বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর।

by - August 07, 2021

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর। 




বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা। 

দাক্ষিণাত্যে মুসলিম আক্রমণ প্রতিরোধ করতে মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের উদ্ভব সুলতানি যুগের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বিজয়নগর সাম্রাজ্য প্রায় তিনশো বছর ধরে মুসলমান আক্রমণ থেকে দক্ষিণাত্যকে রক্ষা করে। বিজয়নগরের সুদক্ষ শাসকগণ শাসনব্যবস্থাকে সামরিক প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে এক শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এর ফলস্বরূপ সুদীর্ঘ সময়ব্যাপী সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা বজায় থাকে। 


বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সামাজিক অবস্থা :- 

পায়েজ , নিকালো কন্টি , আবদুর রজ্জাক - প্রমুখ বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ থেকে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সমাজ জীবনের নানা তথ্যাদি জানা যায়। 

সমাজে ব্রাহ্মণ প্রাধান্য :- 
তৎকালীন বিজয়নগর সাম্রাজ্যে চতুর্বর্ণ প্রথা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। ব্রাহ্মণরা সমাজে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। সমাজ , রাষ্ট্র ও ধর্মীয় জীবনে তাঁদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। বেদের বিখ্যাত টীকাকার সায়ন দ্বিতীয় হরিহরের মন্ত্রী ছিলেন। ব্রাহ্মণরা নিরামিষভোজী হলেও সাধারণ মানুষ মাংস ভক্ষণ করত। সমাজে গোমাংস নিষিদ্ধ ছিল। কৃষ্ণদেব রায় ও অচ্যুত রায় গোঁড়া হিন্দু ও বিষ্ণুর উপাসক হয়েও পশু - পক্ষির মাংস ভক্ষণ করতেন। সমাজে সমস্ত শ্রেণীর মানুষের মধ্যে মেলামেশা অবাধ ছিল। বিজয়নগরের অর্থনীতি ছিল কৃষি ও বাণিজ্যভিত্তিক। ফলে ব্রাহ্মণ ও ভূস্বামীদের বিশেষ প্রাধান্য ছিল। 

নারীর সামাজিক মর্যাদা :- 
মধ্যযুগীয় শাসনব্যবস্থায় অন্যান্য স্থানের তুলনায় বিজয়নগরের নারীরা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করতেন। সমাজ , রাজনীতি , সামরিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাপারে নারীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন। তাঁরা কারুশিল্প , চারুশিল্প , নৃত্য , সংগীত , সাহিত্য , কলাবিদ্যা ও শাস্ত্রচর্চা করতেন। মল্লক্রীড়া ও অসিচালনাতেও তাঁরা পারদর্শিনী ছিলেন। পর্তুগিজ নুনিজ লিখেছেন যে , এখানে কোনো কোনো নারী প্রহরী , জ্যোতিষ ও হিসাবরক্ষকের কাজ করতেন। 
গঙ্গাদেবী , হোনাম্মা ও তিরুমালাম্মা ছিলেন সেযুগের বিখ্যাত কবি। পুরুষের বহুবিবাহ , পণপ্রথা , বাল্যবিবাহ , সতী ও দেবদাসী প্রথা নারীর মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করে। বিদেশি পর্যটকদের রচনা থেকে রাজা দেবরায় , কৃষ্ণদেব রায় , অচ্যুত রায় প্রমুখ রাজন্যবর্গের বহু পত্নীর অস্তিত্বের কথা জানা যায়। সমাজে দেবদাসী প্রথা প্রচলিত ছিল। 


ধর্মনিরপেক্ষতা :- 
বিজয়নগরের নৃপতিগণ বিষ্ণুর উপাসক হলেও সকল ধর্মের প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এখানে বৌদ্ধ , জৈন , খ্রিস্টান , ইহুদি , মুসলিম - সকল ধর্মের মানুষই নির্বিবাদে বসবাস করত। শাসনব্যবস্থাতেও বিজয়নগরের শাসকগণ ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেন। 

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা :- 

বিদেশি পর্যটক নিকালো কন্টি , পায়েজ , নুনিজ , আবদুর রজ্জাক , এডোয়ার্ডো বারবোসা - প্রমুখের বিবরণ থেকে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা জানা যায়। 

কৃষি ও কৃষক :- 
বিজয়নগরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মূলে ছিল কৃষি , শিল্প ও ব্যবসা - বাণিজ্যের অগ্রগতি। কৃষি ছিল জনসাধারণের প্রধান জীবিকা। কৃষির জন্য জলসেচের সুবন্দোবস্ত ছিল। এই যুগে জমির মালিকানা জমিদার , মঠ ও মন্দিরগুলির হাতে চলে যায় এবং কৃষকেরা তাদের মজুরে পরিণত হয়। উৎপন্ন শস্যের মধ্যে প্রধান ছিল ধান , গম , বার্লি , মশলা , যব , কলাই ও তুলাজাত দ্রব্যাদি। মঠ ও মন্দির কর্তৃপক্ষ সুদের বিনিময়ে কৃষকদের ঋণ প্রদান করত। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে জমি বাজেয়াপ্ত করা হত। 


শিল্প ও বহির্বাণিজ্য  :- 
শিল্পোৎপাদনের দিক থেকে বস্ত্রশিল্প , যন্ত্রশিল্প , মৃৎশিল্প , ধাতু ও খনিজ উৎপাদন প্রধান ছিল। আবদুর রজ্জাক ও পায়েজের রচনা থেকে জানা যায় যে , শিল্পী ও বণিকদের পৃথক পৃথক সংঘ বা গিল্ড ছিল এবং এই সংঘগুলিই দেশের ব্যবসা - বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। আবদুর রজ্জাকের মতে , বিজয়নগরে তিনশো বন্দর ছিল। এই বন্দরগুলির মাধ্যমে চিন , মালয় , ব্রহ্মদেশ , পারস্য , পর্তুগাল ও আফ্রিকার সঙ্গে ব্যবসা - বাণিজ্য চলত। বিজয়নগর থেকে রপ্তানি হত চাল , লোহা , গন্ধক , চিনি , মশলা ও বস্ত্র এবং আমদানি হত আরবি ঘোড়া , হাতি , মুক্তা , তামা , প্রবাল , পারদ ও রেশমবস্ত্র। এই বহির্বাণিজ্য থেকে প্রচুর সম্পদ আহরিত হয়। 

অন্তর্দেশীয় বাণিজ্য :- 
জলপথ ও স্থলপথে অন্তর্দেশীয় বাণিজ্য চলত। স্থলপথে ঘোড়া , বলদ ও গো -  শকটে পণ্য পরিবহন চলত। সমুদ্রের উপকূলবর্তী বন্দরগুলি থেকেও অন্তর্দেশীয় বাণিজ্য চলত। বিজয়নগরে বড় জাহাজও তৈরী হত। বারবোসা - র লেখা থেকে জানা যায় যে , দক্ষিণ ভারতের মালদ্বীপে বড় জাহাজ তৈরির কারখানা ছিল। 

মুদ্রা ও কর :- 
বিজয়নগরে সোনা , রুপা ও তামার মুদ্রার প্রচলন ছিল। মুদ্রায় দেবদেবী ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি অংকিত থাকত। ভূমিরাজস্ব ছিল সরকারের আয়ের প্রধান উৎস। উৎপন্ন শস্যের এক - ষষ্ঠাংশ ভূমিকর হিসেবে আদায় করা হত। এছাড়া , প্রজাদের সম্পদকর , বিক্রয় - কর , যুদ্ধকর , বিবাহ - কর , আদালত - কর , মন্দিরে প্রদেয় কর - প্রভৃতি নানা ধরণের কর প্রচলিত ছিল। 

শ্রেণীবৈষম্য :- 
দেশের অধিকাংশ সম্পদ মুষ্টিমেয় অভিজাতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং তাদের জীবন বিলাস - বৈভবে পূর্ণ ছিল। অপরপক্ষে , সমাজে ধনবন্টন না থাকায় ও জাতিভেদ প্রথার জন্য সাধারণ কৃষক , শ্রমিক বা কারিগর শ্রেণির মানুষ তাদের পরিশ্রমের ফল ভোগ করতে পারত না। সাধারণ মানুষের জীবন করভারে জর্জরিত ছিল এবং তাদের জীবনযাত্রার মান ছিল অতি সাধারণ। জমির মালিকানা কৃষকদের হাত থেকে জমিদার ও সামন্তপ্রভুদের হাতে চলে যায় এবং সাধারণ মানুষ একপ্রকার ভূমিদাসে পরিণত হয়। 

বিজয়নগরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রকৃত রূপ :- 
বিদেশি পর্যটকদের রচনা থেকে জানা যায় , বিজয়নগর শহরের বাজারে খাদ্যদ্রব্যের দাম ছিল সস্তা এবং শহরে সর্বদায় খাদ্যদ্রব্য মজুত থাকত। এর সঙ্গে সঙ্গে একথাও ঠিক যে , সাধারণ দরিদ্র মানুষের জীবন ছিল দুর্বিসহ। নুনিজ ও পায়েজ - এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে , ক্ষুধার জ্বালায় দরিদ্র মানুষ ইঁদুর , বিড়াল , টিকটিকি - ইত্যাদিও ভক্ষণ করত। আসলে বিজয়নগরের সমৃদ্ধি শহর ও নগরাঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ; অন্যদিকে গ্রামের দরিদ্র কৃষক ছিল অবহেলিত ও শোষিত।  


You May Also Like

0 comments