রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব impact of globalization on sovereignty

by - October 09, 2021

রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব আলোচনা কর। 


রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব :- 


বিশ্বায়নের ধারণা :- 

বিশ্বায়ন বা Globalization বিষয়টিকে কোনো একটি নির্দিষ্ট বাক্যে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। বিশ্বায়ন কোনো আকস্মিক প্রক্রিয়া নয় , তা বহু পূর্ব থেকেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিসমাপ্তির পরে বিশ্বায়ন পরিভাষাটির প্রয়োগ নতুন মাত্রা পায়। জোসেফ স্টিগলিট্স এর মতে , বিশ্বায়ন হল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জনগণের মধ্যে এক নিবিড় সংযোগসাধনের প্রক্রিয়া। রোল্যান্ড রবার্টসনের মতে , বিশ্বায়ন এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা সম্প্রসারণের ধারণার সাথে সম্পর্কিত। 
এককথায় বলতে গেলে , বিশ্বায়ন হল বিশ্বব্যবস্থা সম্প্রসারণের এমন এক প্রক্রিয়া যার দ্বারা রাষ্ট্র সংক্রান্ত সমস্ত সংকীর্ণ ধারণার অবসান ঘটে এবং অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক , সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী অবাধ আদান প্রদানের পথ সুগম হয়। পুঁজির অবাধ চলাচল , মুক্ত বাজার অর্থনীতি , উদারীকরণ এবং বেসরকারিকরণ প্রভৃতি বিষয় বিশ্বায়নের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। IMF , World Bank , WTO - ইত্যাদি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নকে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে। 


সার্বভৌমিকতার ধারণা :- 

আধুনিক রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক ও তাৎপর্যপূর্ণ উপাদান হল সার্বভৌমিকতা। সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বের প্রবক্তা বোঁদা -র মতে , Sovereignty is the supreme and perpetual power of state  । রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা চরম , অবাধ , অসীম এবং অবিভাজ্য। রাষ্ট্র ছাড়া কোনো সংঘ বা প্রতিষ্ঠানের অনুরূপ ক্ষমতা ভোগ করার অধিকার নেই। 
অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সার্বভৌমিকতা অনুযায়ী রাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে চরম ক্ষমতার অধিকারী ; রাষ্ট্রীয় নির্দেশ বা আদেশ রাষ্ট্রে অবস্থিত সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রযোজ্য হয়। আবার বাহ্যিক সার্বভৌমিকতা অনুসারে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী হয়। 


রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব :- 


১. জাতি রাষ্ট্রের সংকট :- 
রাজনৈতিক দিক থেকে বিশ্বায়ন জাতি - রাষ্ট্রের সংকট সৃষ্টি করেছে বলে অনেকে মনে করেন। জাতি রাষ্ট্রগুলির সাবেকি চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণা বিশ্বায়নের যুগে বহুলাংশে অচল হয়ে পড়েছে। বিশ্বায়ন জাতি রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাকে খর্ব করে রাষ্ট্রকে একটি বাজারকেন্দ্রিক  সংগঠনে পরিণত করেছে। 

২. সার্বভৌমিকতার চিরাচরিত ধারণার অবসান :- 
অধ্যাপক হলটন তাঁর Globalization and the Nation State গ্রন্থে জাতি - রাষ্ট্রের ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন , জাতি রাষ্ট্রগুলি যে পৃথিবীতে বাস করে তার পরিবর্তন ঘটে চলেছে। বিশ্বায়ন হল সেই পরিবর্তনের একটি প্রধান উৎস। বিশ্বায়নের বিভিন্ন দিক জাতি - রাষ্ট্রগুলির ভূমিকা ও পারস্পরিক সম্পর্কের পরিবর্তন সাধন করেছে। এই ধরণের পরিবর্তন নির্দিষ্ট ভূখন্ডের মধ্যে রাষ্ট্রের চরম সার্বভৌমত্বের চিরাচরিত ধারণার অবসান ঘটাতে পারে। 


৩. রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ :- 
জোসেফ এস নাই এবং জন ডি জোনাহিউ তাঁদের Governance as a Globalization World নামক গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন , বিশ্বায়নের যুগে মূলধনের সচলতা ( Mobility of Capital ) , এক দেশ থেকে অন্য দেশে দক্ষ শ্রমিকের নির্গমন , তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে অর্থ ও শেয়ার হস্তান্তর ইত্যাদি বিষয়গুলির আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। এই বিষয়গুলি সরকারের কর আরোপ করার চিরাচরিত ক্ষমতাকে ব্যাহত করেছে। 

৪. স্বাধীন অর্থনতিক নীতির বিপন্নতা :- 
অনেকে মনে করেন , বিশ্বায়নের ফলে সার্বভৌম জাতি - রাষ্ট্রের স্বাধীন অর্থনতিক নীতি সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের প্রভাবে সমস্ত দেশের অর্থনীতি পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। মূলধন ও প্রযুক্তির বিশাল প্রবাহ পণ্য ও পরিসেবার বাণিজ্যকে সমৃদ্ধতর করেছে। ফলে , বিভিন্ন জাতীয় রাষ্ট্রের অর্থনীতি পরস্পরের সাথে সংযোজিত হয়ে সমগ্র বিশ্বে এক অখন্ড বাজারের প্রবর্তন করেছে। 
বহুজাতিক সংস্থা ( MNC ) , শক্তিশালী আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বৃহদাকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যব্যবস্থা একুশ শতকের বিশ্ব - অর্থনীতির মুখ্য পরিচালক ও নিয়ন্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এভাবে অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের ফলে জাতি - রাষ্ট্রের স্বাধীন অর্থনৈতিক নীতি বিপন্নতার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি কাঠামোগত সংস্কার , সরকারি ক্ষেত্রগুলির বেসরকারিকরণ ও বিলগ্নিকরণ , ভর্তুকি প্রত্যাহার , কর্মী সংকোচন - প্রভৃতি নীতির রূপায়ণ করতে বাধ্য হচ্ছে। 

৫. রাষ্ট্রব্যবস্থার মর্যাদা হ্রাস :- 
বিশ্বায়নের ফলে রাষ্ট্রব্যবস্থা তার চিরাচরিত প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলেছে। বিশ্বায়নের প্রভাবে একদিকে পৃথিবীতে ক্রমাগত আঞ্চলিক ও বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ বেড়ে চলেছে ; অন্যদিকে , জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থাগুলির সংখ্যা ক্রমশঃ হ্রাস পাচ্ছে। এই পটভূমিকায় সার্বভৌমত্বের সাবেকি ব্যাখ্যা অচল হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য হল , বিশ্বায়ন শুধুমাত্র স্বায়ত্তশাসনকে খর্ব করেনি , বিশ্বায়ন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক , সামাজিক , জাতীয় এবং আঞ্চলিক পরিকাঠামোকে পরিবর্তিত করেছে। নতুন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের চিরাচরিত ক্ষমতা বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। 

পরিশেষে , অধ্যাপক ডেভিড হেল্ডের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলা যায় , বিশ্বায়নের প্রতিকূল প্রভাব সকল রাষ্ট্রের ওপর সমানভাবে পড়েনি। অনগ্রসর ও উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। অধ্যাপক হেল্ডের মতে , তা স্বত্বেও আইনানুগ সার্বভৌমিকতার ধারণার বাধ্যবাধকতা অব্যাহত রয়েছে। তবে জটিল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ফলে রাষ্ট্রের স্বাধিকার বর্তমানে সীমিত হয়ে পড়েছে।  



You May Also Like

0 comments