মৌর্যত্তর যুগের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতা সম্পর্কে আলোচনা করো। Discuss the cultural excellence of the post-Mauryan era.

by - June 27, 2021

মৌর্যত্তর যুগের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতা সম্পর্কে আলোচনা করো। Discuss the cultural excellence of the post-Mauryan era.




মৌর্যত্তর যুগের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতা :-


ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর প্রায় দু'শতাব্দী ধরে উত্তর ভারতে গ্রিক , কুষাণ প্রভৃতি বৈদেশিক জাতির শাসন চলেছিল। কিন্তু এই অনুমান সত্য নয়। বরং বলা যায় , গ্রিক ও কুষাণদের অনেকেই ভারতীয় রীতিনীতি গ্রহণ করে ও ভারতীয় ধর্মে দীক্ষিত হয়। শক ও পল্লবদের সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। মৌর্যত্তর যুগের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতা ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসকে মহিমান্বিত করেছিল। 


বিভিন্ন বৈদেশিক জাতির আগমনের ফলে এক বিরাট সাংস্কৃতিক সমন্বয় :-
মৌর্যত্তর যুগে বিভিন্ন বৈদেশিক জাতি ভারতে প্রবেশ করে ভারতীয় সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটায়। গ্রিক , শক , পল্লব , কুষাণ ছাড়াও এই যুগে রোম ও চীনের সঙ্গেও ভারতের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ঘটে। দক্ষিণ ভারতের অর্থনীতিতে রোমের ব্যবসা - বাণিজ্য প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু উত্তর ভারতে রোম ও গ্রিসের প্রভাব পড়েছিল শিল্পের ক্ষেত্রে। এই সংস্পর্শের ফলে উত্তর ভারতে কারুশিল্প ও বৌদ্ধধর্মের ক্ষেত্রে এক বিবর্তন ঘটে। বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে দিয়েই গ্রিকরা ভারতীয় সমাজে প্রবেশ করে। গ্রিকরা ভারতীয় ভাষাও গ্রহণ করেছিল। 
দীর্ঘকালব্যাপী এই সংস্পর্শের ফলে ইউরোপীয় গ্রন্থাদিতেও ভারতের বিস্তারিত বিবরণ উল্লিখিত আছে। যেমন - স্ট্রাবো রচিত '' ভূগোল '' , প্লিনি রচিত ''প্রাকৃতিক ইতিহাস '' , পেরিপ্লাস রচিত '' ইরিথ্রিয়া '' ইত্যাদি। এই যুগের ধর্ম , দর্শন , সাহিত্য , শিল্পকলা - সবকিছুতেই সমন্বয়ের নিদর্শন পাওয়া যায়। 


মৌর্যত্তর যুগের সাহিত্যিক উৎকর্ষতা :-
মৌর্যত্তর যুগে সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক অপূর্ব উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। এই যুগেই নাগার্জুন , অশ্বঘোষ , পতঞ্জলি , চরক , মনু , যাজ্ঞবল্ক্য , কালিদাস - প্রমুখ মনীষীদের আবির্ভাব হয়। এই যুগেই সর্বশ্রেষ্ঠ পালি গ্রন্থ '' মিলিন্দ পঞ্চহো '' রচিত হয়। এই যুগে বহু বৌদ্ধ গ্রন্থকারদের আবির্ভাব হয়। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অশ্বঘোষ। তিনি ছিলেন কণিষ্কের সমসাময়িক। অশ্বঘোষ রচিত - বুদ্ধচরিত , বজ্রসূচি , সূত্রালংকার - ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। 

এছাড়াও নাগার্জুন রচনা করেন প্রথম মহাযান সূত্র '' শত সহস্রিকা প্রাজ্ঞ পারমিতা '' নামক গ্রন্থটি। '' মাধ্যমিক সূত্র '' গ্রন্থটিও তাঁর রচনা। অপরদিকে কালিদাস রচিত '' মালবিকাগ্নিমিত্রম '' , চরক রচিত আয়ুর্বেদশাস্ত্র '' চরক সংহিতা '' , মনু রচিত '' মনু সংহিতা '' , যাজ্ঞবল্ক্য রচিত '' যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি '' - প্রভৃতি গ্রন্থাদি অনন্তকাল ধরে ভারতীয় জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। 


শিল্পকলা ও শিল্পক্ষেত্রে উৎকর্ষতা :-
মৌর্যযুগে ভারতীয় শিল্পকলা যে উৎকর্ষতা লাভ করেছিল - তা পরবর্তী যুগেও অব্যাহত ছিল এবং অনেক ক্ষেত্রে তা অধিকতর উৎকর্ষতা লাভ করেছিল। মৌর্য যুগের পতনের পর চার - পাঁচ শত বছরের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন স্থানে অগণিত গুহা মন্দির ও গুহা আবাস তৈরী হয়। বৌদ্ধ ধর্মকে কেন্দ্র করেই মৌর্য পরবর্তী যুগে স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পের বিকাশ ঘটে। এই যুগের ধর্মীয় স্থাপত্যের নিদর্শন হল বৌদ্ধ স্তুপ ও বৌদ্ধ গুহামন্দির। স্তুপের চারদিকে  রেলিং বা বেষ্টনী থাকত। এই বেষ্টনীগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন হল ভারুত স্তুপের বেষ্টনী। সম্ভবতঃ খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে এটি রচিত হয়েছিল। 

এই যুগেই সাঁচি স্তূপটির সংস্কার করা হয় এবং তা সম্প্রসারিত হয়। পশ্চিম দাক্ষিণাত্যের গুহা মন্দির গুলি এই যুগের শিল্পকলার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এই সকল মন্দিরের প্রবেশদ্বার ও এর ভিতরের প্রকোষ্ঠগুলি আজও বিস্ময়ের উদ্রেক করে। মৌর্য পরবর্তী যুগের বৃহৎ গুহাগুলি যথা - ভাজা , চেদশা , কোন্দন , জুনার , নাসিক , অজন্তা , ইলোরা , উদয়গিরি - প্রভৃতি স্থানের গুহাগুলি অসাধারণ শিল্প নৈপুণ্য ও রুচির সাক্ষ্য বহন করে। তাছাড়া বিভিন্ন স্তুপের প্রবেশদ্বারগুলিও উন্নত শিল্পচর্চার এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন। যেমন - সাঁচি স্তুপের কারুকার্যময় প্রবেশদ্বার। 

মথুরা শিল্পরীতি :-
মৌর্যত্তর যুগে স্থাপত্য শিল্পের অঙ্গ হিসেবেই ভাস্কর্য শিল্পের বিকাশ ঘটে। প্রথমদিকে পাথরের পরিবর্তে কাঠ ও হাতির দাঁতের খোদাই করা নকশার কাজে ভাস্কররা অধিক দক্ষ ছিল। কিন্তু খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে পাথরের ওপর খোদাই করার রীতি প্রচলিত হয়। এই প্রসঙ্গে অমরাবতী ও দাক্ষিণাত্যের গুহাগুলির দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। মথুরায় জৈনদের পৃষ্ঠপোষকতায় বেলে পাথরের ওপর খোদাই করার কাজ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মথুরা শিল্পরীতি কুষাণদের পৃষ্ঠপোষকতায় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে এবং মথুরার সন্নিকটে কুষাণ রাজাদের কিছু খোদিত মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। গান্ধার শিল্পের তুলনায় মথুরার শিল্পরীতিতে মৌলিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। কুষাণ নৃপতিদের মূর্তিগুলি মথুরা শিল্পরীতি অনুসারে নির্মাণ করা হয়েছিল। 

গান্ধার শিল্পরীতি :-
মৌর্যত্তর যুগে গ্রিক ও রোমান শিল্পরীতি ভারতে প্রবেশ করে। উত্তর পশ্চিম সীমান্তে গ্রিকরা প্রায় তিনশত বছর রাজত্ব করে। এর ফলে এই অঞ্চলের শিল্পীরা বিদেশি শিল্পরীতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এক নতুন শিল্পরীতি প্রবর্তন করে। এটি গান্ধার শিল্প নামে পরিচিত। মানুষের যথার্থ প্রতিকৃতি নির্মাণ করা ছিল এই শিল্পরীতির প্রধান বৈশিষ্ট। বুদ্ধ প্রতিমার দেহ গঠন বাহ্যত গ্রিক রীতির অনুকরণে হলেও এতে ভারতীয় ভাবাদর্শসম্মত মহাপুরুষের মহাপুরুষের সর্ববিধ লক্ষণও বর্তমান। শকদের আমলে গান্ধার শিল্পের সূচনা হলেও তা কুষাণদের আমলে বিকশিত হয়ে ওঠে। গান্ধার শিল্পরীতি অনুসরণ করেই বুদ্ধের অসংখ্য প্রতিকৃতি নির্মিত হয়েছিল। গান্ধার শিল্পে মহাযান বৌদ্ধ ধর্মমতের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। গান্ধার শিল্পরীতির দ্বারা মথুরা ও অমরাবতী শিল্পরীতি প্রভাবিত হয়েছিল ঠিকই কিন্তু এই শিল্পরীতি ভারতের অন্তর্দেশে প্রবেশ করতে পারেনি। কিন্তু চীন , জাপান , কোরিয়া , মঙ্গোলীয়া - ইত্যাদি দেশেও গান্ধার শিল্পরীতি যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করে। 


ধর্মীয় উদারতা : বহু ধর্মের অবস্থান ও সমন্বয় :-
মৌর্য পরবর্তীকালে মিনান্দার , কণিষ্ক প্রমুখ বিদেশাগত নৃপতিরা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এই সময় বৌদ্ধ ধর্মের রূপান্তর ঘটে। এই যুগে বুদ্ধ ''দেবতা'' , '' দেবতিদেব '' রূপে পূজিত হন। ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের ব্যাপক প্রচলন এই যুগেই শুরু হয়। মৌর্য যুগে '' হীনযান '' মত জনপ্রিয় ছিল ; কিন্তু এই যুগে '' মহাযান '' ধর্মমত জনপ্রিয় ও প্রবল হয়ে উঠেছিল। নাগার্জুনকোন্ডা -র অনুশাসনলিপি থেকে জানা যায় যে , এই যুগের বৌদ্ধ ধর্মমত প্রচারকেরা কাশ্মীর , চীন , তোসালি , গান্ধার , বঙ্গ , সিংহল সহ পূর্ব ও পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বৌদ্ধ ধর্মমতকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। 

মৌর্যত্তর যুগে জৈন ধর্মও যথেষ্ট বিস্তার লাভ করেছিল। মহাবীরের ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারেও মতভেদের উদ্ভব হয়। জৈনরা শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর - এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই যুগে জৈন ধর্মাবলম্বীরা মগধ থেকে ধীরে ধীরে মথুরা , উজ্জয়িনী ও সৌরাষ্ট্রে চলে আসে। এদের অপর এক দল কলিঙ্গে চলে যায় ও কলিঙ্গরাজ খারবেলের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। দক্ষিণ ভারতে জৈনদের প্রধান কেন্দ্র ছিল মহীশুর ও তামিল অঞ্চল। 

মৌর্যত্তর যুগে ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্ম অপরিবর্তিত থাকে। এই সময় থেকে ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্মে যে সকল  বৈশিষ্টের সূচনা হয় পরবর্তীকালে তাই হিন্দুধর্ম নামে পরিচিতি লাভ করে। যাগ - যজ্ঞ ও অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্মের গুরুত্ব ক্রমেই হ্রাস পায়। ঈশ্বর ও ভক্তের মধ্যে ব্যাক্তিগত সম্পর্ক স্থাপনের আদর্শ ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শৈব ও বৈষ্ণবদের মধ্যে একেশ্বরবাদের আদর্শ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে হিন্দুধর্মে ভক্তিবাদের প্রসার এক গুরুত্বপূর্ণ বিবর্তন। 

মৌর্যত্তর যুগে ধর্মের ক্ষেত্রে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হল ধর্ম সম্বন্ধে উদারতা ও বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সম্প্রীতি। এই যুগে ধর্ম বিরোধের কোনো প্রমান পাওয়া যায়নি। 

শিক্ষা ক্ষেত্রে উৎকর্ষতা :-
শিক্ষা ক্ষেত্রেও ভারত এইযুগে অনগ্রসর ছিল না। রাওয়ালপিন্ডির অনতিদূরে অবস্থিত তক্ষশীলা নগরটি শিক্ষা ও সংস্কৃতির একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও চীন , গ্রিস , ইরান , মিশর - প্রভৃতি দেশ থেকে বহু শিক্ষার্থী শিক্ষালাভের জন্য তক্ষশীলায় আসতেন। তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেদ , ব্যাকরণ , দর্শন , চিকিৎসাশাস্ত্র , সাহিত্য ও শিল্প - ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ে শিক্ষাদান করা হত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ছাত্র ও শিক্ষক হিসাবে পাণিনি , কাত্যায়ন , পতঞ্জলি , জীবক , চাণক্য - প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া , কণিষ্কের রাজধানী পুরুষপুর বা পেশোয়ার বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র শিক্ষার একটি অন্যতম কেন্দ্র ছিল। 

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্পর্শে আসার ফলে এইযুগে জ্যোতিষ শাস্ত্র ও চিকিৎসাশাস্ত্র যথেষ্ট অগ্রগতি লাভ করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে চরক ও সুশ্রুতর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই যুগে ভেষজ বিদ্যাও অভাবনীয় উন্নতি লাভ করে। এই যুগে ধর্মশাস্ত্র রচনার ক্ষেত্রেও বিশেষ তৎপরতা দেখা যায়। সামগ্রিক ভাবে মৌর্য পরবর্তী যুগ ভারতীয় শিক্ষা - সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নানাবিধ বৈপ্লবিক রূপান্তর নিয়ে এসেছিলো যা পরবর্তী কালে ভারতীয় সমাজ গঠনের উপাদান রূপে কাজ করে।      

   

                   
   

You May Also Like

0 comments