মধ্যযুগে ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের কারণ :- Reasons for the emergence of feudalism in medieval Europe: -

by - December 24, 2021

Reasons for the emergence of feudalism in medieval Europe: -

মধ্যযুগে ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের কারণগুলি আলোচনা করো। 

মধ্যযুগে ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের কারণ :- 


মধ্যযুগের ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব কোনো তাৎক্ষণিক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। মূলত খ্রিস্টীয় নবম থেকে খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতক পর্যন্ত ছিল সামন্ততন্ত্রের সবচেয়ে সমৃদ্ধির সময়কাল। এজন্য এই সময়কালকে সামন্ততন্ত্রের ধ্রুপদী যুগ বলা হয়। সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক মার্ক ব্লখ উল্লেখ করেছেন - Feudalism was born in the midst of an infinitely troubled epoch , and in some measure it was the child of those troubles themselves . সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের বিভিন্ন কারণগুলি হল - 


১. রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অরাজকতা :- ক্যারোলিঞ্জিয় শাসনের অবসানের পর মধ্যযুগের ইউরোপে ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়। প্রশাসন , উৎপাদন , বন্টন সমস্ত ক্ষেত্রেই এক অভূতপূর্ব অরাজকতার দরুন রাষ্ট্রযন্ত্র দিশাহীনভাবে পরিচালিত হচ্ছিল। এই সকল রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করে একটি নতুন ধরণের প্রশাসনিক পরিকাঠামো গড়ে ওঠার প্রয়োজন ছিল। 

২. বৈদেশিক আক্রমণ :- নবম শতকের প্রথম দিকে ভাইকিং , স্যারাসেন , ম্যাগিয়া ইত্যাদি বর্বর জাতিগুলির আক্রমণে ইউরোপের সাধারণ জনজীবন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে জমির মালিকানা ও সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস পাল্টাতে থাকে। অত্যাবশ্যক রাষ্ট্রীয় কর্তব্য সম্পাদিত হতে থাকে বেসরকারিভাবে। মানুষের জীবন , সম্পত্তি ও নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। 

৩. বেনিফিশ প্রথা :- নবম শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপের সর্বত্র নিজেদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার তাগিদে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি বা নেতৃত্বের নিকট আত্মসমর্পণ করতে শুরু করে। এক্ষেত্রে আশ্রয়দাতা পরিণত হলেন প্রভু বা লর্ড পরিচয়ে। তারা আশ্রয়প্রার্থীদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা প্রদান করতেন এবং তার পরিবর্তে আশ্রয়প্রার্থীদের নিকট আনুগত্য গ্রহণ করতেন। এই প্রথা বেনিফিশ নামে পরিচিত ছিল। এটি ছিল সামন্ততন্ত্রের সূচনার প্রারম্ভিক স্তর। 


৪. কমিটেটাস প্রথা :- কমিটেটাস প্রথা মূলত প্রচলিত ছিল প্রাচীন জার্মানিতে। এই প্রথা অনুসারে , স্বাধীন যোদ্ধারা কোনো শক্তিশালী ও প্রভাবশালী রাজন্যবর্গ বা সামরিক নেতার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করত। এর পরিবর্তে সেই রাজন্যবর্গ বা সামরিক নেতা আনুগত্য প্রদর্শনকারী স্বাধীন যোদ্ধাদের নিরাপত্তা ও আশ্রয় প্রদান করতেন। এরপর নবম শতকে বিশৃঙ্খলার যুগে সারা ইউরোপে এই প্রথা অনুসৃত হতে থাকে। 

৫. আনুগত্য প্রদর্শনকারী ও পৃষ্ঠপোষক শ্রেণীর পারস্পরিক নির্ভরশীলতা :- নবম শতকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অরাজকতার সুযোগে ইউরোপীয় সমাজে অনুগত ও পৃষ্ঠপোষক শ্রেণির ধারণাটি ব্যপকভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আনুগত্য প্রদর্শনকারী শ্রেণি আশ্রয় ও নিরাপত্তার বিনিময়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতো। এই সামাজিক ধারণা ছিল সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার কাঠামোগত ভিত্তি। 

৬. অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ভাঙন :- নবম শতক থেকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে পশ্চিম ইউরোপ সহ প্রায় পুরো ইউরোপ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পরে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পরে। ফলে এই সময় থেকে স্থানীয় স্তরে গ্রাম ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরকে কেন্দ্র করে ইউরোপের অর্থনীতি পরিচালিত হতে থাকে। সামন্ততন্ত্রে মূলতঃ এই অর্থনৈতিক কাঠামোকেই অনুসরণ করা হয়। 


৭. আঞ্চলিক শক্তির উত্থান :- রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে কেন্দ্রীয় শক্তি দুর্বল হতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় শক্তির এই দুর্বলতার সুযোগে স্বাভাবিকভাবেই আঞ্চলিক শক্তিগুলির দ্রুত উত্থান ঘটতে থাকে। এই আঞ্চলিক শক্তিগুলি নিজ নিজ এলাকায় স্বাধীন কৃষিনির্ভর অর্থনীতির সূচনা করে।  

৮. বাণিজ্য ক্ষেত্রে অবনতি :- নবম শতকের সময়কাল থেকে বিদেশি জাতির আক্রমণ , কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতা - ইত্যাদি কারণে ইউরোপীয় বাণিজ্য ক্ষেত্রে চরম অবনতি ঘটতে থাকে। ফলে জমির ওপর নির্ভরশীলতা ছাড়া অন্য কোনো পথ ছিল না। মানুষ অনিশ্চিত ব্যবসা বাণিজ্য ছেড়ে দিয়ে স্থানীয় প্রভুর অধীনে কৃষিভিত্তিক আর্থিক কাঠামো গড়ে তোলে। 

৯. মুসলিম আক্রমণ :- নবম শতকে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় শক্তিগুলির দুর্বলতার সুযোগে বারংবার বিদেশি আক্রমণ ঘটতে থাকে। কিন্তু মুসলিম আক্রমণ ইউরোপীয়দের কাছে ছিল আতঙ্কের বিষয়। তাই মানুষ স্থানীয় স্তরে শক্তিশালী প্রভুর নিকট স্মরণাগত হতে থাকে। এইভাবে আঞ্চলিক স্তরে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ভিত্তিতে একটি নতুন গ্রামীণ , কৃষিপ্রধান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সূচনা ঘটে - যা সামন্ততন্ত্র নামে পরিচিত।    

  

You May Also Like

0 comments