্দেশ্য সফল হতে পারেনা।
৭. পরিচালনার নিয়ম - নীতি :-
প্রতিটি বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠন পরিচালিত হয় নির্দিষ্ট নিয়ম - নীতির ভিত্তিতে। এই নিয়ম নীতি বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনগুলির কর্তৃত্ব তথা পরিচালক এবং সাধারণ সদস্য উভয়ের উপর প্রযুক্ত হয়। কোনো একপক্ষ যথাযথভাবে নিয়মবিধি পালন না করলে তাকে দায়িত্ব বা সদস্যপদ ত্যাগ করতে হয়। যেমন ব্যাঙ্ক , বিদ্যালয় - ইত্যাদি সংগঠনগুলি কঠোরভাবে নিজেস্ব নিয়ম নীতিকে অনুসরণ করে পরিচালিত হয়।
৮. সংগঠন ও সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক :-
বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনগুলির সঙ্গে তার সদস্যদের সম্পর্ক গৌণ প্রকৃতির। এক্ষেত্রে সম্পর্ক শুধুমাত্র কাজ , চাহিদা , কর্তব্য , উদ্দেশ্যপূরণ - ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। যেমন একজন ব্যাঙ্ক কর্মীর সঙ্গে একজন উপভোক্তার সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে গৌণ। এই জাতীয় সম্পর্ক হল চুক্তিনির্ভর ও পরোক্ষ প্রকৃতির।
৯. বাস্তব প্রয়োজন ভিত্তিক :-
প্রতিটি বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠন মানুষের বাস্তব প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে গঠিত হয়। প্রতিটি সমাজে মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদা বহুমুখী ; যেমন - শিক্ষা , চিকিৎসা , ব্যাঙ্কিং পরিষেবা , পৌর পরিষেবা , আইন - শৃঙ্খলা রক্ষা - ইত্যাদি। এই বহুমুখী চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যেই বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনগুলির জন্ম হয়। মানব সমাজে এমন একটিও বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠন পাওয়া যাবেনা যার সঙ্গে মানুষের বাস্তৱ প্রয়োজনের কোনো সম্পর্ক নেই।
১০. স্থায়িত্ব :-
বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনগুলির সময়কাল ও স্থায়িত্ব নির্ভর করে তার উদ্দেশ্য ও কার্যক্ষেত্রের উপর। যেসকল বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনগুলির প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন ধরে বলবৎ থাকে তাদের স্থায়িত্ব দীর্ঘ হয়। যেমন - শিক্ষা , চিকিৎসা , ব্যাঙ্কিং পরিষেবা , পৌর পরিষেবা , আইন - শৃঙ্খলা রক্ষা - ইত্যাদি বিষয়গুলির প্রয়োজনীয়তা সর্বদা বর্তমান ; তাই এই জাতীয় বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনগুলির স্থায়িত্ব দীর্ঘ হয়।