position of asoka in history ( বিশ্ব ইতিহাসে অশোকের স্থান )

by - November 26, 2021

Discuss Asoka's position in history .  

বিশ্ব ইতিহাসে অশোকের স্থান। 




সমগ্র বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় অশোকের নাম স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক তাঁকে কনস্টানটাইন , মার্কাস অরেলিয়াস , আলেকজান্ডার , মহান আলফ্রেড , জুলিয়াস সিজার , শার্লেম্যান , আকবর , নেপোলিয়ন - প্রমুখ উল্লেখযোগ্য প্রভাবশালী মহান নরপতিদের সঙ্গে তুলনা করেছেন ; কিন্তু বাস্তব বিচারে অশোকের কাছে তাঁদের গৌরব ম্লান হয়ে যায়। 
ভিনসেন্ট স্মিথের মতে , সর্বদেশে সর্বকালে যে সকল নরপতি সিংহাসনে বসেছেন , ' দেবানাং প্রিয় প্রিয়দর্শী ' রাজা অশোক তাঁদের মধ্যে উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্কের ন্যায় বিরাজ করছেন। তাঁর শাসনকাল ' প্রপীড়িত মানব ইতিহাস '- এর এক চিরস্মরণীয় বিরতিকালে। 
পল ম্যালন অরল বলেন যে , কেবলমাত্র ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ নরপতি নয় - তিনি পৃথিবীর মহান দার্শনিক নৃপতিদের অন্যতম। 


যুদ্ধজয়ের পরিবর্তে ধর্মবিজয় :- 
অশোক যে একজন রণনিপুণ যোদ্ধা ছিলেন , সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সিংহাসনে আরোহনের অল্পদিনের মধ্যেই চোল , পান্ড্য প্রভৃতি রাজ্যের মিত্র কলিঙ্গের মত একটি শক্তিশালী রাজ্যকে পরাজিত করে তিনি মৌর্য সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিধান করেন। যুগধর্মকে মেনে নিয়ে সামরিক জয়ের জয়ের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে তিনি অনায়াসে দক্ষিণ ভারত - এমনকী ভারতের বাইরেও সামরিক অভিযান পাঠিয়ে সমরবিজয়ী নেতা হিসেবে স্থায়ী কীর্তির অধিকারী হতে পারতেন। কিন্তু সম্রাট অশোক সে পথে অগ্রসর না হয়ে জীবনের প্রথম যুদ্ধ জয়ের পরই চিরতরে যুদ্ধনীতি ত্যাগ করে শান্তি , মৈত্রী ও বিশ্বভাতৃত্বের আদর্শ প্রচারে ব্রতী হন। সমগ্র বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় অশোকের মত এমন নরপতির সন্ধান আমাদের জানা নেই। দিগ্বিজয়ী অশোক ধর্মবিজয়ী রাজর্ষি অশোকে পরিণত হন এবং সমগ্র বিশ্বের রাজতন্ত্রের ইতিহাসে এক নবচেতনার সঞ্চার করেন। তাঁর রাজত্বকালে মগধের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূত্রপাত হয়। 

নতুন রাজাদর্শ :- 
বিশ্ব ইতিহাসে সম্রাট অশোকই প্রথম এক নতুন ধরণের রাজাদর্শ বা রাজ কর্তব্যের অভিনব আদর্শ তুলে ধরেন। তিনি রাজপদকে উপভোগ , বিলাস - ব্যসন বা স্বার্থসিদ্ধির উপায় বলে মনে করতেন না। তাঁর কাছে রাজপদ ছিল জনকল্যাণ ও মানবহিতৈষণার সুযোগ। প্রজাবর্গকে তিনি কখনোই রাজস্ব প্রদানের যন্ত্র বা শোষণের উপাদান বলে মনে করতেন না। প্রজাবর্গকে নিজ সন্তান বলে ঘোষণা করে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রজাকল্যানে নিয়োজিত করে তিনি জনকল্যাণের এক নতুন আদর্শ তুলে ধরেন। এইভাবে তিনি Welfare State বা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের আদর্শ তুলে ধরেন। 


অধ্যাপক কোশাম্বীর অভিমত :- 
তিনি ঘোষণা করেন যে , '' সব মুনিষে পজা মমা '' - অর্থাৎ , সব মানুষই আমার সন্তান এবং তাদের কল্যাণ সাধনই তাঁর জীবনের ব্রত। প্রজাদের ইহজগতে এবং পরজগতে সুখী করাই ছিল অশোকের রাজাদর্শের মূল লক্ষ্য। অশোকের মতে , এই কর্তব্য পালন করে তিনি জীবনের প্রতি তাঁর ঋণ শোধ করতে চান। অধ্যাপক কোশাম্বীর মতে , এই রাজকর্তব্যের মধ্যে Contract Theory বা চুক্তিতত্ত্বের বীজ নিহিত আছে। এই চুক্তিতত্ত্ব অনুসারে প্রজা মঙ্গলের শর্তেই রাজা তাঁর সিংহাসন লাভ করেছেন। 

প্রজাবৎসল শাসক :- 
পিতৃত্ববোধের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রজাকল্যানের জন্য তিনি রাজপথ নির্মাণ , রাস্তার দু'পাশে ছায়াপ্রদ বৃক্ষরোপন , কূপখনন , পান্থশালা নির্মাণ ও চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন। কেবলমাত্র মানুষের জাগতিক কল্যাণ সাধনই নয় - তাদের পারত্রিক মঙ্গলসাধনে ব্রতী হয়ে তিনি যথার্থ পিতার দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়েছিলেন। রাজুক , যুত , মহামাত্র , ধম্মমহামাত্র  - প্রভৃতি রাজকর্মচারীদের উপর তিনি প্রজাবর্গের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। স্ত্রীজাতির কল্যাণের জন্য তিনি ' স্ত্রী অধ্যক্ষ মহামাত্র ' নিয়োগ করেন। 

শান্তি , মৈত্রী ও প্রেমের আদর্শ :- 
তাঁর জনহিতৈষণা কেবলমাত্র নিজ রাজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না - বহির্বিশ্বের অন্যান্য স্বাধীন রাজ্যেও তা সম্প্রসারিত হয়েছিল। কেবলমাত্র মানুষই নয় - বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় তিনিই প্রথম নরপতি , যিনি পশু পক্ষীর চিকিৎসা ও মঙ্গলসাধনে ব্রতী হয়েছিলেন। পশুহত্যার পরিমাণ সীমায়িত করার জন্য তিনি কয়েকটি বিধি প্রবর্তন করেন , নিজে মাংসাহার ত্যাগ করেন , নানা স্থানে পশু চিকিৎসালয় স্থাপন এবং মানুষ ও পশুর উপকারে আসে এমন ওষধি বৃক্ষও রোপন করেন। প্রকৃত মানবপ্রেমিক ও রাজর্ষি অশোক শান্তি , মৈত্রী ও প্রেমের উপর ভিত্তি করে নতুন ধরণের পররাষ্ট্রনীতি প্রবর্তন করেন। ভারতে ও ভারতের বাইরে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে তিনি মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হন। 

অশোক কর্তৃক প্রচারিত বৌদ্ধধর্মের স্বরূপ  :- 
ভারতের এক ক্ষুদ্র অঞ্চলে সীমাবদ্ধ বৌদ্ধ ধর্মকে তিনি বিশ্বধর্মে রূপান্তরিত করেন। তাঁর অক্লান্ত চেষ্টার ফলে এশিয়া , ইউরোপ ও আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভগবান তথাগতের প্রেম , শান্তি ও সৌহার্দ্যের আদর্শ বিস্তার লাভ করে। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী অশোক ছিলেন যথার্থই পরধর্মসহিষ্ণু এবং তাঁর প্রচারিত বৌদ্ধধর্ম ছিল যথাযথ অর্থে উদার ও সর্বজনীন। ধর্মীয় সংকীর্ণতার উর্ধে তিনি মানবধর্মকেই স্থান দেন। তিনি বলতেন , '' নিজ ধর্মকে শ্রেষ্ঠ , এবং অপর ধর্মকে নিকৃষ্ট জ্ঞান করা অনুচিত। '' ব্রাহ্মণ , শ্রমণ , জৈন , আজিবক - সকলেই তাঁর কাছে সমান ছিলেন। 

সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও উদারতা :- 
ভারতীয় ভাষা , সাহিত্য , স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রেও তাঁর দান অতুলনীয়। তাঁর ধর্মপ্রচারের ফলে পালি ভাষা সর্বভারতীয় ভাষায় পরিণত হয় এবং এই ভাষায় গ্রন্থাদি রচিত হতে থাকে। তাঁর আমলে ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী লিপি ভারতের সর্বত্র প্রচলিত হয়। এইভাবে তিনি ভাষা ও লিপির মাধ্যমে সর্বভারতীয় ঐক্যের আদর্শকে বলবতী করে তোলেন। তাঁর আমলে অসংখ্য স্তুপ , বিহার , চৈত্য নির্মিত হয়। এর ফলে ভারতীয় শিল্পের ক্ষেত্রেও এক পরিবর্তন আসে। 

ঐতিহাসিক স্মিথ - এর মতে , অশোক ছিলেন মানব জাতির প্রথম ধর্মগুরু। H.G. Wells এর মতে , ইতিহাসের পৃষ্ঠায় হাজার হাজার নরপতিদের মধ্যে অশোকই একমাত্র উজ্জ্বল নক্ষত্র। Dr. R.C. Majumder এর মতে , বিশ্বের ইতিহাসে অশোক অতুলনীয় এবং অশোকের আবির্ভাব ভারতকে মহিমান্বিত করেছে। ডক্টর রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় বলেন যে , সমগ্র বিশ্বের রাজতন্ত্রের ইতিহাসে মানুষ ও শাসক হিসেবে অশোকের সঙ্গে কারো তুলনা চলে না। 

অশোক ছিলেন ভারতের প্রথম সম্রাট যিনি সমগ্র ভারতকে রাজনীতিগতভাবে এক ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করেছিলেন। এক আদর্শ ও এক ভাষা তিনি দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। একটি দেশকে গড়ে তোলার পক্ষে এটি ছিল তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ দান। তবে , কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে , অশোকের অহিংস নীতির ফলে দেশ হীনবীর্য হয়ে পড়েছিল যা পরবর্তীকালে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ ছিল। তবে এতে অশোকের শ্রেষ্ঠত্ব কোনোঅংশেই ম্লান হয় না। কেননা , অশোকের মত সর্বতোমুখী প্রতিভাবান সম্রাট সমগ্র বিশ্ব ইতিহাসে আর দেখা যায়না। তাঁর রাজ আদর্শ বিশ্ববাসীর শ্রদ্ধা অর্জন করে। তাই বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে অশোক একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। তিনি ছিলেন এক মহান আদর্শস্থানীয় নরপতি।   



You May Also Like

0 comments