শের শাহের শাসনব্যবস্থা Administrative reforms of Sher Shah .

by - August 08, 2021

শের শাহের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর। 

অথবা , শের শাহের শাসন সংস্কারগুলি সম্পর্কে আলোচনা কর। 

Administrative reforms of Sher Shah .




শের শাহের শাসনব্যবস্থা :- 

ঐতিহাসিক Keen তাঁর " Turks in India " নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে , কোনো সরকার - এমনকি ব্রিটিশ সরকারও শের শাহের মত বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারে নি। ( '' No Government - not even the British has shown so much wisdom as this Pathan . '' - Keen ) । অতি অল্প সময়ের জন্য ( ১৫৪০ - ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দ ) তিনি মধ্যযুগের ভারতে এক উজ্জ্বল তারকারূপে আবির্ভুত হন। কিন্তু এই অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি শাসনকার্যে যে বিচক্ষণতার পরিচয় রেখে যান তা পরবর্তীকালের শাসকদের প্রভাবিত করেছিল। 


শের শাহের নরপতিত্বের আদর্শ :- 
তাঁর পূর্বসূরীদের মত শের শাহ স্বৈরাচারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারী শাসক । তাঁর নরপতিত্বের আদর্শ ছিল প্রজাদের মঙ্গলের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা। ভারতের মুসলমান শাসকদের মধ্যে শের শাহই সর্বপ্রথম জনগণের শুভেচ্ছার ওপর ভিত্তি করে সাম্রাজ্য স্থাপনে প্রয়াসী হয়েছিলেন। ঐতিহাসিক Crooke এর ভাষায় , '' Sher Shah was the first who attempted to found an empire broadly based upon people's will . '' 

শাসন - ব্যবস্থার প্রকৃতি সম্পর্কে কানুনগো , ত্রিপাঠি ও শরণের মন্তব্য :- 
ডক্টর কানুনগোর মতে , আকবর অপেক্ষা শের শাহের সাংগঠনিক প্রতিভা ছিল অনেক বেশি। ডক্টর ত্রিপাঠি ও ডক্টর শরণের মতে , শের শাহ ছিলেন শাসনতান্ত্রিক সংস্কারক মাত্র , আবিস্কারক নন। তিনি আলাউদ্দিন খলজির শাসনব্যবস্থার পুনঃ প্রবর্তন করেছিলেন মাত্র ; শাসন ব্যবস্থায় তাঁর কোনো মৌলিকতার পরিচয় পাওয়া যায়নি। ডক্টর ত্রিপাঠি লিখেছেন - '' Sher Shah was not an innovator . His sole aim was to revitalise the government and introduce efficiency .'' 


হিন্দু ও মুসলমান শাসনপদ্ধতির সমন্বয় :- 
শের শাহের শাসন ব্যবস্থার মূলনীতি ছিল হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সমন্বয়সাধন করা। তাঁর নীতি পর্যালোচনা করলে তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ভারতীয় জীবন ও শাসন ব্যবস্থার ত্রুটি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর বিবিধ শাসন সংস্কার ও প্রজাকল্যাণমূলক কার্যাদি তাঁকে অমরত্ব দান করেছে। 
The whole of his brief administration was based on the principle of Union . - keen . 

কেন্দ্রীয় শাসন :- 
কেন্দ্রীয় শাসন তথা সমগ্র রাষ্ট্রের সর্বোচ্চে ছিলেন সুলতান স্বয়ং। কিন্তু সুচারুরূপে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য শের শাহ চারজন মন্ত্রী নিযুক্ত করেন - দেওয়ানে উজীরাৎ , দেওয়ানে আৰ্জ , দেওয়ানে রিসালাৎ ও দেওয়ানে ইন্স। একেক জন মন্ত্রীর ওপর এক একটি বিভাগের দায়িত্ব অর্পিত ছিল। মন্ত্রীগণ ছাড়াও আরো দুটি উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী উল্লেখ পাওয়া যায় - দেওয়ানে কাজী ও দেওয়ানে বারিদ। 

সাম্রাজ্যের বিভাগ :- 
শাসনকার্যের সুবিধার জন্য শের শাহ তাঁর সাম্রাজ্যকে ৪৭ টি সরকার বা ভাগে বিভক্ত করেন। শিকদারে - শিকদারান ও মুনসিফে - মুন্শিফান - নামক দুজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীর হাতে সরকারের শাসনভার ন্যাস্ত থাকত। 
প্রত্যেকটি সরকার কয়েকটি পরগনা নিয়ে গঠিত ছিল। পরগনার কর্মচারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শিকদার , আমিন ও মুনসিফ। এছাড়াও রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে সংযোগ রক্ষার জন্য - পাটওয়ারী , চৌধুরী ও মুকাদ্দম নামে কয়েকজন কর্মচারী ছিলেন। এছাড়া গ্রামের শাসনভার স্থানীয় পঞ্চায়েতের ওপর ন্যাস্ত ছিল। 


রাজস্ব নীতি : 

জমি জরিপ ব্যবস্থা :- শের শাহ রাজস্ব নীতির প্রয়োজনীয় সংস্কারসাধন করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের সুবিধার জন্য তিনি সমগ্র সাম্রাজ্যের আবাদি ও অনাবাদি জমি জরিপ করার ব্যবস্থা করেন। স্থানীয় কর্মচারীদের ওপর জমি জরিপ ও খাজনা আদায়ের ভার দেওয়া হয়। উৎপাদিকা শক্তির অনুপাতে জমিগুলিকে তিনভাগে বিভক্ত করা হয়। উৎপন্ন শস্যের অথবা শস্যের মূল্যের এক - তৃতীয়াংশ বা এক - চতুর্থাংশ রাজস্ব হিসেবে ধার্য করা হয়। চৌধুরী ও মুকাদ্দমরা রাজস্ব আদায় করতেন। 

কবুলিয়ত ও পাট্টা - র প্রচলন :- শের শাহ কবুলিয়ত ও পাট্টা প্রথার প্রচলন করেন। এই দুটি শর্তপত্রে সরকার ও কৃষকদের দেনা - পাওনার কথা স্পষ্টভাবে লেখা থাকত। 

অতিরিক্ত খাজনা বা সেস :- বিঘা প্রতি কিছু অতিরিক্ত শস্য বা সেস আদায় করা হত। এর উদ্দেশ্য ছিল অজন্মা বা দুর্ভিক্ষের সময় প্রজাবর্গকে সহায়তা করা। 

শুল্ক :- সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে তিনি নানা ধরণের অবৈধ শুল্ক বাতিল করে দিয়ে তিনি ব্যবসা - বাণিজ্যের চলাচল সহজ করেন। একমাত্র সীমান্ত ও বিক্রয়স্থানেই শুল্ক ধার্য করার রীতি প্রচলিত হয়। 

মুদ্রা সংস্কার :- 
শের শাহের আমলের বহু পূর্ব হতেই মুদ্রাব্যবস্থায় বহুবিধ দুর্নীতি প্রবেশ করছিল। জাল মুদ্রার ব্যাপক প্রচলন ছিল। বিভিন্ন ধাতুতে নির্মিত মুদ্রার কোনোরূপ নির্ধারিত মূল্য ছিল না। এই সকল অসুবিধা দূর করার উদ্দেশ্যে শের শাহ '' দাম '' নামক একপ্রকার নতুন মুদ্রার প্রচলন করেন। তিনি প্রাচীন ও মিশ্রিত মুদ্রার প্রচলন বন্ধ করেন। তিনি স্বর্ণ মুদ্রারও প্রচলন করেন। মুদ্রানীতির সংস্কার ছিল শের শাহের অন্যতম কৃতিত্ব। 


বিচারব্যবস্থা :- 
শের শাহ নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচারের ভার কাজী ও মীরে - আদল - নামক কর্মচারীর উপর ন্যাস্ত থাকত। পঞ্চায়েত দ্বারা হিন্দুদের দেওয়ানি মামলার নিস্পত্তি করা হত। কিন্তু ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে হিন্দুদের সাধারণ বিচারালয়ে আসতে হত। দন্ডবিধি অত্যন্ত কঠোর ছিল ; এমনকি প্রাণদন্ড দেওয়ারও প্রচলন ছিল। 

পুলিশী শাসনব্যবস্থা :- 
শান্তিরক্ষার জন্য পুলিশী ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত উন্নত। অপরাধীদের দমন করার জন্য তিনি '' স্থানীয় দায়িত্ব নীতি '' গ্রহণ করেন। পুলিশ বিভাগকে সাহায্য করার জন্য মহতাসিব নামক কর্মচারীরা নিযুক্ত থাকতেন। তাঁরা জনসাধারণের নৈতিক জীবনের প্রতি দৃষ্টি রাখতেন। 

সেনাবাহিনী :- 
শের শাহের সেনাবাহিনীতে দুর্ধর্ষ আফগানদের নিযুক্ত করার ব্যবস্থা করেন। আফগান ছাড়াও হিন্দু ও অন্যান্য জাতির লোকেদেরও সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হত। শের শাহের অন্যতম এক সেনাধ্যক্ষ ব্রহ্মজিৎ গৌড় নামে এক হিন্দু। সামন্তপ্রথার বিলোপ ঘটিয়ে শের শাহ সেনাবাহিনীর ওপর প্রত্যক্ষ কর্তৃত্ব স্থাপন করেন। আলাউদ্দিন খলজির আদর্শ অনুসরণ করে তিনি স্থায়ী সেনাবাহিনী স্থাপনে প্রয়াসী হন। সেনাদের আংশিক জায়গির ও আংশিক নগদে বেতন দেওয়ার রীতি প্রচলিত হয়। 

সেনাবাহিনী অশ্বারোহী , পদাতিক ও গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে প্রধানত গঠিত ছিল। আলাউদ্দিন খলজির সামরিক নীতি অনুসরণ করে তিনি সেনাবাহিনীতে '' দাঘ '' ও '' হুলিয়া '' ব্যবস্থার পুনঃ প্রবর্তন করেন। এছাড়া , সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে তিনি সেনা মোতায়নের ব্যবস্থা করে বৈদেশিক আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। 

যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সড়ক নির্মাণ :- 
সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের ব্যাপারে শের শাহ মনোযোগী ছিলেন। তিনি বহু সুদীর্ঘ সড়ক নির্মাণ করেন। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল - পূর্ববঙ্গের সোনারগাঁও থেকে সিন্ধুনদ পর্যন্ত ১৪০০ মাইল শের শাহ সূরী সড়ক বা গ্র্যান্ড ট্যাঙ্ক রোড। এছাড়াও , আগ্রা থেকে বুরহানপুর ; আগ্রা থেকে যোধপুর ও চিতোর ; লাহোর থেকে মুলতান - ইত্যাদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কপথ শের শাহ নির্মাণ করেছিলেন। 

ডাক ও গুপ্তচর বিভাগ :- 
ঘোড়ার পিঠে করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ডাক চলাচলের ব্যবস্থা শের শাহই সর্বপ্রথম প্রবর্তন করেন। সরাইখানাগুলি ডাক - চৌকি রূপে ব্যবহৃত হত। প্রতিটি সরাইখানাতে দুটি করে ঘোড়া সর্বদা প্রস্তুত থাকত। 
রাজ্যের বিভিন্ন অংশের সংবাদ সংগ্রহের জন্য তিনি বহু গুপ্তচর নিয়োগ করেন। গুপ্তচর বিভাগের প্রধানকে বলা হত '' দারোগায়েডাক ''।  

ধর্মনীতি :- 
শের শাহের ধর্মনীতি প্রসঙ্গে মতভেদ রয়েছে। ডক্টর কানুনগোর মতে , শের শাহের ধর্মনীতি ছিল উদার। কিন্তু কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে , শের শাহ নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন ; তবে অন্য ধর্মের প্রতি যে তিনি সর্বদা উদার মনোভাব পোষণ করতেন - এমনটা নয়। যাইহোক , শের শাহ রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে উদার ধর্মনীতি গ্রহণ করেন , শাসন ব্যবস্থায় হিন্দু - মুসলিম সমন্বয় ঘটান। তিনি রাষ্ট্রনীতি থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন রাখতে যত্নবান ছিলেন। তাঁর হিন্দু বিদ্বেষের কোনো প্রমান পাওয়া যায়নি।     


You May Also Like

0 comments