মোগল আমলে জায়গীরদারি সংকট ; Jaigirdari crises in Mughal Period.

by - December 26, 2021

Jaigirdari crises in Mughal Period. 

মোগল আমলে জায়গীরদারি সংকট সম্পর্কে আলোচনা কর। 

অথবা , জায়গীরদারি সংকট মোগল সাম্রাজ্যের পতনে কতটা দায়ী ছিল - যুক্তিসহ আলোচনা কর। 


জায়গীরদারি সংকট : - 


জায়গীরদারি প্রথার সংক্ষিপ্ত পরিচয় :- জায়গীরদার ও মনসবদার কথা দুটি প্রায় সমার্থক। প্রতিটি জায়গীরদার মনসব গ্রহণের অধিকারী ছিলেন। মোগল আমলে প্রতিটি জমির রাজস্ব পূর্ব হতেই নির্ধারিত থাকতো। যে এলাকা থেকে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয় সেই জমি সমমর্যাদাযুক্ত মনসবদারের মধ্যে বন্টন করা হত। জায়গীরের আয়ই ছিল মনসবদারের বেতন। এছাড়া নগদেও বেতন দেওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। এই প্রথা ধীরে ধীরে মোগল প্রশাসনের নিকট সমস্যা হয়ে পড়ে। 


জায়গীরের শ্রেণীভাগ :- মোগল আমলে জায়গীরকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হত - 
(i) তনখা জায়গীর ও 
(ii) ওয়াতেন জায়গীর। 
বেতনের বিনিময়ে যে জায়গির প্রদান করা হত - তাকে বলা হত তনখা জায়গীর। আর ওয়াতেন জায়গীর ছিল জমির ওপর স্বত্ব ভোগের অধিকার। এই জায়গীর পেতেন মূলতঃ হিন্দুরা এবং তা ছিল বংশানুক্রমিক। ওয়াতেন জায়গীরগুলির রাজস্বের পরিমাণ আকবরের সময়কালেই নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। 

রাজস্ব ঘাটতি :- আকবরের পরবর্তীকাল থেকেই জায়গীরদারি সমস্যার সূত্রপাত ঘটে। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বহু প্রাদেশিক শাসকেরা রাজস্ব প্রদান বন্ধ করে দেন। ঔরঙ্গজেবের সময়ে এই অবস্থা ভয়ানক হয়ে পড়ে। রাজকোষ একেবারে শুন্য হয়ে যায়। সেনাবাহিনীর পরিচালনার জন্যও প্রয়োজনীয় অর্থ অবশিষ্ট ছিল না। এছাড়া বিদ্রোহী জমিদার ও প্রজারাও খাজনা প্রদান বন্ধ করে দিলে অবস্থা চরমে ওঠে। 


খালিশা জমির পরিমান হ্রাস :- আকবরের পরবর্তীকালে অর্থ সংকট তীব্র হলে মনসবদারদের মধ্যে জমি বন্টনের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের খাস জমি বা খালিশা জমিকেও জায়গিরে পরিণত করা শুরু হয়। ফলে খালিশা জমি থেকে রাষ্ট্রের আয় কমতে থাকে। এর ফলে আবার সম্রাট রাজস্বের ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে জায়গিরদারদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। 

জায়গীরদারি ব্যবস্থার মধ্যে অন্তঃবিরোধ :- জায়গীরদারি ব্যবস্থার মধ্যে একটি অন্তঃবিরোধ ও বৈপরীত্য ছিল। জায়গীরদারদের অধিকার বংশানুক্রমিক ছিলনা। আবার জায়গীররা রাজস্বের অধিকারী হলেও জমির মালিক ছিলেন না। জায়গীরদাররা রাজস্ব আদায় করলেও তা স্থির করত কানুনগো নামক রাজকর্মচারী। আবার জায়গীরদারদের অধিকার কতদিন বলবৎ থাকবে তাও নিশ্চিত ছিলনা। বিচার বা শান্তি শৃঙ্খলার দায়িত্ব জায়গীরদারদের হাতে থাকলেও সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত বাহিনীও ছিল। এই ভাবে জায়গীরদারদের ক্ষমতার মধ্যে এক বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। 

ভূমি কেন্দ্রিক রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার :- উপরোক্ত কারণগুলির জন্য জায়গীরদারদের মধ্যে কৃষকের আয় আত্মসাৎ করার প্রয়াস দেখা যায়। অনেকে নগদে রাজস্ব পরিশোধ করত বলে তারা অনেক কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। সমগ্র রাজস্ব ব্যবস্থার দায়িত্বে ছিল - তালুকদার , মুকাদ্দাম - প্রমুখ কর্মচারীরা ; ফলে রাজস্বের সিংহভাগ তারাই আত্মসাৎ করত। মধ্যস্বত্বভোগীরা এইভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে থাকলে তা জায়গীরদারি ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়। 


কৃষকদের ওপর শোষণ ও অত্যাচার :- যেহেতু জায়গীরদারি ব্যবস্থা বংশানুক্রমিক ছিলনা এবং জায়গীরদারি অধিকারের কোনো নিশ্চয়তা ছিলনা ; তাই জায়গীরদাররা কৃষকদের শোষণ ও অত্যাচারের মাধ্যমে অধিক মুনাফা অর্জনের পথকেই বেছে নিয়েছিল। অনেক সময় জায়গীরদাররা নিজে রাজস্ব আদায় না করে ইজারাদারদের দায়িত্ব প্রদান করত। ইজারাদাররা দায়িত্ব পাওয়ার পর ভারতের গ্রামগুলি যেন মরুভূমিতে পরিণত হয়। 

জায়গীরদারদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা :- জমির জায়গীরদারি দখলকে কেন্দ্র করে মোগল দরবারে ঘৃণ্য রাজনৈতিক দলাদলি শুরু হয়। উন্নতমানের জায়গির প্রাপ্তির জন্য সকলেই দরবারে নিজ নিজ প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে জায়গীরদারি কেনা - বেচার রীতিও প্রচলিত হয়।  জায়গিরদারদের এই অবৈধ কার্যকলাপ সম্পর্কে সম্রাট অবগত থাকলেও , রাজস্ব প্রাপ্তির লোভে তিনি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন না। 

জমা ও হাসিলের মধ্যে পার্থক্য : প্রশাসন ও জায়গীরদারদের মধ্যে সংঘাতের অনিবার্যতা :- জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের আমলে জায়গীরদারদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু , দেখানো রাজস্ব বা জমা ও আদায়কৃত রাজস্ব বা হাসিলের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য দেখা যেতে থাকে। ঔরঙ্গজেবের আমলে জায়গীরদারদের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেলে সমস্যা আরো ঘনীভূত হয়। জায়গীরদারের সংখ্যা বাড়লেও বণ্টনযোগ্য জমির পরিমান বাড়েনি। ফলে প্রশাসনের সঙ্গে জায়গীরদারদের সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। 

মোগল সাম্রাজ্যের পতনে জায়গীরদারি সংকটের ভূমিকা :- 

জায়গীরদারি ব্যবস্থার সংকট মোগল প্রশাসনিক ভিতকে দুর্বল করে দিয়েছিল ও ভারতের কৃষি ব্যবস্থার উপর চরম আঘাত হেনেছিল। জায়গীরদাররা ইজারাদার নিযুক্ত করলে তারা রাজস্বের জন্য কৃষকদের অমানবিক অত্যাচার শুরু করলে তা কৃষি ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। একদিকে প্রশাসনিক দুর্বলতা ও অন্যদিকে কৃষি সংকট মোগল সাম্রাজ্যের শেষ মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দেয়।   


  

You May Also Like

0 comments