চোলদের সামুদ্রিক কার্যকলাপ :-

by - July 29, 2021

চোলদের সামুদ্রিক কার্যকলাপ :- 




ভারতীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে চোলরাই সামুদ্রিক শক্তির প্রয়োজনীয়তা যথাযথভাবে উপলব্ধি করেছিল। পানিকর - এর ভাষায় , The only Indian State which had a proper appreciation of sea power was the Chola Empire  । চোল সম্রাটদের সামুদ্রিক নীতির ফলশ্রুতি হল নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে নৌঘাঁটির প্রতিষ্ঠা ও মালয়ের উপকূল অঞ্চলে প্রভুত্বের প্রতিষ্ঠা। 

প্রথম রাজরাজ চোলের আমলে সামুদ্রিক তৎপরতার সূত্রপাত :-  

চোল - রাজ প্রথম রাজরাজের সময় থেকেই চোলদের সামুদ্রিক তৎপরতা শুরু হয় বলা যায়। তিনিই সর্বপ্রথম চোল নৌশক্তি গড়ে তোলেন। সেই সময় কেরল , সিংহল ও পান্ড্য রাজারা পশ্চিম ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্মিলিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। এই সময় কেরল রাজাদের সমর্থনে আরব বণিকরাও পশ্চিম ভারতে ব্যবসা বাণিজ্য করত। এই অবস্থায় পশ্চিম - ভারতের ব্যবসা - বাণিজ্যে কেরল , সিংহল ও পান্ড্যদের আধিপত্য ধ্বংস করতে প্রথম রাজরাজ অগ্রসর হন। তাঁর নৌশক্তির প্রথম সাফল্য হল চের বা কেরল নৌ - শক্তির ধ্বংস সাধন এবং এরপর পান্ড্যরাজ অমরভুজঙ্গ চোলদের হাতে বন্দী হন।


 দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আরবদের বাণিজ্যিক তৎপরতা সম্বন্ধেও চোলরা যথেষ্ট অবহিত ছিল। এদের প্রতিযোগিতা ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে নৌশক্তি মালাবার আক্রমণ করে তা দখল করে নেয়। কিছুদিন পরে প্রথম রাজরাজ মালদ্বীপের ওপর নৌ - আক্রমণ চালিয়ে তা দখল করে নেন। সেই সময় মালদ্বীপ ছিল আরব বণিকদের এক অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র। সরাসরি আরবদের ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস করতে ব্যর্থ হলেও প্রথম রাজরাজ সিংহলের ওপর নৌ - অভিযান পরিচালনা করে রাজধানী অনুরাধাপুর বিধ্বস্ত করেন এবং চোলরা অনুরাধাপুর থেকে রাজধানী পোলোনারুভায় স্থানান্তরিত করেন। 

রাজেন্দ্র চোলের আমলে নৌ - শক্তির উৎকর্ষতা :- 

প্রথম রাজরাজ নৌশক্তির ভিত্তি রচনা করেছিলেন কিন্তু তার আরও সম্প্রসারণ ঘটে তাঁর  পুত্র প্রথম রাজেন্দ্র চোলের আমলে। তিনি এক বিশাল নৌ-বাহিনী নিয়ে বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করে পেন্ড , আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দখল করেন। এরপর তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নৌ - অভিযানে লিপ্ত হন। তাঁর সর্বাধিক নৌ কৃতিত্ব হল ১০২৫ খ্রিস্টাব্দে সুমাত্রার বিরুদ্ধে নৌ - অভিযান। এই অভিযানে সুমাত্রার শৈলেন্দ্র বংশীয় রাজা বিজয়তুঙ্গবর্মন চোলদের হাতে বন্দী হন এবং সুমাত্রার একাংশ চোল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।


চোল হ্রদ :- 
বৃহত্তর ভারতে এর পূর্বে কোনো ভারতীয় নৃপতি এই কৃতিত্ব অর্জন করতে পারেননি। প্রথম রাজেন্দ্র চোলের পৃষ্ঠপোষকতায় দক্ষিণ ভারত এবং ব্রহ্মদেশ ও মালয় উপদ্বীপের মধ্যে সামুদ্রিক ও বাণিজ্যিক তৎপরতা বেশ কিছুদিন অব্যাহত ছিল। প্রকৃতপক্ষে চোলদের নৌশক্তির প্রাধান্যের ফলেই বঙ্গোপসাগর '' চোল - হ্রদ '' - এ ( Chola Lake ) পরিণত হয় এবং চোলদের ভয়ে সিংহল , সুমাত্রা ও বৃহত্তর ভারতের অন্যান্য দেশ সর্বদাই সন্ত্রস্ত থাকত।চোলদের সামুদ্রিক প্রাধান্যের ফলে কিছুদিন বৃহত্তর ভারতীয় দেশগুলিতে ভারতীয় সামরিক তৎপরতা ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিরাপদ থাকে। 

চিনের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক :- 
চোলরাজাদের শাসনকালে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যে করমন্ডল উপকূল গুরুত্ব অর্জন করে। এখান থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রাজরাজ চোলের সময়ে ( ৯৮৫ - ১০১৪ খ্রিস্টাব্দ ) মামাল্লাপুরম ছিল প্রধানতম বন্দর। শীঘ্রই নাগপট্টম  বাণিজ্যিক বন্দর হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। চীনের সুং বংশের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে , চোল রাজ্য থেকে ১০১৫ খ্রিস্টাব্দে চিনে বাণিজ্যিক দৌত্য পাঠানো হয়। চিনে সুং বংশের নেতৃত্বে এশিয়ায় সামুদ্রিক বাণিজ্যে চিনের প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং এশিয়ার দুই প্রান্তে অবস্থিত চিনা ও আরবীয় বাণিজ্যের মধ্যে যোগসূত্র রচনা করেছিল ভারতবর্ষ। রাজরাজের পুত্র রাজেন্দ্র চোলের আমলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও ঘনীভূত হয়। পরবর্তীকালে চোল রাজাদের মধ্যে প্রথম কুলোতুঙ্গ - এর আমলে ব্রহ্মদেশের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। 

পরিশেষে বলা যায় , চোল রাজাদের সামুদ্রিক কার্যকলাপের মূল উদ্দেশ্য কি ছিল - সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।  জর্জ স্পেন্সার মনে করেন , চোলেরা সম্পদ লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যেই নৌ বাহিনী গঠন করেন এবং সামুদ্রিক অভিযানের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এই অভিমত সমর্থনযোগ্য নয়। মূলত বাণিজ্যিক স্বার্থেই চোল রাজারা আগ্রাসী সামুদ্রিক অভিযান নীতি অনুসরণ করেছিলেন। 

You May Also Like

0 comments