আকবরের রাজপুত নীতি ও তার ফলাফল ; Rajput Policy of Akbar and its impact.

by - December 26, 2021

Rajput Policy of Akbar and its impact. 

আকবরের রাজপুত নীতি আলোচনা কর। 

অথবা , আকবরের রাজপুত নীতি ও তার ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা কর।    

আকবরের রাজপুত নীতি :- 


১৫২৭ এ খানুয়ার যুদ্ধ থেকে শুরু করে ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে তালিকোটার যুদ্ধে পরাজিত হলেও সামরিক জাতি হিসেবে রাজপুতদের শক্তি ও ক্ষমতা কোনো অংশেই ধ্বংস হয়ে যায়নি। উত্তর ভারতে শাসক হিসেবে তাদের প্রতিপত্তি তখনও অক্ষুন্ন ছিল। মুসলিম শাসকদের মধ্যে আকবর সর্বপ্রথম সামরিক শক্তি হিসেবে রাজপুতদের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন ও মোগল প্রশাসনে তাঁদের নিযুক্ত করে উত্তর ভারত ও রাজপুতানা অঞ্চলকে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে প্রয়াসী হন। 


আকবর কর্তৃক রাজপুত নীতি গ্রহণের কারণ :-    

রাজপুতদের সম্পর্কে বিশেষ নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু কারণ ছিল। 
প্রথমতঃ - সামরিক দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ রাজপুত জাতির মোগল বিরোধিতা মোগল সাম্রাজ্যের পক্ষে মঙ্গলজনক হত না। 
দ্বিতীয়তঃ - মোগল দরবারে পুরোনো অভিজাতদের ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্রাটের পক্ষে প্রয়োজন ছিল। 
তৃতীয়তঃ - মোগল সেনাপতি ও সৈন্যবর্গের অনেকেই ছিল স্বার্থান্মেষী ও লোভী। সুযোগ পেলেই তারা সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সামিল হত। এই অবস্থায় রাজপুতদের মত সামরিক দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ জাতির সহযোগিতা আকবরের প্রয়োজন ছিল। 
চতুর্থতঃ - মোগল সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ও তার স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে রাজপুতদের সাহায্যগ্রহন একান্ত অপরিহার্য ছিল। 

রাজপুতনীতির দুটি প্রধান প্রায়োগিক দিক :- 
আকবরের রাজপুতনীতির প্রায়োগিক ক্ষেত্রে দুটি ধারা লক্ষ্য করা যায় - 
(A) মিত্রতার নীতি - (a) বৈবাহিক সম্পর্কের নীতি ও (b) রাজপুতদের উচ্চপদে নিয়োগ। 
(B) সংঘর্ষের নীতি। 


(A) (a) বৈবাহিক সম্পর্কের নীতি :- মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করতে আকবর রাজপুত পরিবারের বেশ কয়েকজন মহিলার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। 
(i) অম্বররাজ বিহারীমলের কন্যার সাথে বিবাহ করেন। 
(ii) ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি জয়পুরের ভগবান দাসের কন্যার সাথে নিজ পুত্র সেলিমের বিবাহ দেন। 
(iii) ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিকানীর রাজকন্যাকে বিবাহ করেন। 
আকবরের এই বিবাহ নীতির ফলে মোগল সাম্রাজ্য সুদৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। যে সকল পরিবারের সাথে আকবর বৈবাহিক মিত্রতা বন্ধনে আবদ্ধ হতেন সেই সকল রাজপুত বংশের সঙ্গে মোগলদের সকল প্রকার দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। আকবরের বৈবাহিক নীতি প্রসঙ্গে ডক্টর বেণীপ্রসাদ বলেছেন - '' It symbolised the dawn of a new era in Indian politics .   

(b) রাজপুতদের উচ্চপদে নিয়োগের নীতি :- বৈবাহিক মিত্রতা নীতি ছাড়াও রাজপুতদের উচ্চপদে নিয়োগের নীতি আকবরের কূটনৈতিক দূরদৃষ্টির পরিচয় দেয়। তিনি বহু রাজপুত নৃপতি ও অভিজাতদের মোগল প্রশাসনে বিভিন্ন উচ্চপদে নিয়োগ করেন। যেমন বিহারীমল ও তাঁর পুত্র ভগবান দাস এবং ভগবান দাসের পালিত পুত্র মানসিংহ - সকলকেই আকবর নিজ প্রশাসনে উচ্চপদের মনসবদারী প্রদান করেন। এছাড়াও রাজস্বসচিব পদে তিনি রাজা টোডরমলকে নিয়োগ করেন। অপর এক রাজপুত বীরবলকে নিজের সর্বক্ষণের সঙ্গী হিসেবে নিযুক্ত করেন।     

(B) সংঘর্ষের নীতি :- কিন্তু যেসকল নৃপতিরা আকবরের বশ্যতা স্বীকার করতে রাজি হন নি তাঁদের বিরুদ্ধে আকবর সংঘর্ষের নীতি অনুসরণ করেন। 
(i) গুজরাট বিজয়ের পথে চিতোর ছিল প্রধান অন্তরায়। দিল্লি ও আমেদাবাদের মধ্যে যোগযোগ ব্যবস্থার নিরাপত্তার জন্য চিতোর দখল প্রয়োজন ছিল। তাই আকবর ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে চিতোর আক্রমণ করেন। ১৫৬৮ তে চিতোর মোগল বাহিনী কর্তৃক অধিকৃত হয়। 
(ii) ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে আকবর রণথম্ভোর দখল করেন। 
(iii) এরপর কালিঞ্জরের বিরুদ্ধে মোগল অভিযান প্রেরিত হয়। 
(iv) ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে হলদিঘাটের যুদ্ধে রাণা প্রতাপকে পরাজিত করে আকবর মেবার অধিকার করেন। 

( C ) অন্যান্য ক্ষেত্রে রাজপুত তথা হিন্দুদের বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রদান :- 
বৈবাহিক মিত্রতার নীতি , রাজপুতদের উচ্চপদে নিয়োগের নীতি ও সংঘর্ষের নীতি ছাড়াও আকবর আরো বিভিন্নভাবে রাজপুত তথা হিন্দুদের বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রদান করে তাদেরকে মোগল রাজবংশের অনুগত মিত্রে পরিণত করেন। 
(i) ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে আকবর হিন্দুদের ওপর চাপানো জিজিয়া কর প্রত্যাহার করেন। 
(ii) তার আগে ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি হিন্দুদের উপর থেকে তীর্থকর তুলে নেন। 
(iii) মোগল প্রশাসনের সকল উচ্চপদগুলি তিনি হিন্দুদের জন্য উন্মুক্ত করেন। 
(iv) হিন্দুদের জন্য ব্রাহ্মণ বিচারক নিযুক্ত করেন। 
(v) হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক সমন্বয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি অনুবাদ বিভাগ স্থাপন করে হিন্দুদের গ্রন্থগুলি ফারসি ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা করেন। 
(vi) কোনো রাজপূত মোগল হারেমে কন্যা পাঠাতে বাধ্য থাকবেন না। 


আকবরের রাজপুত নীতির ফলাফল :- 


১. মোগল - রাজপুত দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে রাজনৈতিক সুস্থিরতা স্থাপিত হয়। 
২. রাজপুতদের সহায়তায় আকবর সমস্ত বিদেশি অভিজাত ও রাজন্যবর্গকে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছিলেন। 
৩. রাজপুতদের সাথে মিত্রতা স্থাপনের ফলে মোগল সামরিক বাহিনী শক্তিশালী হয়। 
৪. ভারতে হিন্দু - মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। 
৫. হিন্দু - মুসলিম সমন্বয়ে এক নতুন সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতার যুগের সূচনা হয়। 
৬. শুধুমাত্র সাম্রাজ্যের বিস্তার নয় , রাজপুতদের সাহায্যে আকবর মোগল প্রশাসনকেও সার্থকভাবে পরিচালিত করতে পেরেছিলেন। 
৭. আকবরের বদান্যতায় বহু রাজপুত রাজন্যবর্গ মোগল প্রশাসনের উচ্চপদ লাভ করে। 
৮. আকবরের রাজপুত নীতির সফলতা এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে পরবর্তীকালে ঔরঙ্গজেব রাজপুত মিত্রতার নীতি পরিত্যাগ করলে মোগল সাম্রাজ্যের পতন ঘনিয়ে আসে। 
৯. রাজপুত নীতির সফলতার ফলে আকবর ধর্মীয় ক্ষেত্রে এক নতুন উদারনৈতিক নীতি গ্রহণ করতে সমর্থ হন। 
১০. পরবর্তী রাজন্যবর্গের জন্য আকবর রাজতন্ত্রের এক মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন এবং আকবর হিন্দুস্থানের সম্রাটরূপে গৃহীত হন।         

পরিশেষে বলা যায় , আকবরের রাজপুত নীতি তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির পরিচয় দেয়। তাঁর এই রাজনৈতিক দক্ষতার ফলেই তিনি মোগল সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করেন। রাজপুতদের মত এক সংগ্রামশীল জাতিকে মোগল বংশের অনুগত মিত্রে পরিণত করে। এর ফলে আকবর রাজপুতদের সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক , সামাজিক , সাংস্কৃতিক , অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই এক সুদৃঢ় প্রশাসন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।   

      

You May Also Like

0 comments