মৌর্য যুগের শিল্পকলার পরিচয় দাও। Discuss on the art and craft of Mauryan Era .

by - June 27, 2021

মৌর্য যুগের শিল্পকলার পরিচয় দাও। Discuss on the art and craft of Mauryan Era .




মৌর্য যুগের শিল্পকলার পরিচয়


মৌর্য যুগে ভারতে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ঐক্যই প্রতিষ্ঠিত হয় নি ; এর সঙ্গে সঙ্গে এক উন্নত মানের শিল্পকলার পরিচয় পাওয়া যায়। মৌর্য শাসকদের প্রশাসনিক দক্ষতা ব্যবসা - বাণিজ্য ও শিল্পের প্রসারে সহায়ক হয়। মৌর্য যুগের শিল্প সংস্কৃতির উন্নতি সমকালীন ভারতকে এক মর্যাদাপূর্ণ স্থান প্রদান করে। 
ঐতিহাসিক কে এম পানিক্করের ভাষায় - ‘’ The century and a half of Maurya rule witnessed a growth of civilisation , arts and culture which entitled India to rank among the greatest countries of the time .’’ 


ধর্মশাস্ত্র , অর্থশাস্ত্র , বাৎসায়নের কামসূত্র , মেগাস্থিনিস ও ফা হিয়েনের রচনা থেকে মৌর্য যুগের শিল্পকলা সম্পর্কে জানতে পারা যায়। ভারতের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত অশোকের স্তম্ভগুলি , ভারুত ও সাঁচি স্তুপ , গয়ার সন্নিকটে আজিবক গুহাগুলি , চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও অশোকের প্রাসাদ - মৌর্য যুগের ভাস্কর্য শিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। অশোকের নির্মিত স্তুপ ও স্তম্ভগুলি সুক্ষ্ম শিল্পে নৈপুণ্য ও উন্নত রুচির সাক্ষ্য বহন করে। এক - একটি অখন্ড পাথর দিয়ে স্তম্ভগুলি নির্মিত। নন্দনগড় , এলাহাবাদ , রুমিনদেই , সারনাথ - ইত্যাদি স্থানে বহু স্তম্ভ আবিষ্কৃত হয়েছে। এদের কারুকার্য ও মসৃণতা আজও ইউরোপীয় শিল্পীদের নিকট বিস্ময়কর রয়েছে। 


সারনাথের স্তম্ভশীর্ষে নির্মিত পশুমূর্তি ভাস্কর্য শিল্পের অপূর্ব নিদর্শন। স্তম্ভশীর্ষের পশুমূর্তিগুলির সহজ ও স্বাভাবিকতা দেখে স্মিথ মন্তব্য করেছেন যে , এরূপ ভাস্কর্যের নিদর্শন অন্য কোনো দেশে একান্তই বিরল ; এতে আদর্শ ও বাস্তবের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। সারনাথ স্তম্ভের শিল্পনৈপুণ্য লক্ষ্য করে  স্যার জন মার্শাল মন্তব্য করেছেন , এর ক্ষোদাইকার্য ও রচনাভঙ্গি উৎকৃষ্ট এবং প্রাচীন জগতে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট ভাস্কর্য শিল্প কোথাও সৃষ্ট হয়নি। 

অশোকের আমলে বহু স্তুপ ও গুহামন্দির নির্মিত হয়েছিল। স্তূপগুলির মসৃণতা আজও বিস্ময়কর বস্তুরূপে পরিগণিত। এগুলি পাথর বা ইষ্টক নির্মিত। কোথাও কোথাও স্তূপগুলি পাথরের বেষ্টনি বা রেলিং দ্বারা পরিবেষ্টিত। প্রত্যেকটিতেই একটি বা দুটি করে কারুকার্য খচিত প্রবেশদ্বার রয়েছে। ভারত ও আফগানিস্তানে অশোক মোট ৮৪০০০ স্তুপ নির্মিত করেছিলেন। Havell এর মতে , ভারুত ও সাঁচীর স্তূপগুলির ভাস্কর্য শিল্পে অনার্য ও আর্য প্রভাবের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়। 

মৌর্যযুগে নির্মিত নগর ও রাজপ্রাসাদগুলি উন্নত স্থাপত্য শিল্পের সাক্ষ্য বহন করে। মেগাস্থিনিসের বিবরণী থেকে জানা যায় যে , নদী ও সমুদ্রের কাছে শহর ও গৃহগুলি কাষ্ঠনির্মিত ছিল। অভ্যন্তর অঞ্চলের গৃহগুলি ইষ্টকনির্মিত ছিল। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাষ্ঠনির্মিত প্রাসাদ দেখে মেগাস্থিনিস আশ্চর্য হয়েছিলেন। এখানে অনেকগুলি বৃহৎ তোরণ ও স্তম্ভ ছিল এবং মেঝেগুলি কাষ্ঠনির্মিত ছিল। অনেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রাসাদে পারসিক প্রভাব লক্ষ্য করেছেন। অশোকের প্রস্তরনির্মিত প্রাসাদটি ফা - হিয়েনকে বিস্ময়াভূত করেছিল। কিন্তু এই প্রাসাদগুলি বর্তমানে সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত। এগুলির সামান্য কিছু অংশ আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এরমধ্যে একশত স্তম্ভযুক্ত একটি বিরাট কক্ষের নিদর্শন পাওয়া গেছে। 

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পাটলিপুত্রের প্রাসাদ ও অশোকের প্রাসাদ :-
মেগাস্থিনিসের বিবরণী থেকে জানা যায় - মৌর্য যুগে পাটলিপুত্রে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজপ্রাসাদ ছিল কাষ্ঠের সূক্ষ্ম কারুকার্য দ্বারা সমৃদ্ধ। এই রাজপ্রাসাদটির সাথে ইরানের বিখ্যাত রাজপ্রাসাদটির তুলনা করা যায়। এতে অনেকগুলি তোরণ ছিল এবং মেঝে ছিল কাষ্ঠের নির্মিত। এছাড়া স্তম্ভগুলিতে স্বর্ণ ও রৌপ্যের কারুকার্য খচিত নিদর্শন ছিল সত্যই চিত্তাকর্ষক।   
এছাড়া সম্রাট অশোক একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন যা ছিল বিশালাকার এবং সৌন্দর্য মন্ডিত প্রস্তর দ্বারা নির্মিত। পাথরগুলির দর্পনের ন্যায় মসৃণতা ফা - হিয়েনকে চমকৃত করেছিল। 


অশোক স্তম্ভ :-
সম্রাট অশোকের আমলের শিল্পকলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হল অশোকস্তম্ভ। ভারতীয় সম্রাটদের মধ্যে অশোকই সর্বপ্রথম পাথর কেটে স্তম্ভ নির্মাণের আয়োজন করেন। এক একটি অখন্ড পাথর দিয়ে স্তম্ভগুলি নির্মিত ছিল। সারনাথে প্রাপ্ত শিলাস্তম্ভটি ছিল মৌর্য স্থাপত্যের গৌরবের এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এখানে স্তম্ভলিপির শীর্ষভাগে থাকা সিংহমূর্তিগুলি শিল্পীর উৎকৃষ্ট দক্ষতার সাক্ষ্য বহন করে। স্তম্ভশীর্ষে হাতি , ঘোড়া , বৃষ ও সিংহ - এই চারটি প্রাণীর মূর্তি রয়েছে। এর উপরে চারটি সিংহমূর্তি অবস্থিত। এগুলি '' ধর্মচক্র '' নামে পরিচিত। এই নিদর্শনটি উৎকৃষ্টতা , মানবতা , গাম্ভীর্য , গৌরব - ইত্যাদির প্রতীক। স্বাধীনোত্তরকালে ভারত সরকার এটিকেই জাতীয় প্রতীক হিসেবে চয়ন করেছেন।       


মৌর্য শিল্পে পারসিক ও গ্রীক প্রভাব :-
ইউরোপীয় ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ববিদগণ যথা , জন মার্শাল , মসিয়েঁ স্যানহার্ত প্রমুখের মতে , অশোকের পাটলিপুত্র নগরের প্রাসাদ , সারনাথের প্রাসাদ , সারনাথ স্তম্ভশীর্ষের সিংহমূর্তি প্রভৃতিতে পারসিক ও গ্রীক প্রভাব অনুসৃত হয়েছিল। জন মার্শালের মতে , পারসিক ও গ্রীক শিল্পরীতি ভারতীয় শিল্পীরা সম্পূর্ণভাবে আত্মস্থ করেছিল। কিন্তু ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ ও স্থাপত্যবিদগণ যথা , কে এম পানিক্কর , ডক্টর তারাপদ এবং স্থাপত্য বিশারদ শ্রী শরৎচন্দ্র - প্রমুখের মতে , অশোকের স্থাপত্য পরিকল্পনার মধ্যে পারসিক বা গ্রীক প্রভাব ছিল না। এর মধ্যে আর্য ও অনার্য প্রভাবের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়। Havell ও এই মত সমর্থন করেন। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে , বৈদেশিক শিল্পরীতি ভারতীয় শিল্পরীতিকে প্রভাবিত করার পরিবর্তে ভারতীয় শিল্পরীতি মধ্য এশিয়া , চীন - প্রভৃতি স্থানে বিশেষ রেখাপাত করেছিল। 

মৌর্য শিল্পে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব :-
সম্রাটবা অশোকের সময় থেকে তুর্কিদের আগমনকাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যে শিল্পকলা গড়ে উঠেছিল তা বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিল। মৌর্য শাসনকালে ভারতের বিভিন্ন স্থানের বহু বৌদ্ধ সংঘারাম , স্তুপ , স্তুপের আবেষ্টনী ( রেলিং ) , তোরণ , চৈত্য - ইত্যাদি নির্মিত হয়েছিল। সম্রাট অশোক কর্তৃক নির্মিত সাঁচীর বৃহৎ স্তূপটি , এর আবেষ্টনী ও তোরণ বৌদ্ধ স্থাপত্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ভারুত স্তুপের আবেষ্টনী এবং সাঁচি স্তুপের আবেষ্টনী ও তোরণগুলিতে বুদ্ধের জীবন ও বৌদ্ধ ধর্ম সংক্রান্ত বহু উপাখ্যান নিপুণভাবে ক্ষোদিত রয়েছে। বস্তুতঃ মৌর্য শিল্প বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিল - একথা বলা যেতে পারে।        

    

এই ওয়েবসাইটের সমস্ত প্রশ্নোত্তরের তালিকা / সূচীপত্রের জন্য এখানে CLICK করো।

  

You May Also Like

0 comments