হরপ্পার নগর পরিকল্পনা , the general planning of the cities of Harappan Civilisation .

by - June 27, 2021

হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা কর। Discuss the general planning of the cities of Harappan Civilisation . 




হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা


যথেষ্ট সাক্ষ্য - প্রমানের অভাব , সিন্ধু উপত্যকা ও হরপ্পায় প্রাপ্ত লিপিগুলির যথাযথ পাঠোদ্ধারের অভাব - ইত্যাদি কারণে সিন্ধু সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে শুধুমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের উপর নির্ভর করে হরপ্পার নগরজীবন সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে। তবে , এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে , সিন্ধুলিপি পাঠোদ্ধার না হলে সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে না। 
‘’ It is impossible at the present state of our knowledge to come to any definite conclusion .’’ 
( The Vedic Age ) 


তবে সামগ্রিক তথ্য প্রমানের ভিত্তিতে বলা যেতে পারে , হরপ্পা সভ্যতার অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রেই উন্নত নগরজীবনের বিকাশ ঘটেছিল বলে প্রমান পাওয়া যায়। এই সভ্যতার অন্যতম নগরগুলি ছিল - হরপ্পা , মহেঞ্জোদারো , কালিবঙ্গান , চানহুদারো , কোটদিজি , আলমগিরপুর , রংপুর , বানওয়ালি , লোথাল , সুরকোটরা , রোজদি - প্রভৃতি। প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে বিকশিত হওয়া এই সভ্যতায় উন্নত রাস্তাঘাট , ঘরবাড়ি , পয়ঃপ্রণালী , স্নানাগার , শস্যাগার   প্রভৃতির নির্মাণ ও উন্নত নির্মাণ কৌশল উন্নত নগর সভ্যতার পরিচয় বহন করে। 
ঐতিহাসিক মার্টিমার হুইলার মনে করেন যে , হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো নগর দুটি নির্মাণকালে সংগঠকরা নগর পরিকল্পনায় যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। নগর পরিকল্পনার প্রধান দিকগুলি ছিল ----

প্রতিটি নগরের জীবনযাত্রাগত সাদৃশ্য :-
হরপ্পার বিভিন্ন নগরগুলিতে সমাজ ও সংস্কৃতি মোটামুটি একই ধরণের ছিল। বিভিন্ন নগরগুলির মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব থাকলেও নগরগুলির পরিকল্পনা , গঠন রীতি , জীবনযাত্রা প্রণালী - প্রভৃতির মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য দেখা যায়। নগরের রাস্তাঘাটের নকশা , ঘরবাড়ি ও অট্টালিকা , পরিষ্কার - পরিছন্নতার দিকে নজর , ওজন ও পরিমাপ ব্যবস্থা - সবই প্রতিটি নগরেই প্রায় একই ধরণের ছিল। 


সাধারণ নগর পরিকল্পনায় পূর্ববর্তী নগরের ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা :-
মহেঞ্জোদাড়োতে নয়টি স্তরে ঘর বাড়ির নিদর্শন পাওয়া গেছে। বন্যার ফলে বা অন্য কোনো কারণে অট্টালিকাগুলি ধ্বংস হয়ে গেলে সেইস্থানে অনুরূপ অট্টালিকা তৈরী করার রীতি ছিল। হাজার - হাজার বছর ধরে নগর নগর দুটির রাজপথের পরিকল্পনা একই ছিল। একথা অনস্বীকার্য যে , মেসোপটেমিয়ার সাথে যোগাযোগ থাকা স্বত্বেও সিন্ধুবাসী মেসোপটেমিয়ার উন্নত সাংস্কৃতিক কলাকৌশল গ্রহণে উৎসাহী ছিল না। এখানেই সিন্ধুবাসীদের রক্ষনশীলতা ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধার পরিচয় পাওয়া যায়।     

পয়ঃপ্রণালী ও রাস্তাঘাট :- 
বাড়ির ভিতর থেকে পয়ঃপ্রণালীর মাধ্যমে জল নিষ্কাশন করে সদর রাজপথের বৃহৎ নর্দমায় ফেলার সুবন্দোবস্ত ছিল। বাড়ীর জঞ্জাল ফেলার জন্য বড় বড় আবর্জনা কুন্ড থাকত। প্রতিটি স্নানাগারে জল নিষ্কাশনের জন্য পোড়া মাটির নল ব্যবহৃত হত। নগর দুটি পরিস্কার রাখার জন্য হাজার হাজার বছর পূর্বে সিন্ধু নাগরিকেরা যে কতটা সচেতন ছিলেন - তার সুস্পষ্ট প্রমান পাওয়া যায়। 

হরপ্পা সভ্যতার প্রধান রাস্তাগুলি শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রাস্তাগুলি ছিল প্রশস্ত , সোজা ও পরিছন্ন। রাস্তাগুলি ৯ থেকে ৩৪ ফুট পর্যন্ত চওড়া ছিল। প্রধান রাস্তা থেকে একাধিক সরু গলিপথ বেরিয়ে আসত। রাস্তাগুলি সম্পূর্ণ নগরকে বিভিন্ন বর্গাকার বা আয়তাকার ক্ষেত্রে বিভক্ত থাকত। রাস্তা নির্মাণে চুন , সুরকি , পাথর প্রভৃতি ব্যবহার করা হত। রাস্তার দুপাশে বাঁধানো ফুটপাত , ডাস্টবিন ও আলোর ব্যবস্থা ছিল।

   

এই ওয়েবসাইটের সমস্ত প্রশ্নোত্তরের তালিকা / সূচীপত্রের জন্য এখানে CLICK করো।


অট্টালিকা ও অন্যান্য ঘরবাড়ি নির্মাণ :- 
অধিকাংশ অট্টালিকাগুলি পোড়া ইঁট দ্বারা নির্মিত ছিল। একতল ও বহুতল বাড়িগুলির দেওয়াল ছিল মসৃন। প্রতিটি আবাসিক গৃহে উন্মুক্ত অঙ্গন , কূপ , স্নানাগার , জানালা এবং গৃহগুলি প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিল। গৃহ নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ইঁটগুলি সাধারণতঃ দুই ধরণের হত - রোদে শুকানো ইঁট ও পোড়ানো ইঁট। ইঁটগুলি পাতলা ও ছোট আকৃতির হত। প্রতিটি বাড়িতে প্রবেশের জন্য গলিপথ থাকত। বাড়িগুলির রাস্তার দিকে কোনো দরজা - জানলা থাকতো না। শহরে অসংখ্য দ্বিতল বাড়ি ছিল। মনে করা হয় যে , আয়তাকার উঁচু স্থানের বাড়িগুলিতে প্রভাবশালী ধনী ব্যাক্তিরা এবং নীচু স্থানের বাড়িগুলিতে সাধারণ মানুষ বসবাস করত। ঐতিহাসিক গর্ডন চাইল্ড মনে করেন যে , হরপ্পার পৌর শাসকেরা সম্ভবতঃ গৃহনির্মাণ সংক্রান্ত আইন কানুন মেনে চলতেন। 

স্নানাগার :-
মহেঞ্জোদারোর দুর্গ অঞ্চলে ১৮০ দীর্ঘ ও ১০৮ ফুট প্রশস্ত একটি বিরাট বাঁধানো স্নানাগারের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এর জলাশয়টি ৩৯ ফুট লম্বা , ২৩ ফুট চওড়া এবং ৮ ফুট গভীর। স্নানাগারটিতে ওঠানামার জন্য দুদিক থেকে সিঁড়ির ব্যবস্থা ছিল। গ্রীষ্ম ও শীতকালে প্রয়োজন অনুসারে এখানে ঠান্ডা ও গরম জলের ব্যবস্থা করা হত। জলাশয়ের একপাশে কয়েকটি ছোট ছোট ঘর ছিল। সম্ভবতঃ স্নানের পর পোশাক পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে এই ঘরগুলি ব্যবহার করা হত বলে ডক্টর রামশরণ শর্মা অভিমত দিয়েছেন। 

একটি প্রশস্ত প্রাঙ্গনের মধ্যভাগে স্নানাগারটি অবস্থিত। স্নানার্থীদের জন্য একটি উচ্চ মঞ্চ ছিল। অনুমান করা হয় যে , স্নানাগারটি কোনো ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ছিল এবং এর ছোট ছোট কক্ষগুলি ছিল প্রধান পুরোহিতের আবাস। 


শস্যাগার ও তার নিদর্শন :-
হরপ্পা সহ বেশ কয়েকটি শহরে শস্যাগারের নিদর্শন পাওয়া গেছে। হরপ্পার শস্যাগারটি ২০০/ ১৫০ বর্গফুট উঁচু একটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। শস্যাগারটির পাশে শ্রমিকদের বস্তির মতো ঘর ছিল। শস্যাগারটি হরপ্পা সভ্যতায় সম্পদের ওপর রাষ্ট্রীয় মালিকানার ইঙ্গিত বহন করে। ঐতিহাসিক এ এল ব্যাসাম এই শস্যাগারকে বর্তমানকালের রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্ক এর সাথে তুলনা করেছেন। এখানে আপৎকালীন সময়ের জন্য খাদ্যশস্য মজুত থাকত। স্যার মর্টিমার হুইলার মনে করেন যে , পঞ্চম শতকের আগে পৃথিবীর অন্য কোথাও এত বড় শস্যাগারের নিদর্শন মেলেনি।   

নগরদুর্গ :-
মহেঞ্জোদারোয় ৪০ ফুট উঁচু একটি ঢিপির ওপর একটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা দুর্গটি নগরের নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে , দুর্গ অঞ্চলের বাড়িগুলিতে শাসকশ্রেণীর লোকজন বসবাস করত। কেউ কেউ মনে করেন যে , এই নগরদুর্গ আসলে ছিল এই সভ্যতার পুরোহিত শাসকের রাজপ্রাসাদ। 

পৌর শাসনব্যবস্থা :-
সিন্ধু অধিবাসীদের জল নিকাশী ব্যবস্থা , জঞ্জাল দূরীকরণ ইত্যাদি দেখে মনে হয় নগর দুটিতে সুগঠিত পৌর ব্যবস্থা ছিল এবং এর দৃষ্টান্তও ছিল অভাবনীয়। রোমানদের পূর্বে কোনো প্রাচীন সভ্যতায় সিন্ধুবাসীদের পৌর সংস্থার মত উন্নত কোন সংস্থা ছিল বলে প্রমান পাওয়া যায়নি। 

ঐতিহাসিকেরা মনে করেন , হরপ্পা সভ্যতায় সম্ভবতঃ একটি সুপরিকল্পিত কেন্দ্রীয় পৌর শাসনব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল। রাস্তাঘাট , ঘরবাড়ি , ওজন ও মাপ ব্যবস্থা প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে হরপ্পা সভ্যতার বিভিন্ন নগরগুলিতে সাদৃশ্য লক্ষ্য করে বিভিন্ন পন্ডিত অনুমান করেন যে , একই সভ্যতায় একটি সুপরিকল্পিত কেন্দ্রীভূত পৌর ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল। এই পৌর ব্যবস্থাই বিভিন্ন শহরে একই ধরণের পৌর ব্যবস্থা চালু করেছিল। 
ঐতিহাসিক এস কে সরস্বতী বলেছেন যে , এই সাদৃশ্য থেকে বোঝা যায় যে এখানে একটি শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত কর্তৃপক্ষের অস্তিত্ব ছিল যারা বিস্তৃত এই অঞ্চলের মানুষের জীবন ও রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করত। 
সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসারে ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট নির্মাণ , রাস্তার ধারে ভূগর্ভস্থ পয়ঃপ্রনালীগুলি চালু রাখা , নিয়মিত ডাস্টবিনগুলি পরিষ্কার রাখা প্রভৃতি কাজগুলি সম্পাদনের উদ্দেশ্যে অবশ্যই সুদৃঢ় পৌর ব্যবস্থার অস্তিত্বের প্রয়োজন ছিল বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। 

ঐতিহাসিক ষ্টুয়ার্ট পিগট মনে করেন যে , সিন্ধু সভ্যতার মতো বহুদূর বিস্তৃত সভ্যতার পরিচালনার জন্য হয়তো হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োতে দুটি রাজধানী বা শাসনকেন্দ্র থাকলেও শাসক হয়তো একজনই ছিলেন। 

এছাড়াও , সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন শহরগুলিতে নর্দমার সঙ্গে অনেক ম্যানহোল যুক্ত ছিল। এগুলির ওপরে ঢাকনা বসানো থাকত এবং ঢাকনা খুলে নিয়মিত এগুলি পরিষ্কার করা হত। ঐতিহাসিক ডক্টর আর এস শর্মার মতে , পৃথিবীর আর কোনো প্রাচীন সভ্যতা হরপ্পার মতো স্বাস্থ্য ও পরিছন্নতার বিষয়ে এতটা গুরুত্ব দেয়নি।  

  

এই ওয়েবসাইটের সমস্ত প্রশ্নোত্তরের তালিকা / সূচীপত্রের জন্য এখানে CLICK করো।




You May Also Like

0 comments