বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা :- Administrative System of the Vijaynagar Empire :-

by - August 08, 2021

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা :- 

Administrative System of the Vijaynagar Empire :- 



বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা :- 


রাজা : সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী :- 
বিজয়নগরের নরপতিরা এক সুষ্ঠ শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। শাসনব্যবস্থায় সর্বময় কর্তা ছিলেন রাজা। শাসন - বিচার - বিচার - সমর প্রতিটি বিভাগের সর্বেসর্বা হলেও রাজা কখনই স্বৈরাচারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন প্রজাহিতৈষী। বিজয়নগরের রাজারা ধর্মশাস্ত্র অনুসারে শাসন পরিচালনা করতেন। রাজা কৃষ্ণদেব রায় তাঁর '' আমুক্ত মাল্যদা '' গ্রন্থে বলেছেন যে - ধর্মের প্রতি লক্ষ্য রেখে রাজ্যশাসন করাই হল রাজকর্তব্য। 


মন্ত্রিপরিষদ ও রাজসভা :- 
শাসনকার্যে রাজাকে সাহায্য করার জন্য একটি মন্ত্রিপরিষদ ছিল। মন্ত্রীগণ রাজা কর্তৃক নিযুক্ত ও পদচ্যুত হতেন। ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য - এই তিন শ্রেণির মধ্যে থেকে মন্ত্রিদের নিয়োগ করা হত। যদিও মন্ত্রিত্বের প্রধান দাবিদার ছিলেন ব্রাহ্মণরা এবং এ ব্যাপারে তারাই প্রাধান্য পেতেন। মন্ত্রীপদ অনেকসময় বংশানুক্রমিকও হত। 
প্রধানমন্ত্রীকে বলা হত মহাপ্রধান। তিনি শাসনকার্যে বিশেষ ক্ষমতা ভোগ করতেন। মন্ত্রীদের সংখ্যা ছিল সাধারণত ৬ - ৮ জন। মন্ত্রী ব্যতীত কোষাধক্ষ্য , বাণিজ্য সচিব , পুলিশ বাহিনীর অধিনায়ক , অশ্ব বাহিনীর অধিনায়ক - প্রভৃতি বিভিন্ন রাজকর্মচারী উল্লেখ পাওয়া যায়। 
বিজয়নগরের রাজারা একটি জাঁকজমকপূর্ণ রাজসভা স্থাপন করেছিলেন। এই সভায় বহুসংখ্যক পন্ডিত , পুরোহিত , সাহিত্যিক , জ্যোতিষী , সংগীতজ্ঞ - প্রমুখ জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের দ্বারা অলংকৃত ছিল। পারস্যের রাজদূত আবদুর রজ্জাক ও পর্তুগিজ পর্যটক নুনিজ বিজয়নগরে একটি '' মহাকরণ '' এর উল্লেখ করছেন। 


প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা :- 
শাসনকার্যের সুবিধার জন্য সমগ্র সাম্রাজ্য কয়েকটি '' মন্ডলম '' বা প্রদেশে বিভক্ত ছিল। পর্তুগিজ পর্যটক পায়েজ বিজয়নগরে ২০০ টি প্রদেশের অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে ডক্টর কৃষ্ণশাস্ত্রীর মতে , বিজয়নগর সাম্রাজ্যে প্রদেশের সংখ্যা ছিল ৬ টি। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের ' নায়ক ' বা ' নায়েক ' বলা হত। তাঁরা সাধারণত রাজপরিবার ও অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকেই নিযুক্ত হতেন। প্রাদেশিক শাসনকর্তারা নিজ নিজ এলাকায় কর্মচারী নিয়োগ করতেন , প্রাদেশিক বিচারকার্য সম্পাদন করতেন , রাজস্ব আদায় করতেন এবং সম্রাটের প্রয়োজনে সেনা সরবরাহ করতেন। কেন্দ্রের সঙ্গে সর্বদা তাঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে হত। 

জেলা ও গ্রামের শাসন ব্যবস্থা :- 
প্রদেশগুলি ' নাড়ু ' বা জেলায় বিভক্ত ছিল এবং জেলাগুলি ' স্থল ' বা মহকুমায় বিভক্ত ছিল ও স্থলগুলি গ্রাম - এ বিভক্ত ছিল। গ্রাম ছিল শাসনব্যবস্থার সর্বনিম্ন স্তর। গ্রামগুলি স্ব - শাসন ভোগ করত এবং সেখানে পঞ্চায়েত - এর উপরে গ্রামের পুলিশ , বিচার ও শাসনভার ন্যাস্ত ছিল। '' মহানায়কাচার্য '' নামে এক শ্রেণির কর্মচারী গ্রামের শাসনকার্য তদারক করতেন এবং তাদের মাধ্যমেই কেন্দ্রীয় সরকার গ্রামগুলির ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতেন। 

রাজস্ব - ব্যবস্থা :- 
বিজয়নগর সাম্রাজ্যে বিভিন্ন ধরণের কর প্রচলিত ছিল। খেয়া কর , শিল্পকর , বাণিজ্য শুল্ক , বিক্রয় কর , গোচারণ কর - ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের কর থেকে প্রভূত রাজস্ব আয় হত। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমিকর। উৎপন্ন শস্যের এক - ষষ্ঠাংশ ভূমিরাজস্ব হিসেবে গৃহীত হত। অর্থ বা শস্য দ্বারা রাজস্ব প্রদানের রীতি প্রচলিত ছিল। রাজস্ব সংক্রান্ত সকল কার্য পরিচালনার জন্য একটি পৃথক দপ্তর ছিল। 


সামরিক বিভাগ :- 
বিজয়নগর সাম্রাজ্যে সামন্তসেনা ছাড়াও রাজার নিজস্ব সেনাবাহিনী বা কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল। পদাতিক , অশ্বারোহী , গোলন্দাজ , উষ্ট্র ও হস্তীবাহিনী নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সেনাবাহিনী গঠিত ছিল। সেনাবাহিনীতে হিন্দু , মুসলিম - সকল সম্প্রদায়ের মানুষের যোগদান করার সুযোগ ছিল। সৈন্যের বিচারে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল বিশাল। কৃষ্ণদেব রায়ের সেনাবাহিনীতে ৭ লক্ষ পদাতিক , ৩৬০০ টি অশ্ব ও ৬৫০ টি হস্তি ছিল। কৃষ্ণদেব রায়ের আমলে গোলন্দাজ বাহিনীরও উল্লেখ পাওয়া যায়। সেনাদলকে শক্তিশালী করার জন্য পর্তুগিজদের সাহায্যে আরবদেশ থেকে উন্নত জাতের ঘোড়া আমদানি করা হত। এছাড়াও সেনাবাহিনীতে তুর্কি তীরন্দাজ নিয়োগের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে দক্ষিণ ভারত নদীপ্রধান অঞ্চলে স্থাপিত হলেও নৌবাহিনী গড়ার দিকে বিজয়নগরের শাসকেরা নজর দেন নি। ''দন্ডনায়ক'' উপাধিধারী প্রধান সেনাপতির হাতে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব অর্পিত ছিল। 

বিচার - ব্যবস্থা :- 
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের বিচারব্যবস্থায় রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক ও আইন প্রণেতা। অন্যান্য বিচারকগণ রাজা কর্তৃক নিযুক্ত ও পদচ্যুত হতেন। প্রজাদের সুবিধার্থে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে বহু বিচারালয় স্থাপিত ছিল। গ্রামাঞ্চলে পঞ্চায়েতের উপর বিচারের ভার ন্যাস্ত ছিল। বিদেশি পর্যটকদের বিবরণী থেকে জানা যায় যে , দন্ডবিধি অত্যন্ত কঠোর ছিল। দোষী ব্যক্তির জরিমানা , কারাবাস , সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ - ইত্যাদি শাস্তির প্রচলন ছিল। 

শাসনব্যবস্থার ত্রুটি :- 
বিজয়নগরের শাসনব্যবস্থা ত্রুটিমুক্ত ছিল না। 

প্রথমতঃ প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সামন্তপ্রভুদের হাতে প্রভূত ক্ষমতা থাকায় কেন্দ্রীয় সরকার দুর্বল হয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় সরকারের সামান্যতম দুর্বলতার সুযোগে প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সামন্তপ্রভুরা স্বাধীনতা ঘোষণা করত।    

দ্বিতীয়তঃ বিজয়নগরের সামরিক ব্যবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। রাজা কৃষ্ণদেব রায় ছাড়া আর কারো হাতে বিরাট কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল না। ফলে রাজা সৈন্যের ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সামন্তপ্রভুদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। 

তৃতীয়তঃ বিজয়নগর সাম্রাজ্যে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য প্রচলিত থাকলেও তা ছিল নগন্য। বিজয়নগরের নৃপতিগণ অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বিস্তারের জন্য কোনো বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন নি। তাদের অর্থনীতির সিংহভাগ কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল। 

চতুর্থতঃ বিজয়নগর সাম্রাজ্য নদীবহুল ও সমুদ্রবেষ্টিত হওয়া স্বত্তেও বিজয়নগরের নৃপতিরা শক্তিশালী নৌ - বাহিনী স্থাপনের কোনো চেষ্টাই করেন নি। 

পঞ্চমতঃ অধিক শুল্ক লাভের আশায় তাঁরা ভারতের পশ্চিম উপকূলে পর্তুগিজদের বসবাসের সুযোগ করে দেন - যা পরবর্তীকালে মারাত্মক ভুল বলে বিবেচিত হয়।     

 

You May Also Like

0 comments