ভক্তি আন্দোলনের প্রভাব। ভক্তি আন্দোলনের ফলাফল ও গুরুত্ব।
ভক্তি আন্দোলনের প্রভাব।
ভক্তি আন্দোলনের ফলাফল ও গুরুত্ব।
ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন যে , ভক্তিবাদী আন্দোলন প্রচলিত হিন্দু সমাজ ও ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারেনি। ডক্টর আশির্বাদীলাল শ্রীবাস্তব বিষয়টিকে একটু স্বতন্ত্রভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে , ভক্তিবাদের দুটি লক্ষ্য ছিল - হিন্দুধর্মের সংস্কার সাধন করে তাকে সরল রূপ দেওয়া এবং হিন্দু - মুসলিমের বিভেদ কমিয়ে দুই সম্প্রদায়ের মানুষকে কাছাকাছি আনা। প্রথম লক্ষ্যটি অনেকাংশে সফল হলেও দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি ব্যর্থ হয়। কেননা , রাম ও রহিম এক - ভক্তিবাদের এই তত্ত্ব গোঁড়া হিন্দু বা মুসলিম কেউই মানতে রাজি ছিলেন না।
আবার , বহু মানুষ সামাজিক অসাম্যের হাত থেকে মুক্তি পেতে ভক্তি আন্দোলনে যোগদান করেন , কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের কোনো ক্ষমতা তাঁদের হাতে ছিল না। ভক্তিবাদী সাধকেরা আন্তরিকভাবে ভক্তির বাণী প্রচার করলেও তাঁদের অনুগামীদের মধ্যে সেই ত্যাগ ও উদারতা ছিল না। বিভিন্ন সাধকের অনুগামীরা অচিরেই পৃথক পৃথক গোষ্ঠী তৈরী করেন এবং এর ফলে সামাজিক বিভেদ আরও বৃদ্ধি পায়।
তবে এসব স্বত্তেও ভারতীয় জনজীবনে ভক্তি আন্দোলন গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কেবলমাত্র সমকালীন ধর্মীয় জীবনই নয় , তার সাথে সাথে সামাজিক , সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে ভক্তিবাদের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
১. প্রথমতঃ দীর্ঘদিন ধরে যে হিন্দু - মুসলিম বিভেদ চলছিল , ভক্তিবাদের প্রভাবে তার তীব্রতা বহুলাংশে হ্রাস পায়। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হতে থাকে। একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে , পরবর্তীকালে সম্রাট আকবরের উদার ধর্মনীতির ভিত্তি এই যুগেই রচিত হয়।
২. দ্বিতীয়তঃ ধর্মাচার্যগণ হিন্দুধর্মে নানা সংস্কার প্রবর্তন করে ইসলাম ধর্মের অগ্রগতি রোধ করতে সাহায্য করেন।
৩. তৃতীয়তঃ ভক্তিবাদের মাধ্যমে সমাজে জাতিভেদ ও উচ্চ - নীচ বৈষম্য বহুলাংশে খর্ব হয় এবং বর্ণাশ্রম প্রথার কঠোরতা কিছুটা শিথিল হয়।
৪. চতুর্থতঃ ধর্মাচার্যগণ নারী - পুরুষে ভেদাভেদ মানতেন না। নারীরা অবাধে ধর্মসভায় যোগদান করতেন। এর ফলে তাঁদের সামাজিক মর্যাদা পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পায়।
৫. পঞ্চমতঃ ধর্মপালনের ক্ষেত্রে সকল বাহ্যিক আচরণ ও অনুষ্ঠানকে বর্জন করে ভক্তিবাদীরা বিভিন্ন সামাজিক ব্যাধি দূর করতে সক্ষম হন।
৬. ষষ্ঠতঃ ধর্মপ্রচারকেরা সকলেই স্থানীয় ভাষাতেই তাঁদের উপদেশ দান করতেন। এর ফলে এইসব আঞ্চলিক ভাষাগুলি নবীন মর্যাদায় ভূষিত হয়। নামদেব , একনাথ প্রমুখ সংস্কারকদের পদাবলী মারাঠি সাহিত্যের ভিত্তি স্থাপন করে। কবীরের দোঁহা হিন্দি ভাষা ও নানকের উপদেশাবলী পাঞ্জাবি ভাষা ও গুরুমুখি লিপিকে সমৃদ্ধ করে। বাংলার বৈষ্ণব কবিরা বাংলা ভাষাকে নতুন রূপ দান করেন।
৭. সপ্তমতঃ ধর্মপ্রচারকেরা তাঁদের উপদেশ দানকালে সংস্কৃত ভাষায় লিখিত বহু তত্ত্ব ও তথ্য প্রচার করতেন। সে যুগে জনসাধারণের সঙ্গে সংস্কৃতের বিশেষ যোগাযোগ ছিল না এবং তার ফলে জনসাধারণ ঐসকল তত্ত্ব ও তথ্য হতে অজ্ঞাত ছিল। কিন্তু স্থানীয় ভাষার মাধ্যমে তত্ত্ব ও তথ্যগুলি প্রচারিত হওয়ার ফলে জনমানসে ভারতীয় সভ্যতা , সংস্কৃতি , ধর্ম ও ঐতিহ্য সম্পর্কে এক শ্রদ্ধাশীল মনোভাবের সৃষ্টি হয়।
৮. অষ্টমতঃ ভক্তিবাদের মাধ্যমে ধর্মীয় ও সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে সকল মানুষের মধ্যে ভাতৃত্বের ও সামাজিক সাম্যের যে বাণী প্রচারিত হয়েছিল জনমানসের ওপর - তার প্রভাব অস্বীকার করা যায় না।
৯. নবমতঃ ভক্তিবাদের আদর্শ ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারগুলির ওপর যথেষ্ট আঘাত হেনেছিল।
১০. দশমতঃ ঈশ্বরের কাছে জীবমাত্র সকলেই সমান এবং সকল মানুষই ঈশ্বর প্রেমের অধিকারী - ভক্তিবাদের এই আদর্শ সমাজের অবহেলিত মানুষদের মধ্যে এক নতুন আশার সঞ্চার করে।
0 comments