গান্ধীজির রাজনৈতিক দর্শনের মূল সূত্র

by - October 22, 2021

গান্ধীজির রাজনৈতিক দর্শনের মূল সূত্রগুলি আলোচনা কর। 





গান্ধীজির রাজনৈতিক দর্শনের মূল সূত্র :- 

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি কোনো রাষ্ট্র - দার্শনিক ছিলেন না। কোনো সুসংবদ্ধ ও সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক তত্ত্ব বা দর্শন তিনি গড়ে তোলেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেছেন , '' গান্ধীবাদ বলে কোনোকিছুই নেই। আমার পরে কোনো বিশেষ সম্প্রদায় রেখে যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। নতুন কোনো মৌলিক নীতি বা আদর্শের স্রষ্টা হিসেবে আমি কিছু দাবি করি না। আমি কেবল আমার নিজের মতো করে শাশ্বত সত্যকে আমার দৈনন্দিন জীবন ও সমস্যাবলীর ক্ষেত্রে প্রয়োগের চেষ্টা করেছি। '' 
পরবর্তী সময়ে গান্ধীজির অনুগামীরা তাঁর মতামত ও বক্তব্য সংকলন করে গান্ধীবাদ নামে একটি রাজনৈতিক দর্শন প্রচার করেন। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সত্যাগ্রহকে কার্যোপযোগী করাই হল গান্ধীজির সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। গান্ধীজির রাজনৈতিক দর্শনের মূল সূত্রগুলি হল - 


১. অহিংসা :- 
গান্ধীজির মতাদর্শের অন্যতম মূলনীতি হল অহিংসা। সাধারণভাবে অহিংসা বলতে অপরের প্রতি হিংসা না করা বোঝায়। গান্ধীজির মতে , অহিংসা বলতে ' চরমতম স্বার্থহীনতা'কে বোঝায়। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে অহিংসা হল ' ইতিবাচক ভালোবাসা '। অহিংসা দুর্বলতা নয় , অহিংসা এক নৈতিক শক্তি , এক সদর্থক ধারণা। 

২. সত্যাগ্রহ :- 
আভিধানিক অর্থে সত্যাগ্রহ হল সত্যের প্রতি আগ্রহ। গান্ধীজির সত্যাগ্রহের আদর্শ হল সত্যের জন্য তপস্যা , অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। সত্যাগ্রহ দুর্বলের অস্ত্র নয় , এটি একটি আত্মিক শক্তি। সত্যাগ্রহে কাপুরুষতা বা ভীরুতার কোনো স্থান নেই। গান্ধীজির সত্যাগ্রহ হল এমন এক আদর্শ যেখানে প্রেম ও ভালোবাসার সাহায্যে প্রতিপক্ষের হৃদয় পরিবর্তন করা যায়। সত্যাগ্রহের পদ্ধতিগুলির মধ্যে রয়েছে প্রতীকী বা আমরণ অনশন , অসহযোগ আন্দোলন , আইন অমান্য আন্দোলন , সরকারি অনুষ্ঠান বয়কট - ইত্যাদি। 


৩. সর্বোদয় :- 
সর্ব এবং উদয় এই দুটি শব্দ নিয়ে গঠিত হয় সর্বোদয়। সর্বোদয়ের আক্ষরিক অর্থ হল সকলের কল্যাণ ( Uplift for All ) । সমাজে এক উন্নত নৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলা সর্বোদয়ের মুখ্য উদ্দেশ্য। সত্য , অহিংসা এবং সৎ উপায়ের সাহায্যে এই পরিবেশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে গান্ধীজি মনে করতেন। অনাড়ম্বর জীবনযাপন ও মহৎ চিন্তার মাধ্যমে পারস্পরিক প্রেমবন্ধন ও সহযোগিতার ভিত্তিতে এই সর্বোদয় সমাজ গঠন করা সম্ভব। সর্বোদয়ে গ্রামভিত্তিক সভ্যতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সর্বোদয় অর্থনীতি হবে কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্পনির্ভর। আধুনিক বৃহৎ শিল্প সভ্যতাকে সর্বোদয় সমর্থন করেনা। 

৪. রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণা :- 
গান্ধীজির মতে , বলপ্রয়োগ হল আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি। রাষ্ট্র যে চরম সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী একটি প্রতিষ্ঠান - একথা গান্ধীজি বিশ্বাস করতেন না। তিনি সম্পূর্ণ নৈতিক কর্তৃত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত জনগণের সর্বভৌমিকতায় আস্থাশীল ছিলেন। তিনি মনে করতেন , সেই রাষ্ট্রই সবচেয়ে ভালো যা সবচেয়ে কম শাসন করে। এভাবে গান্ধীজি রাষ্ট্রের কর্মপরিধিকে সীমিত রাখতে চেয়েছিলেন। আদর্শ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় '' রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র '' থাকবে বলে গান্ধীজি মনে করতেন। রাষ্ট্রহীন এই গণতন্ত্র হল গান্ধীজির রামরাজ্য যাকে গ্রামভিত্তিক করে তুলতে তিনি পঞ্চায়েতিরাজ ব্যবস্থা পত্তনের কথা বলেছিলেন। 

৫. স্বরাজ সম্পর্কিত ধারণা :- 
স্বরাজ কথাটির অর্থ হল স্ব - রাজ্য বা স্ব - শাসন। সাধারণ অর্থে স্বরাজ হল পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি। তাঁর মতে , স্বরাজ হল এক আদর্শ মানবসমাজ , এক উন্নততর সামাজিক অবস্থা , যার মূল ভিত্তি হল পরিপূর্ণ সামাজিক সাম্য , স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার। গান্ধীজি বিশ্বাস করতেন , একটি জাতির জন্য স্বরাজের অর্থ হল সেই জাতির আত্মঅনুশাসন। 

৬. গ্রামীণ পুণর্গঠনের ধারণা :- 
কৃষিপ্রধান ভারতের উন্নয়নের জন্য গান্ধীজি গ্রামীণ পুনর্গঠনের ধারণার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। গান্ধীজি বিশ্বাস করতেন , ভারতের প্রাণশক্তি গ্রামগুলির উন্নতির মধ্যে নিহিত রয়েছে। গ্রামীণ ভারতের পুনর্গঠনের জন্য গান্ধীজি যে বিষয়গুলির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন , তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সমবায় প্রথার প্রচলন , জমিদারি প্রথার সংস্কার , গ্রামীণ শিল্পের বিকাশ , গ্রাম স্বরাজ , স্বাবলম্বন প্রভৃতি।     


 

৭. গণতন্ত্র সম্পর্কিত ধারণা :- 
গান্ধীজির মতে , প্রকৃত গণতন্ত্র কখনও অসত্য ও সহিংস পথে আসতে পারেনা। গণতন্ত্র ও হিংসা পাশাপাশি চলা দুস্কর। পশ্চিমের গণতন্ত্রকে তিনি '' নামমাত্র গণতন্ত্র '' বলেছেন। গণতন্ত্রে প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যাপারে গান্ধীজির অভিমত ছিল , মানুষ হিসেবে যারা ভালো ও খাঁটি তাদের মধ্যে থেকেই প্রতিনিধি বাছাই করতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে সংখ্যালঘুদের স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়না বলে তিনি আধুনিক গণতন্ত্রকে প্রকৃত গণতন্ত্রের মর্যাদা দেননি। গণতন্ত্রে সংখ্যার চেয়ে গুণকে প্রাধান্য দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। পারস্পরিক সহনশীলতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ গণতন্ত্রের ভিত্তি বলে গান্ধীজি বিশ্বাস করতেন। গান্ধীজি পঞ্চায়েতিরাজ থেকে এই গণতন্ত্র গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। 

৮. অছি সম্পর্কিত তত্ত্ব :- 
গান্ধীজির অছি - সম্পর্কিত তত্ত্বের মূল বক্তব্য হল , সমাজের ধনী ব্যক্তিরা তাদের ন্যূনতম চাহিদা মিটিয়ে সম্পদের বাকি অংশটুকু সর্বসাধারণের জন্য দান করবে। অছি হিসেবে তারাই অতিরিক্ত সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করবে। এর ফলে সমস্ত রকম শ্রেণিদ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং সমাজে নৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে। গান্ধীজির মতে , অছি - রক্ষণ বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজকে সাম্যবাদী পরিবর্তিত করার উপায়। এই ব্যবস্থা পুঁজিবাদকে সমর্থন করেনা , কিন্তু বর্তমান মালিকশ্রেণিকে আত্মসংশোধনের সুযোগ দেয়। 

৯. জাতীয়তাবাদ - সম্পর্কিত ধারণা :- 
জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে ধারণা ব্যক্ত করতে গিয়ে গান্ধীজি বলেছিলেন যে , তাঁর কাছে দেশপ্রেম ও মানবতা সমার্থক। তাঁর মতে , ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আগ্রাসী বা ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির নয়। সংকীর্ণ জাতিবিদ্বেষ বা উগ্র স্বাদেশিকতাকে জাতীয়তাবাদে স্থান দেননি গান্ধীজি। তাঁর চিন্তাধারায় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতাবাদের কোনো বিরোধ ছিলনা। 

পরিশেষে বলা যায় যে , গান্ধীজির সত্যাগ্রহ তত্ত্বটিকে অনেকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন। সৈয়দ শাহেদুল্লার মতে , গান্ধির সত্যাগ্রহ হল এমন একটি বুর্জোয়া প্রতারণার ফাঁদ , যা মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি ক'রে জনসাধারণের ক্রোধ ও ঘৃণাকে বিপথে পরিচালিত করেছিল। অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে , গান্ধী তাঁর মনোনীত সত্যাগ্রহী নামধারী প্রবর বা এলিটদের নিয়ে আন্দোলন পরিচালনা করাকে নিরাপদ বলে মনে করতেন। 

কিন্তু উপরিউক্ত সমালোচনা সত্ত্বেও গান্ধীজির সত্যাগ্রহ ধারণার ইতিবাচক দিকটিকে কোনোমতেই উপেক্ষা বা অস্বীকার করা যায়না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অহিংস অসহযোগ আন্দোলন , আইন অমান্য আন্দোলন - ইত্যাদি অহিংস আদর্শের ভিত্তিতে কার্যত গণ আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল। রেজাউল করিম বলেছেন যে , গান্ধীজি ভারতবর্ষকে যে সত্যাগ্রহের আদর্শ দিয়েছেন , তা একটি পরিপূর্ণ জীবনদর্শন। কেননা , স্বাধীনতা লাভই সত্যাগ্রহের একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। সেই সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত ছিল চিত্তশুদ্ধি , সাম্প্রদায়িক ঐক্যসাধন , কুটিরশিল্পের উন্নতিসাধন এবং মানুষের জীবনের নৈতিক চরিত্র গঠন। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সত্যাগ্রহকে কার্যোপযোগী করাই হল তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান।        


     
    

You May Also Like

0 comments