ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ কাকে বলে ? ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি দাও।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ :-
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি অন্যতম উপাদান। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে আধুনিক গণতন্ত্র রক্ষার অন্যতম শর্ত হিসাবে বিবেচিত করা হয়। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি হল - আইন , শাসন ও বিচার - সরকারের এই তিনটি মূল বিভাগের পূর্ণ স্বাতন্ত্রীকরণ। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসারে সরকারের মূল তিনটি বিভাগ আইন , শাসন ও বিচার স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এবং একটি বিভাগ অপর একটি বিভাগের কাজে কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করবে না।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রধান প্রবক্তা মন্টেস্কু। এছাড়াও ইংরেজ দার্শনিক ব্ল্যাকস্টোন কেও ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির একজন প্রবক্তা বলা যেতে পারে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় ১৭৪৮ সালে প্রকাশিত মন্টেস্কুর স্পিরিট অব দ্য লজ গ্রন্থে। মন্টেস্কু ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার্থে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের পক্ষে যুক্তি :-
১. মন্টেস্কুর অভিমত :-
মন্টেস্কুর মতে সরকারের তিনটি বিভাগের স্বেচ্ছাচারিতা রোধে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ একান্ত অপরিহার্য। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি স্বীকৃত হলে কোনো একটি বিভাগ অপর একটি বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। ফলে প্রতিটি বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। এছাড়া আইনগত ও প্রশাসনিক ক্ষমতা যদি একটি হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে তাহলে ক্ষমতার অপব্যবহার অবসম্ভাবী।
২. ম্যাসিডনের অভিমত :-
ম্যাসিডন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা। তাঁর মতে - আইন , শাসন ও বিচার - এই তিনটি বিভাগের ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ না করা হলে স্বৈরাচারের আত্মপ্রকাশ অনিবার্য। তাই ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার্থে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ একান্ত অপরিহার্য।
৩. ব্ল্যাকস্টোনের অভিমত :-
ইংরেজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্ল্যাকস্টোন Commentaries on the Laws of England গ্রন্থে ক্ষমতা স্বতন্ত্ৰীকরণের পক্ষে বলেছেন - ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ একদিকে সরকারের বিভাগগুলির স্বাধীনতা বজায় রাখে এবং অন্যদিকে সরকারের বিভাগগুলির কর্মকুশলতা বৃদ্ধি করে।
৪. স্বৈরাচার প্রতিরোধ :-
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসারে সরকারের বিভাগগুলি একে অপরের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারেনা এবং তিনটি বিভাগ স্বতন্ত্রভাবে নিজ নিজ স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারে। ফলে যেকোনো একটি বিভাগের পক্ষে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দূর হয় .
৫. দক্ষতা বৃদ্ধি :-
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসারে সরকারের তিনটি বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। ফলে একদিকে সরকারের বিভাগগুলি যেমন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে , অন্যদিকে বিভাগগুলির মধ্যে পরনির্ভরশীলতার মানসিকতা দূর হয়। এইভাবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির দ্বারা সরকারের তিনটি বিভাগের দক্ষতা ও কর্মকুশলতা বৃদ্ধি পায়।
৬. বিভাগীয় স্বতন্ত্রতা :-
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রতিটি বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলীকে স্বতন্ত্র রাখে , ফলে একটি বিভাগ অপর একটি বিভাগের কাজে কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করতে পারেনা। ফলে ক্ষমতা স্বাতন্ত্রীকরণ নীতি স্বীকৃত হলে - আইন , শাসন ও বিচার - এই তিনটি বিভাগের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।
ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণের বিপক্ষে যুক্তি :-
১. পূর্ণাঙ্গ স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভব নয় :-
আধুনিক জটিল শাসন ব্যবস্থায় পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ সম্ভব নয়। বর্তমানে বিভিন্ন রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারের বিভাগগুলি পরিচালিত হয় পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে। যেমন মার্কিন শাসনব্যবস্থায় পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি গৃহীত হলেও মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিচারপতিদের নিয়োগ করেন। আবার ভারতের মত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাষ্ট্রপতি একই সঙ্গে আইনবিভাগ ও শাসন বিভাগের সদস্য এবং তিনি হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ করেন। তাই পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বাস্তব প্রয়োগ কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
২. পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ সমীচীন নয় :-
সফলভাবে সরকারের বিভাগগুলি পরিচালনা করতে হলে দরকার বিভাগগুলির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা। তাই জন স্টুয়ার্ট মিল , ল্যাস্কি - প্রমুখেরা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের পূর্নাঙ্গ প্রয়োগের বিপক্ষে মতামত পোষণ করেছেন। তাঁদের মতে পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রযুক্ত হলে সরকারের বিভাগগুলির মধ্যে সহযোগিতার পরিবর্তে বৈরিতা তৈরী হবে।
৩. ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে উপযুক্ত নয় :-
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ফলে সরকারের তিনটি বিভাগ একে অপরের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারেনা। কেননা, আইনবিভাগ যদি জনস্বার্থ বিরোধী আইন প্রবর্তন করে তাহলে সেই আইন প্রতিরোধের ক্ষমতা কারো থাকেনা। আবার শাসন বিভাগ স্বৈরাচারী হয়ে উঠলেও তাকে প্রতিহত করার ক্ষমতা কারো থাকেনা। তাই ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ কোনোভাবেই ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হতে পারেনা।
৪. তিনটি বিভাগের ক্ষমতা বাস্তবে সমান নয় :-
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে আইনবিভাগকে অন্য দুটি বিভাগ থেকে অধিক শক্তিশালী বলে মনে করা হয়। কেননা , শাসন বিভাগকে আইননিকট দায়িত্বশীল থাকতে হয় আবার , বিচারবিভাগ আইনবিভাগের তৈরী আইন দ্বারা বিচারকার্য পরিচালনা করে। তাই ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসরণ করা হলেও গণতন্ত্র উপকৃত হয়না।
৫. জৈব মতবাদসম্মত নয় :-
ব্লুন্টসলি প্রমুখ জৈব মতবাদীরা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সমালোচনা করেছেন। জৈব মতবাদের প্রবক্তারা মনে করেন রাষ্ট্র ও জীবদেহ একই বৈশিষ্টপূর্ণ। জীবদেহ থেকে যেমন অঙ্গ - প্রত্যঙ্গগুলিকে বিচ্ছিন্ন করা যায়না তেমনিভাবে রাষ্ট্রের বিভাগগুলিকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা অলীক কল্পনামাত্র।
৬. মার্কসবাদীদের সমালোচনা :-
মার্কসবাদীরাও ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সমালোচনা করেছেন। মার্কসবাদীদের মতে রাষ্ট্র হল শ্রেণী শোষণের যন্ত্র। তাই এক্ষেত্রে সরকারের সবগুলি বিভাগই সুবিধাভোগী শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করতে সদা তৎপর থাকে। তাই প্রকৃত অর্থে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অনুসরণ অর্থহীন।