ইন্দো - গ্রিক কারা ছিল ? ইন্দো - গ্রিকদের অবদান ; Indo - Greek

by - August 05, 2021

ইন্দো - গ্রিক কারা ছিল ? ভারত ইতিহাসে তাঁদের অবদান আলোচনা কর। 

অথবা , ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ইন্দো - গ্রিকদের অবদান আলোচনা করো। 



ইন্দো - গ্রিকদের পরিচয় :- 

মৌর্য সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কিছু বৈদেশিক জাতি ভারতে প্রবেশ করতে শুরু করে , যাদের মধ্যে অন্যতম ছিল ইন্দো - গ্রিকরা। হিন্দুকুশ পর্বত ও অক্ষু নদীর মধ্যভাগে যে অঞ্চলটি অবস্থিত তার নাম ব্যাকট্রিয়া। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর গ্রিক সাম্রাজ্যের পূর্বাংশের অধিপতি হন সেলুকাস। সিরিয়া ছিল এই সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র। তবে সেলুকাসের দুর্বল বংশধরদের শাসনকালে ব্যাকট্রিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। বেশ কিছু গ্রিক শাসক যেমন -  অ্যান্টিওকাস , ডিমিট্রিয়াস , ইউক্রাটিডিস , মিনান্দার - প্রমুখ শাসকগণ দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলে স্বশাসনে বহাল ছিলেন - যাঁদের ইন্দো - গ্রিক বা যবন বলা হয়ে থাকে। 


১. সামাজিক ক্ষেত্রে ইন্দো - গ্রিকদের অবদান :- ভারতে আসর পর গ্রিকদের সামাজিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। তাঁরা নিজেরা উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির অধিকারী ছিলেন। ভারতীয়দের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁরা তীব্র আকর্ষণবোধ করেন। ভারতীয় রীতিনীতি , আচার - সংস্কার অনুসরণ করে তাঁরা ভারতীয় সমাজের অঙ্গীভূত হন। অন্যদিকে গ্রিকরা ভারতীয়দের সংস্পর্শে আসায় ভারতীয় ও ইন্দো - গ্রিক সংস্কৃতির আদান - প্রদান সংঘঠিত হয়। 

২. ভাস্কর্য ক্ষেত্রে ( গান্ধার শিল্প ) অবদান :- অনেক ইউরোপীয় পন্ডিতদের ধারণা গান্ধারের ইন্দো - গ্রিকরা শিল্পীরাই সর্বপ্রথম বুদ্ধমূর্তি তৈরী করেন। গান্ধার শিল্পের উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে গ্রিক শিল্পীদের অবদানের কথা অস্বীকার করা যায় না। গান্ধার বুদ্ধের কেশবিন্যাস , পরিধানের ধরণ , দৈহিক গঠন - সবই গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর মত। তবে একথাও ঠিক যে , গ্রিক শৈলীর ছত্র - ছায়ায় গড়ে উঠলেও গান্ধারশিল্প ব্যাকট্রীয় গ্রিক পর্বে আত্মপ্রকাশ করেনি , আত্মপ্রকাশ করেছিল শক - পহ্লব পর্বে। 

৩. সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদান :- সংস্কৃত সাহিত্যে , বিশেষ করে নাটকের ক্ষেত্রে , গ্রিকদের অবদান উল্লেখযোগ্য। পন্ডিতদের মতে , গ্রিকদের অনুকরণেই সংস্কৃত নাটকে পর্দা বা যবনিকার ব্যবহার শুরু হয়। সংস্কৃত নাটকে '' সূত্রধার '' এর ভূমিকার ক্ষেত্রেও গ্রিক প্রভাব স্পষ্ট। অভিজ্ঞান শকুন্তলম নাটকে ইউরিপিডেস , মিনান্দার - প্রমুখ গ্রিক নাট্যকারদের কিছু প্রভাব লক্ষ্য করা যায় বলে কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করে থাকেন। 


৪. ভারতীয় মুদ্রায় ইন্দো - গ্রিকদের অবদান :- ভারতীয় মুদ্রায় গ্রিক মুদ্রার বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মুদ্রায় রাজার নাম , সন - তারিখ , দেব - দেবীর মূর্তি - এসব বৈশিষ্ট ভারতীয়রা গ্রিকদের কাছ থেকেই আয়ত্ত করে। আবার ভারতীয় মুদ্রাও গ্রিক মুদ্রার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। সম্ভবতঃ গ্রিক টাঁকশালে গ্রিক শিল্পীদের সঙ্গে ভারতীয় শিল্পীরাও কাজ করতেন। 

৫. অ্যান্টিওকাস - এর অবদান :- সেলুকাসের বংশধর অ্যান্টিওকাস ব্যাকট্রিয়া পুনরুদ্ধারকালে তাঁর সামনে বড় বাধা ছিল তৎকালীন বাকট্রিয়ার শাসক ইউথাইডেমস। কিন্তু অ্যান্টিওকাস সুকৌশলে ইউথাইডেমস - এর পুত্র ডিমিট্রিয়াসের সাথে গোপন চুক্তি ২০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাকট্রিয়া দখল করে শাসনভার নিজ হাতে তুলে নেন। এমনকী গান্ধারের শাসক সম্রাট অশোকের প্রপৌত্র সুভগসেনও তাঁর সাথে মিত্রতা স্থাপন করতে বাধ্য হন। তবে অ্যান্টিওকাস পুরোপুরিভাবে ভারতে প্রবেশ না করলেও ব্যাকট্রীয় গ্রিকদের ভারতে প্রবেশের পথ দেখিয়েছিলেন - একথা বলা যায়। তাঁর সময়কাল থেকেই ইন্দো - গ্রিক সংস্কৃতির সাথে ভারতীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধনের সূত্রপাত হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করে থাকেন। 

৬. ডিমিট্রিয়াসের অবদান :- ইউথাইডেমস - এর পুত্র ছিলেন ইন্দো - গ্রিক সম্রাট ডিমিট্রিয়াস যিনি ইন্দো - গ্রিক সাম্রাজ্যসীমা বৃদ্ধিতে অধিক তৎপর ছিলেন। সিংহাসনারোহন করেই তিনি দক্ষিণ আফগানিস্তান , পাঞ্জাব , নিম্ন - সিন্ধু অঞ্চল নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। এছাড়া তাঁর অন্যতম অবদান গ্রিক ও প্রাকৃত ভাষায় তিনি দ্বি - ভাষী মুদ্রার প্রচলন করেন। তাঁর আমলেই গ্রিক ও খরোষ্ঠী উভয় লিপির ব্যবহার শুরু হয়। ঐতিহাসিক জে এল বন্দোপাধ্যায়ের মতে , আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করলেও তার চেয়ে অধিকভাবে ভারতে শাসনকার্য স্থায়ী হয়েছিল ডিমিট্রিয়াসের সময়ে। 


৭. ইউক্রাটিডিস - এর অবদান :- ১৭১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ডিমিট্রিয়াস যখন ভারত অভিযানে মগ্ন ছিলেন সেই সুযোগে সেনাপতি ইউক্রাটিডিস ব্যাকট্রীয় সিংহাসন দখল করেন। তিনি ব্যাকট্রীয়দের নতুন রাজধানী স্থাপন করেন শাকল বা বর্তমান শিয়ালকোট নামক স্থানে। ১৬৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ডিমিট্রিয়াসের মৃত্যুর পর ইউক্রাটিডিস সমগ্র ব্যাকট্রিয়া সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়েছিলেন। তার আমলে গ্রিক ও ভারতীয়দের মধ্যে সংস্কৃতিক বিনিময় ছিল উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও শিয়ালকোট শহরের উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। 

৮. মিনান্দারের অবদান :- ইন্দো - গ্রিক রাজাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ছিলেন মিনান্দার। একাধিক গ্রিক ঐতিহাসিকদের মতে , মিনান্দার ছিলেন ইন্দো - গ্রিক শাসকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। কাবুল থেকে শুরু করে পূর্ব মথুরা পর্যন্ত সুদীর্ঘ অঞ্চল পর্যন্ত মিনান্দারের মুদ্রার সন্ধান পাওয়া যায়। ইন্দো - গ্রিক কিংবদন্তি নাগসেন রচিত বৌদ্ধগ্রন্থ '' মিলিন্দ পঞ্চহো '' - তে বর্ণিত মিলিন্দকে অনেকেই মিনান্দার বলে মনে করেছেন। ইন্দো - গ্রিক রাজাদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বাপেক্ষা সফল যোদ্ধা ও সুশাসক। 

পরিশেষে বলা যায় , প্রাচীন ভারতে একাধিক বৈদেশিক জাতি ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপন করলেও আসলে দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন ইন্দো - গ্রিকগণ। ব্যাকট্রীয় গ্রীকগণ প্রায় দু 'শো বছর রাজত্ব করেন। এই দু 'শো বছর রাজত্বকালে তাঁরা ভারতীয় শিক্ষা , ধর্ম , সংস্কৃতি - ইত্যাদির সাথে গভীর সংযোগ গড়ে তোলেন এবং উভয় সংস্কৃতি একে - অপরকে প্রভাবিত করে। মৌর্য শাসকদের পরবর্তীকালে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে অচলাবস্থা তৈরী হয়েছিল , ইন্দো - গ্রিক শাসকগণ উত্তর - পশ্চিম ভারতে সেই অচলাবস্থা দূর করতে সক্ষম হন। গ্রিকরাজ হারমিওস পহ্লবদের কাছে পরাজিত হলে ভারতে গ্রিক শাসনের অবসান ঘটে।   

  
   

You May Also Like

0 comments