চোলদের সামুদ্রিক কার্যকলাপ :-
চোলদের সামুদ্রিক কার্যকলাপ :-
ভারতীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে চোলরাই সামুদ্রিক শক্তির প্রয়োজনীয়তা যথাযথভাবে উপলব্ধি করেছিল। পানিকর - এর ভাষায় , The only Indian State which had a proper appreciation of sea power was the Chola Empire । চোল সম্রাটদের সামুদ্রিক নীতির ফলশ্রুতি হল নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে নৌঘাঁটির প্রতিষ্ঠা ও মালয়ের উপকূল অঞ্চলে প্রভুত্বের প্রতিষ্ঠা।
প্রথম রাজরাজ চোলের আমলে সামুদ্রিক তৎপরতার সূত্রপাত :-
চোল - রাজ প্রথম রাজরাজের সময় থেকেই চোলদের সামুদ্রিক তৎপরতা শুরু হয় বলা যায়। তিনিই সর্বপ্রথম চোল নৌশক্তি গড়ে তোলেন। সেই সময় কেরল , সিংহল ও পান্ড্য রাজারা পশ্চিম ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্মিলিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। এই সময় কেরল রাজাদের সমর্থনে আরব বণিকরাও পশ্চিম ভারতে ব্যবসা বাণিজ্য করত। এই অবস্থায় পশ্চিম - ভারতের ব্যবসা - বাণিজ্যে কেরল , সিংহল ও পান্ড্যদের আধিপত্য ধ্বংস করতে প্রথম রাজরাজ অগ্রসর হন। তাঁর নৌশক্তির প্রথম সাফল্য হল চের বা কেরল নৌ - শক্তির ধ্বংস সাধন এবং এরপর পান্ড্যরাজ অমরভুজঙ্গ চোলদের হাতে বন্দী হন।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আরবদের বাণিজ্যিক তৎপরতা সম্বন্ধেও চোলরা যথেষ্ট অবহিত ছিল। এদের প্রতিযোগিতা ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে নৌশক্তি মালাবার আক্রমণ করে তা দখল করে নেয়। কিছুদিন পরে প্রথম রাজরাজ মালদ্বীপের ওপর নৌ - আক্রমণ চালিয়ে তা দখল করে নেন। সেই সময় মালদ্বীপ ছিল আরব বণিকদের এক অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র। সরাসরি আরবদের ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস করতে ব্যর্থ হলেও প্রথম রাজরাজ সিংহলের ওপর নৌ - অভিযান পরিচালনা করে রাজধানী অনুরাধাপুর বিধ্বস্ত করেন এবং চোলরা অনুরাধাপুর থেকে রাজধানী পোলোনারুভায় স্থানান্তরিত করেন।
রাজেন্দ্র চোলের আমলে নৌ - শক্তির উৎকর্ষতা :-
প্রথম রাজরাজ নৌশক্তির ভিত্তি রচনা করেছিলেন কিন্তু তার আরও সম্প্রসারণ ঘটে তাঁর পুত্র প্রথম রাজেন্দ্র চোলের আমলে। তিনি এক বিশাল নৌ-বাহিনী নিয়ে বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করে পেন্ড , আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দখল করেন। এরপর তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নৌ - অভিযানে লিপ্ত হন। তাঁর সর্বাধিক নৌ কৃতিত্ব হল ১০২৫ খ্রিস্টাব্দে সুমাত্রার বিরুদ্ধে নৌ - অভিযান। এই অভিযানে সুমাত্রার শৈলেন্দ্র বংশীয় রাজা বিজয়তুঙ্গবর্মন চোলদের হাতে বন্দী হন এবং সুমাত্রার একাংশ চোল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।
চোল হ্রদ :-
বৃহত্তর ভারতে এর পূর্বে কোনো ভারতীয় নৃপতি এই কৃতিত্ব অর্জন করতে পারেননি। প্রথম রাজেন্দ্র চোলের পৃষ্ঠপোষকতায় দক্ষিণ ভারত এবং ব্রহ্মদেশ ও মালয় উপদ্বীপের মধ্যে সামুদ্রিক ও বাণিজ্যিক তৎপরতা বেশ কিছুদিন অব্যাহত ছিল। প্রকৃতপক্ষে চোলদের নৌশক্তির প্রাধান্যের ফলেই বঙ্গোপসাগর '' চোল - হ্রদ '' - এ ( Chola Lake ) পরিণত হয় এবং চোলদের ভয়ে সিংহল , সুমাত্রা ও বৃহত্তর ভারতের অন্যান্য দেশ সর্বদাই সন্ত্রস্ত থাকত।চোলদের সামুদ্রিক প্রাধান্যের ফলে কিছুদিন বৃহত্তর ভারতীয় দেশগুলিতে ভারতীয় সামরিক তৎপরতা ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিরাপদ থাকে।
চিনের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক :-
চোলরাজাদের শাসনকালে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যে করমন্ডল উপকূল গুরুত্ব অর্জন করে। এখান থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রাজরাজ চোলের সময়ে ( ৯৮৫ - ১০১৪ খ্রিস্টাব্দ ) মামাল্লাপুরম ছিল প্রধানতম বন্দর। শীঘ্রই নাগপট্টম বাণিজ্যিক বন্দর হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। চীনের সুং বংশের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে , চোল রাজ্য থেকে ১০১৫ খ্রিস্টাব্দে চিনে বাণিজ্যিক দৌত্য পাঠানো হয়। চিনে সুং বংশের নেতৃত্বে এশিয়ায় সামুদ্রিক বাণিজ্যে চিনের প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং এশিয়ার দুই প্রান্তে অবস্থিত চিনা ও আরবীয় বাণিজ্যের মধ্যে যোগসূত্র রচনা করেছিল ভারতবর্ষ। রাজরাজের পুত্র রাজেন্দ্র চোলের আমলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও ঘনীভূত হয়। পরবর্তীকালে চোল রাজাদের মধ্যে প্রথম কুলোতুঙ্গ - এর আমলে ব্রহ্মদেশের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
পরিশেষে বলা যায় , চোল রাজাদের সামুদ্রিক কার্যকলাপের মূল উদ্দেশ্য কি ছিল - সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। জর্জ স্পেন্সার মনে করেন , চোলেরা সম্পদ লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যেই নৌ বাহিনী গঠন করেন এবং সামুদ্রিক অভিযানের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এই অভিমত সমর্থনযোগ্য নয়। মূলত বাণিজ্যিক স্বার্থেই চোল রাজারা আগ্রাসী সামুদ্রিক অভিযান নীতি অনুসরণ করেছিলেন।
0 comments