২. প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় বিভিন্ন উপাদানগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো।
ভারতীয় সভ্যতা অতি প্রাচীন এবং ইতিহাস সমৃদ্ধ। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান দুভাবে বিভক্ত। প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক উপাদান। প্রাচীন ভারতে লিখিত ঐতিহাসিক গ্রন্থের অপ্রতুলতার কারণে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলি পথনির্দেশকের কাজ করে। এককথায় বলা যেতে পারে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস লিখিত ও প্রত্নতাত্ত্বিক উভয় প্রকার উপাদানের সমন্বয়ে রচিত।
প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলি হলো - (ক ) লিপি বা লেখমালা , (খ ) মুদ্রা , (গ ) স্থাপত্য ও ভাস্কর্য , (ঘ ) প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ।
লিখিত সাহিত্যিক উপাদানগুলি হলো - (ক ) দেশীয় সাহিত্য , (খ ) বৈদেশিক বিবরণ।


লিপি বা লেখমালা :-
প্রাচীন লিপির ঐতিহাসিক মূল্য প্রসঙ্গে স্মিথ বলেছেন - '' ঐতিহাসিক জ্ঞানের উপাদান হিসাবে প্রাচীন লিপিগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য। ''
ঐতিহাসিক ফ্লিট -এর মতে , মুদ্রা , ভাস্কর্য , স্থাপত্য , ঐতিহ্য ও সাহিত্য থেকে আমরা যে সকল বিবরণ পাই তার সত্যতা নির্ণয় করতে লিপিমালা যথেষ্ট সাহায্য করে।
লিপিগুলি থেকে প্রাচীন যুগের আর্থ -সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বহুল বিবরণ পাওয়া যায়। যেমন -
(i)হাতিগুমফা শিলালিপি থেকে কলিঙ্গরাজ খারবেল সম্পর্কে জানা যায়।
(ii)এলাহাবাদ স্তম্ভলিপি থেকে সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকাল ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের ইতিহাস জানা যায়।
(iii)সম্রাট অশোকের একাধিক শিলালিপি ও স্তম্ভলিপি থেকে অশোকের ধম্ম ও মৌর্য সাম্রাজ্যের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।
(iv)এশিয়া মাইনর-এ প্রাপ্ত ''বোঘাজ - কোয়'' শিলালিপি থেকে ভারত আগমনের পূর্বে আর্যদের বিস্তৃতি সম্পর্কে জানা যায়।
(v)নকশি রুস্তম - এ প্রাপ্ত লিপি থেকে ভারতের সাথে ইরানের রাজনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাস জানা যায়।
(vi)নাসিক প্রশস্তি থেকে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী সম্পর্কে জানা যায়।
(vii)রবিকীর্তির আইহোল প্রশস্তি দ্বিতীয় পুলকেশী সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে।
এছাড়াও আরো বহু লিপির অস্তিত্ব বর্তমান - যা প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় সহায়তা করে।
মুদ্রা :-
সাহিত্য ও লিপি থেকে যে সকল তথ্যাদি পাওয়া যায় তার সত্যতা জানতে সাহায্য করে মুদ্রা। সন তারিখ সম্বলিত মুদ্রাগুলি কাল নিরুপন করতে সাহায্য করে। মুদ্রা থেকে রাজাদের শাসন , আর্থ - সামাজিক অবস্থা , তাঁদের ধর্মবিশ্সাস সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়। শক , ব্যাকট্রিয় ও কুষাণদের ইতিহাস জানতে মুদ্রাই  একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপাদান। গুপ্ত রাজাদের মুদ্রা থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধির কথা জানা যায়।ব্যাকট্রিয় গ্রিক ও শকদের মুদ্রা থেকে ভারত ও রোমের সম্পর্কের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
মুদ্রায় অঙ্কিত ছবি থেকে সমকালীন যুগের ধর্মীয় ও সামাজিক ইতিহাস জানা যায়। মুদ্রার গঠনরীতি থেকে শিল্পকলা ও সৌন্দর্যের পরিচয় পাওয়া যায়। মুদ্রায় ব্যবহৃত ধাতু থেকে তৎকালীন সময়ের অর্থনৈতিক অবস্থা ও ধাতুবিদ্যার কথা জানা যায়।


স্থাপত্য ও ভাস্কর্য :-
রাজনৈতিক ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের গুরুত্ব অধিক না হলেও প্রাচী ভারতের ইতিহাস রচনায় এদের গুরুত্ব কম নয়। তক্ষশীলা ও সারনাথে প্রাপ্ত বহু স্তম্ভগুলি থেকে বৌদ্ধ ধর্ম , কুষাণ যুগ , গান্ধার শিল্প - ইত্যাদি সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়।  পশ্চিম বাংলার অজয় নদের তীরে পাণ্ডুরাজার ঢিপি ও চব্বিশ পরগনার বারাসাত - বসিরহাট অঞ্চলে চন্দ্র্রকেতুর গড় ইত্যাদি স্থাপত্য নিদর্শন প্রাচীন বাংলার ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তুর্কিস্থান ও বেলুচিস্তানের খননের দ্বারা ভারতের সাথে উক্ত অঞ্চল দুটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পরিচয় পাওয়া যায়। কম্বোজের আঙ্কোরভাট ও জাভার বরোবুদুরের মন্দির দুটি থেকে ভারতের ঔপনিবেশিক ও সাংস্কৃতিক বিস্তারের পরিচয় পাওয়া যায়।
প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ :-
প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ যেকোনো দেশের সভ্যতা - সংস্কৃতির ইতিহাস জানতে অপরিহার্য উপাদান। খনন কার্যের ফলে প্রাপ্ত প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ গুলি হলো একমাত্র বাস্তব ভিত্তিক উপাদান ; কেননা এই উপাদানগুলির মধ্যে কোনো কৃত্তিমতা থাকে না। ১৯২৪ সালে হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে বিশ্ববাসীর সামনে এক নতুন দিগন্ত খুলে যায়। এছাড়া মৌর্য আমলে নির্মিত কাষ্ঠ নির্মিত প্রাসাদ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান। বর্তমান বিহারের নিকট নালন্দা ও তক্ষশীলার ধ্বংসাবশেষ প্রাচীন ভারতের শিক্ষার ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সাম্প্রতিক কালে মেহেরগড় সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের সভ্যতার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে নতুন করে গবেষণা শুরু হয়েছে।
দেশীয় সাহিত্য :-
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে সাহিত্যিক উপাদানগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।  (i)ভারতীয় সাহিত্যের আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথমেই বেদ ও বৈদিক সাহিত্যের কথা উল্লেখ করতে হয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের আগের ইতিহাস জানতে আমাদের বহুলাংশে বৈদিক সাহিত্যের উপর নির্ভর করতে হয়। বৈদিক সাহিত্য ঋক , সাম , যজু , অথর্ব - এই চারটি বেদ ছাড়াও ব্রাহ্মণ , আরণ্যক সূত্র ও উপনিষদকে বোঝায়। 
এস এন প্রধান এর মতে , প্রাচীন ভারতের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে বৈদিক সাহিত্য যথেষ্ট কৃতিত্বের দাবিদার।
(ii)বৈদিক সাহিত্যের পর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশীয় সাহিত্য উপাদান হলো রামায়ণ ও মহাভারত। ম্যাকডোনালের মতে , রামায়ণ রচিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর পূর্বে এবং রাম রাবনের যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে আর্য ও অনার্যের সংঘর্ষের কাহিনী।রামায়ণ থেকে বোঝা যায় আর্য সভ্যতা দক্ষিণে সিংহল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। মহাভারত থেকে আর্যদের সভ্যতা ও রাজনৈতিক বিস্তারের কথা জানা যায়।
(iii) বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থসমূহ যথা - ত্রিপিটক , জাতক , দ্বীপবংশ ও মহাবংশ, দীর্ঘনিকায় , অঙ্গুরতরনিকায়   - ইত্যাদি থেকে সমকালীন ভারতের আর্থ -সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস জানা যায়। দ্বীপবংশ ও মহাবংশ থেকে সম্রাট অশোকের ও সিংহলের ইতিহাস জানা যায়।
(iv)জৈন সাহিত্য ভগবতীসূত্র খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ইতিহাস জানতে সহায়তা করে। ভদ্রবাহু রচিত জৈন -কল্পসূত্র থেকে মহাবীরের জীবন কাহিনী জানা যায়।
(v)স্মৃতিশাস্ত্রগুলির মধ্যে প্রধান হলো - মনুর স্মৃতি , নারদ স্মৃতি , বৃহস্পতি স্মৃতি - ইত্যাদি।
(vi) মৌর্য ও পরবর্তী মৌর্য যুগের বিভিন্ন সাহিত্যিক উপাদানগুলি ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
 কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র - যা সমকালীন ভারতের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে অন্যতম নির্ভরযোগ্য দলিল। এছাড়াও পাণিনির অস্টাধ্যায়ী , পতঞ্জলির মহাভাষ্য গ্রন্থদুটি থেকে বৈদিক যুগের পরবর্তী ইতিহাস , শুঙ্গ রাজবংশ , গ্রীক ও ব্যাকটিরিওদের মধ্য ভারত আক্রমণ সম্পর্কে জানা যায়।
(vii)সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেন রচিত এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে সমুদ্রগুপ্তের উত্তর ও দক্ষিণ ভারত অভিযান , তাঁর কবি প্রতিভা ও সঙ্গীত অনুরাগ সম্পর্কে জানা যায়।
(viii)ভাস ও কালিদাসের রচনা থেকে সমকালীন ভারতের সুস্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। কালিদাসের রঘুবংশম থেকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যজয়ের কথা জানা যায়।
(ix)এছাড়া  বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতা ও বাৎসায়নের কামসূত্র গ্রন্থদুটিও সমকালীন ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
(x)বাণভট্টের হর্ষচরিত থেকে হর্ষবর্ধনের জীবন ও রাজত্বকাল সম্পর্কে জানা যায়।
(xi)সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত থেকে পালদের বরেন্দ্রভূমি উদ্ধারের ইতিহাস জানা যায়। কলহনের রাজতরঙ্গিনী থেকে কাশ্মীরের ইতিহাস জানা যায়।
(xii)চার্চনামা গ্রন্থটি থেকে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের বিবরণ পাওয়া যায়।  ইত্যাদি।



বৈদেশিক সাহিত্য উপাদান :-
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় বৈদেশিক বিবরণী যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে বিদেশি ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রধানত গ্রিক , রোমান , চৈনিক ও মুসলিমদের রচিত বিবরণী প্রাচীন ভারত সম্পর্কে জানতে যথেষ্ট সহায়তা করে। যেমন -
(i) প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় একটি অপরিহার্য গ্রন্থ হলো '' পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রিয়ান সি ''। এই গ্রন্থের লেখকের নাম জানা যায় না ; তবে গ্রন্থটি ভারতের সামুদ্রিক বাণিজ্যের একটি নির্ভরযোগ্য উপাদান হিসেবে সমাদৃত।
(ii) মেগাস্থিনিস রচিত ইন্ডিকা গ্রন্থটি থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তথা মৌর্য সাম্রাজ্যের সমাজ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা জানার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান।
(iii) হিউয়েন সাঙ রচিত সি -ইউ -কি গ্রন্থটি হর্ষবর্ধন ও তৎকালীন ভারতের আর্থ -সামাজিক ব্যবস্থা জানার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উপাদান।
(iv) উত্তর ভারতের মুসলিম জয়ের কাহিনী জানার জন্য আরব পর্যটক আল মাসুদি এবং সুলেমানের রচনার ওপর বিশেষভাবে নির্ভর করতে হয়।
(v) আলবিরুনির '' তহকক-ই -হিন্দ '' নামক গ্রন্থটি মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে অমূল্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়।
(vi) টলেমির ভূগোল ও প্লিনির খনিজ ও অরণ্য সম্পদ সম্পর্কে বর্ণনা থেকেও বহু মূল্যবান উপাদান পাওয়া যায়।
(vii) চৈনিক ঐতিহাসিক সু -মা -কিয়েন রচিত '' ইতিহাস '' নামক গ্রন্থ থেকে ইতিহাস   
 রচনার বহু উপাদান পাওয়া যায়।
এছাড়াও  বৈদেশিক সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন - আরিয়ান , কার্টিয়াস , প্লুটার্ক , হাসান নিজামি , অল মাসুদি , ডিওনিওসাস , ডিওডোরাস - প্রমুখ।

পরিশেষে বলা যায় , ঐতিহাসিক দিক দিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলির গুরুত্ব সর্বাদিক। কিন্তু কিছু সীমাবদ্ধতা স্বত্তেও লিখিত বিবরণীগুলোর মূল্য অস্বীকার করা যায় না।     

Share
Tweet
Pin
Share