difference between harappa and vedic civilisation .

by - November 10, 2021

হরপ্পা ও বৈদিক সভ্যতার তুলনামূলক আলোচনা। 

হরপ্পা ও বৈদিক সভ্যতার পার্থক্য। 

সিন্ধু সভ্যতা ও আর্য সভ্যতার পার্থক্য। 

সিন্ধু সভ্যতা ও বৈদিক সভ্যতার পার্থক্য। 




হরপ্পা ও বৈদিক সভ্যতার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। পার্থক্যগুলি নিম্নরূপ - 

১. বিস্তারগত ক্ষেত্রে :-  হরপ্পা সভ্যতা মূলত ভারতের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে গড়ে ওঠে এবং পরবর্তীকালে তার প্রভাব গাঙ্গেয় সমভূমি ও দক্ষিণে কিছুটা বিস্তার লাভ করে। 
অপরদিকে আর্যাবর্তকে কেন্দ্র করে আর্য তথা বৈদিক সভ্যতার বিস্তার ঘটে সারা ভারত জুড়ে। 

২. প্রকৃতিগত ক্ষেত্রে :- হরপ্পা সভ্যতা নগরকেন্দ্রিক , কিন্তু আর্য সভ্যতা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। আর্যদের ঘরবাড়ি ছিল বাঁশ ও খড়ের তৈরী। অপরপক্ষে হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা পোড়া ইঁটের তৈরী বহুতল গৃহে বসবাস করত। হরপ্পার প্রশস্ত রাজপথ , উন্নত পয়ঃপ্রণালী ও স্নানাগার সমৃদ্ধ নগর জীবনের সাক্ষ্য বহন করে। পক্ষান্তরে , আর্য সভ্যতা কৃষিকাজ , প্রশাসন , ব্যবসা বাণিজ্য , উৎপাদন - সবক্ষেত্রেই গ্রামীণ জীবনের পরিচয় বহন করে। 


৩. লৌহের ব্যবহারের ক্ষেত্রে :- হরপ্পা সভ্যতা ছিল তাম্র ও ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা। এই যুগে লোহার ব্যবহার শুরু হয়নি। অপরপক্ষে , বৈদিক সভ্যতা ছিল লৌহ যুগের সভ্যতা। আর্যরা কৃষিকাজ , রাজনীতি তথা যুদ্ধ - বিগ্রহে লোহার ব্যাপক প্রচলন ঘটিয়েছিল। 

৪. অশ্বের ব্যবহারের ক্ষেত্রে :- হরপ্পা সভ্যতায় ঘোড়ার ব্যবহার অজ্ঞাত ছিল। হরপ্পা সভ্যতায় কেবলমাত্র একটি ক্ষেত্রে এবং একেবারে উপরের স্তরে ঘোড়ার কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয়েছে। সুতরাং হরপ্পা সভ্যতায় ঘোড়া প্রায় অপরিচিত ছিল। অপরপক্ষে , ঘোড়া ছিল আর্যদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী। আর্যরা যুদ্ধের সময় ঘোড়া ব্যবহার করত এবং ঘোড়ায় টানা রথ ব্যবহার করত। প্রকৃতপক্ষে অনার্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভের ক্ষেত্রে ঘোড়া ছিল আর্যদের অন্যতম হাতিয়ার। 


৫. লিখনরীতির ক্ষেত্রে :- হরপ্পা সভ্যতায় লিখনরীতি সুপ্রচলিত ছিল। বিভিন্ন সিলের উপর সেই লিপি উৎকীর্ণ আছে। অন্যদিকে , বৈদিক সভ্যতায় লিখন প্রণালীর প্রচলন হয়নি। আর্যদের দ্বারা রচিত প্রাচীনতম সাহিত্য বেদ ছিল শ্রুতিভিত্তিক। 

৬. অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে :- হরপ্পার অর্থনীতিতে কৃষি , শিল্প ও বাণিজ্য ছিল প্রধান। কিন্তু বৈদিক আর্যদের অর্থনীতি ছিল কৃষি ও পশুপালন নির্ভর। যা নগর ও গ্রাম সভ্যতার পার্থক্যকে আরও সুস্পষ্ট করে তোলে। 

৭. ধর্মীয় ক্ষেত্রে :- 
(ক ) উভয় সভ্যতার পূজা পদ্ধতিতে বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। হরপ্পা সভ্যতায় মন্দিরের অস্তিত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট সংশয় আছে। কিন্তু বৈদিক সভ্যতায় মন্দির ছিল আর্যদের ধর্মীয় জীবনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। 
(খ ) হরপ্পা সভ্যতায় মূর্তিপূজা প্রচলিত ছিল , কিন্তু বৈদিক সংস্কৃতিতে মূর্তিপূজা অজ্ঞাত ছিল। বৈদিক সভ্যতায় মূলত অগ্নি , বৃক্ষ - ইত্যাদির পূজা প্রচলিত ছিল। বৈদিক আর্যরা মূলত ছিল প্রকৃতির পূজারী।
(গ ) হরপ্পা সভ্যতায় বৃষের পূজা প্রচলিত ছিল ; কিন্তু বৈদিক আর্যরা গাভীর পূজা করত। 
(ঘ ) হরপ্পাবাসী শিবলিঙ্গ ও মাতৃদেবীর উপাসনা করত। কিন্তু আর্য সভ্যতায় লিঙ্গপূজা নিন্দনীয় ছিল। 
(ঙ ) হরপ্পা সভ্যতায় স্ত্রী দেবীদের প্রাধান্য ছিল ; কিন্তু আর্য সভ্যতায় ছিল পুরুষ দেবতাদের প্রাধান্য। 

৮. মাতৃতান্ত্রিক ও পিতৃতান্ত্রিক :-  হরপ্পার সমাজ ছিল মাতৃকেন্দ্রিক ; কিন্তু বৈদিক সমাজ ছিল পিতৃকেন্দ্রিক। 

৯. সৎকার পদ্ধতির ক্ষেত্রে :- হরপ্পাবাসীরা মৃতদেহ সমাধিস্থ করত তথা কবর দিত। কিন্তু বৈদিক আর্যরা মৃতদেহ দাহ করত। 

১০. আত্মরক্ষামূলক অস্ত্রের ক্ষেত্রে :-  হরপ্পা সভ্যতায় ঢাল , শিরস্ত্রাণ প্রভৃতি আত্মরক্ষামূলক অস্ত্রের প্রচলনের প্রমান পাওয়া যায়। কিন্তু বৈদিক সভ্যতায় এরূপ আত্মরক্ষামূলক কোনো অস্ত্রের পরিচয় পাওয়া যায়নি। 


১১. মৃৎপাত্রের ক্ষেত্রে :- মৃৎপাত্রের ক্ষেত্রেও উভয় সভ্যতার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। হরপ্পা সভ্যতায় মৃৎপাত্রের রং ছিল লাল - কালো। অপরদিকে , আর্যদের মৃৎপাত্রের রং ছিল ধূসর ( Grey ware ) । 

১২. শ্রমের পরিপ্রেক্ষিতে বর্ণ বিভাজন :- হরপ্পায় শ্রেণী বৈষম্যের প্রভাব থাকলেও হরপ্পাবাসীদের জীবনে চতুরাশ্রম প্রথা প্রচলিত ছিল না। পক্ষান্তরে , আর্যদের সামাজিক জীবনে চতুরাশ্রম প্রথা প্রচলিত ছিল। 

১৩. সামুদ্রিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে :- হরপ্পা সভ্যতায় সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সমুদ্রপথে সিন্ধুবাসীরা পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্য করত। কিন্তু আর্যদের বাণিজ্য উপকূলরেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। 

১৪. গো - ধনের ক্ষেত্রে :- বৈদিক সংস্কৃতিতে গো - ধনের যথেচ্ছ উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু হরপ্পা সংস্কৃতিতে সেরকম কোনো উল্লেখ নেই। 

১৫. নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদির ক্ষেত্রে :- সিন্ধু জনগণের মধ্যে রৌপ্যের সাধারণ প্রচলন ছিল এবং বাসন - পত্র ইত্যাদি প্রস্তর দ্বারা নির্মিত হত। কিন্তু বৈদিক আর্যদের যুগে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি রৌপ্য দ্বারা নির্মিত হত।   

হরপ্পা ও বৈদিক সভ্যতার মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে যে যথেষ্ট পার্থক্য ছিল - সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। হরপ্পা সভ্যতা ছিল যথেষ্ট উন্নত মানের ; সে তুলনায় আর্য সভ্যতা ছিল পশ্চাদপদ। ঐতিহাসিকেরা তাই অনেকেই আর্যদের বর্বর জাতি বলে অভিহিত করেছেন। Dr. R.S. Sharma আর্যদের নগর বিনাশকারী হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। যদিও আর্যরা বর্বর ছিল - এ ধারণা সম্পূর্ণভাবে সঠিক নয়। প্রথমদিকে আর্যদের নাগরিক জীবনের উন্মেষ না হওয়ার কারণ হল তাদের পশুচারণবৃত্তির অগ্রাধিকার এবং এজন্য তারা একস্থানে বেশিদিন থাকত না। পরবর্তীকালের ভারতীয় সংস্কৃতির অগ্রগতিতে আর্যরাই প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। তবে , উভয় সভ্যতার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান থাকলেও , ভারতীয় সভ্যতার বিকাশে উভয় সংস্কৃতির অবদান ছিল যথেষ্ট।    

     

You May Also Like

0 comments