গান্ধীজির সত্যাগ্রহ নীতির অর্থ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ কর।

by - October 23, 2021

গান্ধীজির সত্যাগ্রহ নীতির অর্থ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ কর। 




সত্যাগ্রহের অর্থ ও প্রকৃতি :- 

গান্ধীজির রাজনৈতিক তত্ত্বের অন্যতম প্রধান নীতি হল সত্যাগ্রহ। সত্যাগ্রহ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল সত্যের প্রতি আগ্রহ। সত্যাগ্রহ হল এক সুসংহত জীবনদর্শন ; সত্য প্রতিষ্ঠার নৈতিক সংগ্রামে এক নিরস্ত্র প্রতিরোধ। 
গান্ধীজি তাঁর হিন্দ - স্বরাজ এ সত্যাগ্রহের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন , সত্যাগ্রহ হল ব্যক্তির আত্মপীড়নের মাধ্যমে স্বাধিকার অর্জনের এক প্রচেষ্টা। 
তবে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞগণ গান্ধীজির সত্যাগ্রহকে ব্রিটিশের বিপক্ষে চালিত রাজনৈতিক সংগ্রামের এক কৌশল বলে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু গান্ধীজির মতে , সত্যাগ্রহ ছিল সত্য , অহিংসা ও আত্মত্যাগের যোগফল। তাঁর মতে , সত্যাগ্রহ বলতে বোঝায় সকল অন্যায় , অবিচার , নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে পবিত্র আত্মশক্তির প্রতিরোধ। তাঁর ভাষায় '' Satyagraha means the exercise of the purest soul - force against all injustice , oppression and exploitation .'' 
গান্ধীজি মনে করতেন , সত্যাগ্রহ হল যেকোনো ব্যক্তির এক সহজাত জন্মগত অধিকার। এ শুধু পবিত্র অধিকার নয় , পবিত্র কর্তব্যও। 


সত্যাগ্রহের প্রকৃতি :- 

গান্ধীজি তাঁর রচনায় সত্যাগ্রহের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যেসব দিকের কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল - 

১. আত্মিক শক্তির সংগ্রাম :- 
গান্ধীজির মতে , সত্যাগ্রহ হল আত্মিক শক্তির এক সংগ্রাম। এ হল এমন এক ধরণের সংগ্রাম যেখানে প্রচলিত অর্থে জয় - পরাজয় বলে কিছু নেই। সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করাই হল এই সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য। 

২. নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ নয় , সর্বশক্তি দিয়ে অন্যায়কে অস্বীকার :- 
গান্ধীজির অভিমত অনুসারে সত্যাগ্রহ নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ নয় , এ হল সর্বশক্তি দিয়ে অন্যায়কে অস্বীকার করার সংগ্রাম। নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ হল দুর্বল , ভীরু ও কাপুরুষের অস্ত্র , সত্যাগ্রহ তা নয়। নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বিপক্ষের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ থাকতে পারে , তবে সত্যাগ্রহে এসবের স্থান নেই। সত্যাগ্রহ হল সদিচ্ছা ও ভালোবাসার সাহায্যে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে অন্যায়কে অস্বীকার করার এক পদ্ধতি। 

৩. জন্মগত অধিকার :- 
গান্ধীজি মনে করতেন , সত্যাগ্রহ হল মানুষের সহজাত জন্মগত অধিকার। এ হল প্রতিটি মানুষের কাছেই জন্মগতভাবে এক অর্জিত অধিকার। এই কারণে গান্ধীজি একে পবিত্র অধিকার ও পবিত্র কর্তব্য বলে অভিহিত করেন। 


৪. সত্যাগ্রহ ও প্রতিপক্ষ :- 
প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘাতের পথে গিয়ে তার ওপর চরম আঘাত হানা সত্যাগ্রহের কাজ নয়। সত্যাগ্রহের পথ আলাদা। সেখানে অহিংসা , প্রেম ও ভালোবাসার সাহায্যে প্রতিপক্ষের হৃদয় জয় করাই হল এর মূল উদ্দেশ্য। তাই গান্ধীজি সত্যাগ্রহীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন , এ কাজে অধৈর্য হলে চলবে না। অধৈর্য হওয়ার অর্থ হল হিংসার আশ্রয় গ্রহণ করা। অন্যায়কারী প্রতিপক্ষকে বিব্রত করার মনোভাব সত্যাগ্রহীদের থাকা উচিত নয়। 

৫. একটি সৃজনশীল পদ্ধতি :- 
গান্ধীজি মনে করতেন , সত্যাগ্রহ হল এক সৃজনশীল পদ্ধতি। আপাতদৃষ্টিতে সত্যাগ্রহীদের কিছু দাবী আদায় করার লক্ষ্য থাকলেও মূল উদ্দেশ্য হল প্রতিপক্ষের মনে শুভবোধ জাগ্রত করে তার হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটানো। এই কারণে সত্যাগ্রহকে একটি সৃজনশীল পদ্ধতি বলে অভিহিত করা হয়। গান্ধীজি এ কথা স্পষ্টভাবে বলেছেন , সত্যাগ্রহ ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয় , ব্যক্তির নীতি , কর্মপদ্ধতি ও অনৈতিক আদর্শের বিরুদ্ধে। 

৬. সত্যাগ্রহ দুর্বলের জন্য নয় :- 
গান্ধীজি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন , সত্যাগ্রহে দুর্বলতা , ভীরুতা ও কাপুরুষতার কোনো জায়গা নেই। তাঁর মতে , যারা ভীরু , কাপুরুষ ও দুর্বল তারা আর যাই হোক সত্যাগ্রহী হতে পারবে না। সত্যাগ্রহের অর্থ সত্যকে জয় না করা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য। এই কাজ দুর্বলচিত্ত মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। 


৭. সত্যাগ্রহ ও অহিংসা :- 
সত্যাগ্রহের সঙ্গে অহিংসার একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। সত্যাগ্রহী কখনও হিংসাকে প্রশ্রয় দেবে না। সে হবে অহিংসার পূজারি। প্রতিপক্ষকে সে ঘৃণা করবে না , তেমনি তাকে অতিরিক্ত শ্রদ্ধাও করবে না। এভাবে অহিংসা দিয়ে হিংসাকে জয় করার জন্য তাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এছাড়া গান্ধীজি সত্যাগ্রহীদের আত্মপীড়ণের জন্য তৈরি থাকতেও বলেছিলেন। তিনি মনে করতেন , অন্যায়ের প্রতিরোধ করার জন্য সত্যাগ্রহী আত্মবিসর্জন দিতেও বিন্দুমাত্র ভয় পাবে না। 

৮. সত্যাগ্রহের বিধি :- 
গান্ধীজি তাঁর রচনায় সত্যাগ্রহের বিধি সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন , একজন সত্যাগ্রহী প্রতিপক্ষকে বিশ্বাস করতে কখনোই শঙ্কিত হবে না। প্রতিপক্ষ যদি তাকে কুড়িবারও ঠকায় বা আঘাত করে , তবুও একুশবার সত্যাগ্রহী প্রতিপক্ষকে বিশ্বাস করার জন্য প্রস্তুত থাকবেন। কারণ সত্যাগ্রহের আদর্শের মূলকথা হল মানুষের প্রকৃতিতে নিয়ত আস্থা রাখা। 

৯. সত্যাগ্রহের কলাকৌশল :- 
গান্ধীজি সত্যাগ্রহের কলাকৌশলের কথাও লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কৌশল হল - 
(ক ) বিবেকের বিরুদ্ধে কোনো কিছু না করা। 
(খ ) প্রলোভনের ফাঁদে পা না দেওয়া। 
(গ ) বিজয়ীর আধিপত্যের সামনে মাথা নত না করা। 
(ঘ ) জনগণের কাছে যে বিষয়গুলি মৌলিক গুরুত্বের-সেগুলি কষ্ট স্বীকারের মধ্যে দিয়ে অর্জন করা। 
(ঙ ) সত্যাগ্রহে উচ্ছৃঙ্খলতার কোনো স্থান নেই। 
(চ ) সত্যাগ্রহের জন্য চরম ত্যাগ স্বীকার করতে এমনকি মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত থাকা। 

১০. সত্যাগ্রহের চরিত্র :- 
গান্ধীজি বলেছেন , সত্যাগ্রহের চরিত্রই হল সত্যাগ্রহের সৌন্দর্য , এটা আপনা - আপনিই আসে , এর সন্ধান করতে হয়না। নিরন্তর সত্য সন্ধান ও সত্যে উপনীত হওয়ার দৃঢ় সিদ্ধান্তের নামই সত্যাগ্রহ। 

গান্ধীজি বিনয় ও নম্রতাকে সত্যাগ্রহের সর্বাপেক্ষা কঠিন অংশ বলে মনে করতেন। ১৯২৫ সালের ১৯ মার্চ গান্ধীজি তাঁর সম্পাদিত " Young India " পত্রিকায় লিখেছেন , সত্যাগ্রহীদের নিজ পদ্ধতির ওপর অখন্ড বিশ্বাস ও অসীম ধৈর্য থাকতে হবে। সত্যাগ্রহের মূলে আছে মানব চরিত্রে বিশ্বাস , অন্যায়কারীদের মনে ন্যায়বোধ ও শুভবুদ্ধি জাগ্রত করা। গান্ধীজি কর্তৃক অনুসৃত সত্যাগ্রহের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল - সত্য , অহিংসা ও আত্মনিয়োগ। 

You May Also Like

0 comments