৫. হরপ্পা সভ্যতার আর্থ - সামাজিক অবস্থা পর্যালোচনা করো।

৫. হরপ্পা সভ্যতার আর্থ - সামাজিক অবস্থা পর্যালোচনা করো।

সিন্ধু লিপি পাঠোদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত হরপ্পা সংস্কৃতি সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন , সীলমোহর ইত্যাদি থেকে যা তথ্য পাওয়া যায় তার ভিত্তিতেই সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাস আলোচনা করতে হয়।



                                                             অর্থনৈতিক অবস্থা :-

কৃষি :-
আনুমানিক ২৩০০ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রগুলির বিকাশ ঘটে। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োতে প্রাপ্ত শস্যভান্ডারের নিদর্শন দেখে মনে করা হয় সিন্ধুবাসীরা মূলত কৃষিজীবী ছিল। হরপ্পা , মহেঞ্জোদাড়ো ও কালিবঙ্গানে গম ও যবের দানা পাওয়া গিয়েছে। উৎপাদিত খাদ্যশস্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল - গম , যব , নানা জাতীয় বাদাম , বার্লি - ইত্যাদি।
এছাড়াও লোথালের প্রত্নকেন্দ্র থেকে ধানের তুষ পাওয়াতে মনে করা হয় হরপ্পাবাসীরা ধান চাষ করতো। মহেঞ্জোদাড়োতে প্রত্নতত্ত্ববিদরা কার্পাস উৎপাদনের প্রমান পেয়েছেন। এছাড়াও তাম্রনির্মিত বড়শির আবিষ্কার প্রমান করে যে সিন্ধুবাসীদের মধ্যে মৎস্য আহরণ প্রচলিত ছিল।

পশুপালন -
কৃষিকার্যের সাথে পশুপালন ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। গৃহপালিত পশুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল - ষাঁড় , মহিষ , ছাগল , শুকর , ভেড়া , উট - প্রভৃতির নাম করা যেতে পারে। সীলমোহরে ষাঁড়ের ছবি থেকে প্রমাণিত হয় হরপ্পাবাসীদের মধ্যে ষাঁড়ের প্রচলন ছিল। জমি কর্ষণের কাজে ষাঁড় ও মহিষকে কাজে লাগানো হতো বলে মনে করা হয়।

শিল্প -
কৃষি ও পশুপালন ছাড়া এযুগের অর্থনীতির অপর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো শিল্প।সিন্ধুর কেন্দ্রগুলিতে বয়ন শিল্পের বহুল প্রচলন ছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োতে মাকু পাওয়া গিয়েছে। এযুগে তুলা ও পশমের বস্ত্র তৈরী হতো। এছাড়া মৃৎ শিল্পেও হরপ্পাবাসীরা অত্যন্ত দক্ষ ছিল। অত্যন্ত উন্নতমানের মৃৎপাত্র তৈরী হতো। প্রত্নকেন্দ্রগুলি থেকে প্রাপ্ত নর্তকী মূর্তি থেকে সেযুগের অলংকার সম্পর্কে ধারণা করা যায়। স্বর্ণ এই অঞ্চলে না পাওয়া গেলেও তা দক্ষিণ ভারত থেকে আমদানী করা হতো। স্বর্ণ ছাড়াও রুপা , তামা , পাথর ও মাটির অলংকারের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। এছাড়াও মহেঞ্জোদাড়োতে একটি ব্রোঞ্জ নির্মিত নর্তকীমূর্তি পাওয়া গিয়েছে যা থেকে প্রমাণিত হয় সিন্ধুবাসীরা ব্রোঞ্জ শিল্পেও উন্নত ছিল। এছাড়াও মাটির তৈরী নানা ধরণের পুতুল , খেলনা গাড়ি , দেব দেবীর মূর্তি - ইত্যাদি তৈরিতে সিন্ধুবাসীরা অত্যন্ত দক্ষ ছিল।



বাণিজ্য - 
স্থলপথে সিন্ধুবাসীরা বেলুচিস্তান , সুমেরীয় অঞ্চল ও দক্ষিণ ভারতের মহীশুর প্রভৃতি অঞ্চলে পণ্য নিয়ে যাতায়াত করতো। আবার বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানি করা হতো। যেমন - সৌরাষ্ট্র ও দক্ষিণাত্য থেকে শঙ্খ ও কয়েকটি বিশেষ পাথর ; হিমালয় থেকে দেবদারু কাঠ ; পারস্য ও রাজস্থান থেকে তামা ; পারস্য ও আফগানিস্তান থেকে রুপা ইত্যাদি।
 মহেঞ্জোদাড়োর সীলমোহর ইলাম ও মেসোপটেমিয়াতে পাওয়া গিয়েছে আবার তাদের সীলমোহর মহেঞ্জোদাড়োতে পাওয়া গিয়েছে। মেসোপটেমিয়ার সাথে মহেনজোদারোর বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল তুলাজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে। এছাড়াও ব্যাবিলনে সুতিবস্ত্র রপ্তানি করা হতো ও সুমের থেকে রুপা আমদানি করা হতো।

সামুদ্রিক তৎপরতা -
সিন্ধুর কতকগুলি সীলমোহরে মাছের প্রতিচ্ছবি পাওয়া গিয়েছে। আবার কিছু সীলমোহরে নোঙ্গররত নৌকার প্রতিচ্ছবিও পাওয়া গিয়েছে। গুজরাটের লোথালে একটি পোতাশ্রয়ের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। এটি দৈর্ঘে ৭১০ ফুট এবং প্রস্থে ১২০ ফুট। এটি হয়তো বৃহদাকার জাহাজ নোঙর করার জন্য ব্যবহার হতো। সমুদ্রপথে সিন্ধুবাসীরা পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির সাথে যথা - মিশর , সুমের , পারস্য , ক্রীট - ইত্যাদির সাথে বাণিজ্য চালাতো।
Dr. Mackey র মতে , সমুদ্র পথেই সিন্ধু উপত্যকার সঙ্গে সুমের , ইলাম , প্রভৃতি স্থানের যোগাযোগ ছিল।



                                                                   সমাজ জীবন :-

সিন্ধু উপত্যকায় সমাজ কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল - ১. ধনী পুরোহিত , ২. মধ্যবিত্ত , ৩. বণিক , ৪. কারিগর ও ৫. শ্রমিক। মিশর ও ব্যাবিলনের মত হরপ্পায় পুরোহিতরা ছিল সর্বাধিক প্রভাবশালী। ব্যসাম বলেছেন -  সুমের ও মিশরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তুলনায় হরপ্পার মধ্যবিত্তশ্রেণী ছিল অনেক বেশি এবং সমৃদ্ধ। শ্রমিক ও কারিগরদের অধিকাংশই ছিল পুরোহিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্রীতদাস। তবে সিন্ধুর শ্রমিক ও মজুরেরা উন্নত জীবন যাপন করতো। কেননা , রাজপথের দুধারে ছোট ছোট ইঁটের বাড়ি সারিবদ্ধ ভাবে দেখা গেছে। এগুলিতে শ্রমিক ও মজুরেরা বসবাস করতো।
শ্রেণী বিভক্ত সমাজ হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট।
ডি ডি কোসাম্বি বলেছেন , হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োতে আবিষ্কৃত বিভিন্ন ধরণের বাড়িগুলিই স্পষ্টত প্রমান করে যে , তৎকালীন সমাজে শ্রেণীবিভাজন প্রখর ছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োতে বৃহৎ অট্টালিকা থেকে শুরু করে দু - কামরা বিশিষ্ট  কুঁড়ে ঘরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
হরপ্পায় একটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা প্রাসাদের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। লম্বায় ১৫০ ফুট ও চওড়ায় ৫৬ ফুট এই প্রাসাদটিকে শস্যভাণ্ডার বলে মনে করা হয়। এছাড়াও মহেঞ্জোদাড়োতে শাসকগোষ্ঠীর সম্পদ সঞ্চয় করে রাখার উপযোগী একটি সুরক্ষিত অট্টালিকার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে।  শাসক গোষ্ঠী বিপুল সম্পদের  অধিকারী হওয়ায় সমাজে শ্রেণী বিভাজন দেখা গিয়েছিলো।

পৌর ব্যবস্থা :- নগর দুটির রাজপথের পরিকল্পনা , জল ও আবর্জনা নিষ্কাশন প্রণালী ইত্যাদি দেখে মনে হয় নগরদুটিতে উন্নত পৌর ব্যবস্থা ছিল এবং এর দৃষ্টান্তও ছিল অভাবনীয়। রোমানদের পূর্বে কোনো প্রাচীন সভ্যতায় সিন্ধু সভ্যতার পৌর সংস্থার মত উন্নত কোনো সংস্থা ছিল বলে প্রমান পাওয়া যায়নি।

রাজনৈতিক জীবন - প্রতিটি নগরের প্রতিরক্ষার আয়োজন হিসেবে সারিবদ্ধ দুর্গ ছিল ; তৃতীয় রাজধানী কালিবঙ্গানের দুর্গের অস্তিত্ব তা প্রমান করে। সিন্ধু উপত্যকার নগরগুলি ছিল প্রজাতান্ত্রিক। নগরগুলির শক্তি ও নিরাপত্তা নির্ভর করতো প্রশাসনিক দৃঢ়তা ও স্থায়িত্বের ওপর।
Piggot এর মতে , নগরদুটিতে কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
হুইলারের মতে , সিন্ধুবাসীরা বিশ্বাস করতো যে , পুরোহিতের মাধ্যমে হরপ্পার দেবতারা নগর শাসন করতেন।
S.K. Saraswati র মতে , নগরগুলিতে একই ধরণের শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল এবং এই প্রশাসন জনগণের জীবন যাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতো। 

        পরিশেষে বলা যায় যে , সিন্ধু সভ্যতা কিভাবে অতি প্রাচীন এক সময়ে এক উন্নত নাগরিক জীবনের সূচনা করেছিল তা আধুনিক বিশ্বের কাছে আজও বিস্ময়ের বিষয়। সমাজ জীবনে প্রতিটি  স্তরে পরিকল্পনার ছাপ ছিল স্পষ্ট। ভারতীয় সভ্যতার ঊষালগ্নে সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রগুলিতে যে আর্থ সামাজিক জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল তা ভারতীয় সভ্যতাকে প্রাচীনত্বের মাপকাঠিতে শ্রেষ্ঠত্বের আসন প্রদান করে।  


      

Share
Tweet
Pin
Share