শিবাজীর শাসনব্যবস্থা :- Administrative system of Shivaji.

by - December 24, 2021

 Administrative system of Shivaji. 

শিবাজীর শাসন-ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো। 

শিবাজীর শাসন-ব্যবস্থার সমালোচনাসহ মূল্যায়ন করো।   

শিবাজীর শাসনব্যবস্থা :- 


মারাঠা জাতিকে একসূত্রে আবদ্ধ করা এবং মোগলদের বিরুদ্ধে সফলতার একটি অন্যতম কারণ ছিল শিবাজীর একটি সুগঠিত শাসন - ব্যবস্থা। শিবাজী যদিও স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রবর্তন করেছিলেন , তথাপি তাঁর রাজদর্শের মূল ভিত্তি ছিল প্রজাকল্যান। যদিও ভিনসেন্ট স্মিথ মারাঠা রাজ্যকে '' দস্যুরাষ্ট্র '' বলে অভিহিত করেছেন , কিন্তু রোলিনসন শিবাজীকে একজন দক্ষ যোদ্ধা ,একজন সুদক্ষ প্রশাসক বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি শিবাজীকে নেপোলিয়নের সাথে তুলনা করেছেন। 


১. অষ্টপ্রধান :- শিবাজী তাঁর শাসনকার্যে সহায়ক হিসাবে আটজন মন্ত্রীকে নিযুক্ত করেছিল। এঁদের অষ্টপ্রধান বলা হত। 
(i) পেশোয়া বা প্রধানমন্ত্রী 
(ii) অমাত্য বা আয় - ব্যয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। 
(iii) সামন্ত বা পররাষ্ট্র বা যুদ্ধ সংক্রান্ত মন্ত্রী। 
(iv) সেনাপতি বা সামরিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত। 
(v) ওয়াকে নভিস - অভিলেখ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত। 
(vi) সচিব - সরকারি পত্র বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। 
(vii) ন্যায়াধীশ বা প্রধান বিচারপতি। 
(viii) পন্ডিতরাও - ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী। 

২. প্রাদেশিক শাসন :- শিবাজী তাঁর সাম্রাজ্যকে তিনটি প্রদেশে বিভক্ত করেন। এই প্রদেশগুলিকে বলা হত '' প্রান্ত ''। প্রান্তের শাসনকর্তা ছিলেন '' মামলাতদার ''। প্রতিটি প্রান্ত কয়েকটি পরগণায় বিভক্ত ছিল। এগুলিকে বলা হত '' তরফ ''। পরগণার শাসনকর্তা ছিলেন কারনুন। প্রতিটি পরগণা অনেকগুলি গ্রামে বিভক্ত ছিল। গ্রামের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন গ্রাম পঞ্চায়েৎ। এছাড়া দেশপান্ডে নামক এক শ্রেণির কর্মচারী থাকতেন যাঁরা গ্রামের শাসনকার্য পরিদর্শন করতেন। 


৩. বিচার - ব্যবস্থা :- মারাঠা রাজ্যের বিচার ব্যবস্থা ছিল অনুন্নত ও তা যুগোপযোগী ছিল না। মারাঠারাজ্যে স্থায়ী বিচারালয় ছিল অনুপস্থিত। কোনো সুনির্দিষ্ট আইন - বিধিও বিচারকার্যে অনুসৃত হত বলে - প্রমান পাওয়া যায়নি। গ্রামাঞ্চলে বিচারকার্য সম্পাদন করতেন গ্রামপ্রধান বা প্যাটেল। ন্যায়াধীশ নামক বিচারকেরা আপিলের বিচারকার্যের তদারক করতেন। '' হাজির মজলিস '' ছিল সর্বোচ্চ আপিল আদালত। 

৪. রাজস্ব - ব্যবস্থা :- শিবাজীর রাজস্ব নীতির ওপর মালিক অম্বরের রাজস্ব নীতির প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। শিবাজী কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি রাজস্ব আদায়ের নীতি গ্রহণ করেন। তিনি রাজ্যের সমস্ত জমি জরিপ করে উৎপন্ন ফসলের এক - তৃতীয়াংশ রাজস্ব ধার্য করেন। শস্যের পরিবর্তে নগদেও রাজস্ব প্রদানের রীতি প্রচলিত ছিল। এছাড়াও রাষ্ট্রের তরফে কৃষকদের ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা ছিল। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে শিবাজী উৎপীড়নের নীতি গ্রহণ করেননি। 

৫. চৌথ ও সরদেশমুখী :- মারাঠা রাজ্য ছাড়াও শিবাজী বিজাপুর ও মোগল অধিকৃত অঞ্চলগুলি থেকে চৌথ ও সরদেশমুখী নামক রাজস্ব আদায় করতেন। চৌথ ছিল ফসলের এক - চতুর্থাংশ এবং সরদেশমুখী ছিল উৎপন্ন ফসলের এক দশমাংশ। এগুলি ছিল মূলতঃ আত্মরক্ষা ও নিরাপত্তামূলক কর। এগুলি প্রধানদের মাধ্যমে উক্ত রাজ্যগুলি মারাঠাদের নিকট আক্রমণের হতে নিরাপত্তালাভ করতেন। অধ্যাপক যদুনাথ সরকার একে '' নিষ্কৃতি কর '' বলে উল্লেখ করেছেন। 


৬. সামরিক পরিকাঠামো :- সামরিক সংগঠনের ক্ষেত্রে শিবাজীর প্রতিভা ছিল অতুলনীয়। শিবাজীর পূর্ববর্তী সময়ে মারাঠাদের সামরিক সংগঠন স্থায়ী ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল না। সৈন্যরা অধিকাংশই ছিল কৃষিজীবী। কিন্তু শিবাজী এই ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটান। তিনি সেনাবাহিনীকে স্থায়ী ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং সৈন্যদের বেতন দেওয়ার রীতি প্রচলন করেন। তাঁর সেনাবাহিনী প্রায় চল্লিশ হাজার অশ্বারোহী ও এক লক্ষ পদাতিক সৈন্য দ্বারা গঠিত ছিল। 

৭. বর্গী ও শিলাদার :- শিবাজীর আমলে মারাঠা অশ্বারোহী বাহিনী বর্গী ও শিলাদার এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। বর্গীরা সরাসরি রাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র ও বেতন পেত। কিন্তু শিলাদাররা শুধুমাত্র যুদ্ধের সময় বেতন পেত এবং অস্ত্র তাদের নিজেদেরকেই সংগ্রহ করতে হত। পঁচিশজন অশ্বারোহী একজন হাবিলদারের অধীনে এবং পাঁচজন হাবিলদার একজন জুমলাদারের অধীনে থাকতো। 

৮. সেনাবাহিনীর উৎকর্ষতা :- অশ্বারোহী ছাড়াও শিবাজীর সেনাবাহিনীতে হস্তী , উট ও রণতরীও ছিল। সেনাবাহিনীতে প্রায় ১২০০ রণহস্তী ছিল। এছাড়াও শিবাজী একটি গোলন্দাজ বাহিনীও তৈরী করেছিলেন। তাঁর সেনাবাহিনীতে কামান ও বন্দুকের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। হিন্দু , আফগান , আরবি , মুসলিম - সকলেই শিবাজীর সেনাবাহিনীর অন্তর্গত ছিল। 

৯. দুর্গ : সামরিক ব্যবস্থার প্রধান অঙ্গ :- শিবাজীর সামরিক ব্যবস্থায় দুর্গগুলি ছিল মারাঠা শক্তি ও সামরিক উৎকর্ষতার প্রতীক। এগুলি ছিল সামরিক সংগঠনের প্রধান কেন্দ্র। দুর্গের শাসনভার ন্যাস্ত ছিল হাবিলদার , সর্বনিশ এবং স্বর্ণবৎ নামক তিন পদাধিকারীর হাতে। এগুলিতে যুদ্ধের জন্য সর্বদা প্রচুর পরিমানে অস্ত্র ও রসদ মজুদ থাকত। দুর্গগুলির শক্তির ভিত্তিতেই মারাঠা বাহিনী পরাক্রমী হয়ে উঠেছিল। 


শিবাজীর শাসন - ব্যবস্থার সমালোচনা :- 

শিবাজীর শাসন ও সামরিক ব্যবস্থা উভয়ই ত্রুটিমুক্ত ছিলনা। 
প্রথমতঃ - অতি অল্প সময়ের মধ্যে শিবাজীকে বহু যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হতে হয়। ফলে প্রয়োজনীয় শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের সময় তিনি পাননি।   

দ্বিতীয়তঃ - শিবাজী জায়গীর প্রথার সম্পূর্ণ বিলোপ সাধন করতে পারেননি। ফলে তাঁর মৃত্যুর পর জায়গীর প্রথা পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। 

তৃতীয়তঃ - শিবাজী চৌথ ও সরদেশমুখী নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার শিকার। ঐতিহাসিকদের মতে এই দুই কর ছিল একধরণের ডাকাতি এবং তা বলপূর্বক আদায় করা হত। 

চতুর্থতঃ - শিবাজীর মন্ত্রীসভাতে ব্রাহ্মণদের অতিরিক্ত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাঁর অষ্টপ্রধানের প্রায় সকলেই ছিলেন ব্রাহ্মণ। ফলে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষেরা শিবাজীর বিরোধীভাবাপন্ন হয়েছিল। 

পঞ্চমতঃ - বিজিত রাজ্যে জমি বন্টনকে কেন্দ্র করেও মারাঠাদের মধ্যে বিবাদের সূত্রপাত ঘটে - যা শিবাজী দূর করতে পারেননি।  

ষষ্টতঃ - শিবাজী সাক্ষরতার প্রসারে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। ফলে মারাঠাদের নিরক্ষরতা মারাঠাদের অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করেছিল। 

সপ্তমতঃ - শিবাজীর শাসন ব্যবস্থায় নারীদের তেমন গুরুত্ব ছিলনা। তৎকালীন সময়ে মারাঠা রাজ্যে নারী শিক্ষাও অবহেলিত ছিল। 

তবে এসব স্বত্তেও বলা যায় , শিবাজী তৎকালীন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যে শাসন ব্যবস্থার পরিচয় দিয়েছিলেন এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মোগল প্রতিরোধের নীতি গ্রহণ করেছিলেন তা বহুল প্রশংসার দাবী রাখে। শিবাজীর পরাক্রম এই ঘটনাতেই প্রমাণিত হয় যে তাঁর রাজত্বকালে ঔরঙ্গজেব সমস্ত বল প্রয়োগ করেও মারাঠাদের পদানত করতে পারেন নি। শুধুমাত্র এই ঘটনার জন্যই শিবাজী ভারতীয়দের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন। শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠা রাজ্যের উত্থান পরবর্তীকালে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষে সহায়ক হয়েছিল।       


You May Also Like

0 comments