Features of Neolithic Age .নব্য প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য

by - June 26, 2021

নব্য প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো। Discuss the different features of Neolithic Age .




নব্য প্রস্তর যুগ ও তার বিবিধ বৈশিষ্ট :-


প্রেক্ষাপট ও সময়কাল :-
সুদূর অতীত থেকে শুরু করে ইতিহাসের লিখিত উপাদানের প্রাপ্তি কালের পূর্ব পর্যন্ত সময়কালকে প্রাগৈতিহাসিক যুগ বলা হয়। মানুষ প্রথম থেকে বিভিন্ন ধরণের পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করে খাদ্যের সংস্থান করত। তাই এই যুগকে প্রস্তর যুগ বলা হয়। বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ববিদগণ পাথরে নির্মিত হাতিয়ারের ক্রমোন্নতি লক্ষ্য করে প্রস্তর যুগ কে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন যথা - (১) প্রাচীন প্রস্তর যুগ (২) মধ্য প্রস্তর যুগ ও (৩) নব্য প্রস্তর যুগ। নব্য প্রস্তর যুগের শেষে মানুষ ধাতুর ব্যবহার শুরু করে। তারা সর্বপ্রথম তামা এবং এর কিছুকাল পর ব্রোঞ্জ ধাতুর ব্যবহার শেখে। তাই নব্য প্রস্তর যুগের পরবর্তী সময় কাল হলো তাম্র প্রস্তর যুগ। 

মধ্য প্রস্তর যুগের পরবর্তী নব্য প্রস্তর যুগের কালসীমা  হলো আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দ। তবে ভারতে এ যুগের সূচনা হয় দেরিতে ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। বালুচিস্তানের মেহেরগড় সভ্যতায় ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বা তার কিছু আগে নব্য প্রস্তর যুগের সূচনা হয় বলে ঐতিহাসিক ডি পি আগরওয়াল অভিমত দিয়েছেন। 


হাতিয়ার ও তার বৈপ্লবিক অগ্রগতি :-
এই যুগের হাতিয়ারগুলিতে ধারাবাহিক বিবর্তনের ছাপ সুস্পষ্ট। হাতিয়ারগুলিতে ধারাবাহিক বিবর্তনের ছাপ স্পষ্ট। হাতিয়ারগুলি এসময় যথেষ্ট তীক্ষ্ণ , মসৃণ ও উন্নত হয়ে ওঠে। এ যুগে মাটি খুঁড়ে বীজ বপন বা আগাছা পরিষ্কারের জন্য নতুন ধরনের যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন ঘটে। ফসল কাটার জন্য এ সময় তৈরি হয় কাস্তে। এছাড়া কুলো , হামানদিস্তা , শিলনোড়া , জাঁতা , হাতুড়ি , বাটালি , নেহাই - প্রভৃতি যন্ত্রপাতির উদ্ভব এ যুগেই শুরু হয়। এযুগে প্রাচীন প্রস্তর যুগের হাতকুঠারের অভাবনীয় উন্নতি ঘটে। এ সময় কুঠারের সামনের দিকটি অনেক বেশি তীক্ষ্ণ এবং কাঠের হাতলযুক্ত হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিকাজ এবং পশু শিকারের জন্য উন্নত হাতিয়ারের প্রয়োজনীয়তাও বৃদ্ধি পায়। 


কৃষির সূচনা :- 
নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ কৃষিকাজের কৌশল আবিষ্কার করে এবং স্থায়ীভাবে এক জায়গায় বসবাস শুরু করে। ফলে খাদ্য সংগ্রহকারী থেকে এই যুগে মানুষ খাদ্য উৎপাদনকারী তে পরিণত হয়। পূর্বে খাদ্য ও আশ্রয়ের নিশ্চয়তা না থাকায় প্রকৃতিতে মানুষ ছিল বড়ই অসহায়। কিন্তু নব্য প্রস্তর যুগে কৃষির আবিষ্কারের ফলে মানুষের সেই অনিশ্চয়তা দূর হয়। সুতরাং নব্য প্রস্তর যুগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো কৃষির আবিষ্কার। এর ফলে মানুষের যাযাবর বৃত্তির অবসান ঘটে। ফসল মজুদ রাখার জন্য প্রয়োজন ছিল পাত্রের। তাই বলা যায় কৃষিকাজ পাত্র নির্মাণকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করেছিল। মৃৎ শিল্পের সূচনা হয়েছিল এই ভাবেই। ভারতীয় উপমহাদেশে বালুচিস্তানের মেহেরগড়ের মানুষ প্রথম কৃষিকাজ শুরু করেছিল। কৃষিজ ফসলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল যব , গম , ভুট্টা , খেজুর ইত্যাদি। তুলোর  চাষে মেহেরগড় - এর কৃষকেরা অভ্যস্ত ছিল। 

পশুপালন :- 
নব্য প্রস্তর যুগের মানুষেরা কৃষির প্রয়োজনে পশু পালন করতে শুরু করে। পশুকে কৃষিজমিতে কাজে লাগিয়ে কৃষি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়। পরিবহণের কাজেও পোষ মানানো পশুকে কাজে লাগানো শুরু হয়। এই সময় দক্ষিণ এশিয়ায় হাতি ও মহিষকে এবং জর্ডনে  কুকুর ও ছাগলকে প্রতিপালন করা শুরু হয়। মনে করা হয় মানুষ সর্বপ্রথম কুকুরকে পোষ মানিয়েছিল। তারপর গরু , মোষ , ভেড়া , ছাগল ইত্যাদি পুষতে থাকে। 

স্থায়ী বসতি নির্মাণ :- 
নব্য প্রস্তর যুগে কৃষির আবিষ্কারের ফলে মানুষ নির্দিষ্ট কোন অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ফলে মানুষের যাযাবর জীবনের অবসান ঘটে। এসময় বন্য পশুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয় মানুষের অনেকটা কমে যায়। তারা এ যুগের শেষ দিকে কুটির বা গৃহনির্মাণ করতে শুরু করে। কুটির তৈরির জন্য তারা গাছের ডালপালা , লতাপাতা , ঘাস প্রভৃতি ব্যবহার করত। এই বসতি অঞ্চল ক্রমে গ্রামে পরিণত হয়। কোথাও কোথাও এই গ্রামগুলিকে কেন্দ্র করে নগর গড়ে ওঠার সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।  


সমাজ জীবন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সূচনা :- 
নব্য প্রস্তর যুগে সংঘবদ্ধ জীবন আবশ্যিক হয়ে পড়েছিল। কারণ কৃষিকাজ ও পশুপালন সংঘবদ্ধভাবেই সম্ভব। পৃথিবীর প্রাচীনতম সামাজিক সংগঠন হলো পরিবার। কৃষিভিত্তিক সামাজিক - অর্থনৈতিক জীবন টিকিয়ে রাখার জন্য সমাজে চালু হয় শ্রমবিভাজন। নারী ও পুরুষেরা  নিজেদের মধ্যে শ্রম ভাগ করে নিতে শুরু করে। পুরুষেরা হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি বানাত , পশু পালন করত , ঘরবাড়ি বানাত - ইত্যাদি। শিকারি জীবনে তখনও সম্পূর্ণ ছেদ পড়েনি। শিকারের কাজ পুরুষেরাই করত। নারীরা গৃহস্থালির কাজকর্মের পাশাপাশি কৃষি কাজে বড় ভূমিকা নিত। তাছাড়া মৃৎপাত্র তৈরীর ও বস্ত্রবয়ন প্রভৃতি কাজ নারীরা করত। 

নগর সভ্যতা গড়ে ওঠার পুর্বে পৃথিবীতে রাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রতিষ্ঠার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। পূর্বে মানুষের যাযাবর বৃত্তির জন্য কোনো গোষ্ঠীর নেতার পদটি সর্বদা স্বল্পস্থায়ী হতো। কিন্তু নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ যাযাবর জীবন ছেড়ে নির্দিষ্ট অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তুললে কোনো গোষ্ঠীর নেতা বা দলপতির পদটি স্থায়িত্ব লাভ করে। উর্বর কৃষি জমি দখল ও অন্যান্য কারণে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ হত। সংঘর্ষে জয়লাভের প্রয়োজনে দলনেতারা তাদের গোষ্ঠীর ওপর বিভিন্ন নিয়ম-কানুন চাপিয়ে দিতেন। এভাবে একটি প্রশাসনিক পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল। নব্য প্রস্তর যুগেই রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠার একটি পটভূমি তৈরি হয়েছিল বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করে থাকেন। 

চাকার ব্যবহার ও অন্যান্য অগ্রগতি :-
কৃষির আবিষ্কারের ফলে নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ পর্যাপ্ত খাদ্য সংস্থান করতে সক্ষম হলে তাদের খাদ্যের জন্য আর বিশেষ চিন্তা করতে হতো না। এর ফলে অবসরকালে মানুষ নিজেদের চিন্তা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দিকের অগ্রগতির সুযোগ পায়। এই সময় মানুষ আগুনের  নানাবিধ ব্যবহার , চাকার আবিষ্কার , মৃৎশিল্প , যানবাহন তৈরি , নৌকায় পাল লাগানো , গৃহনির্মাণ , পাথর সাজিয়ে ডেলমেন নামক সমাধি নির্মাণ - প্রভৃতি করতে শেখে। এই যুগের শেষের দিকে মানুষ ধাতুর ব্যবহার করতে শেখে।   এককথায় অন্যান্য প্রস্তর যুগের তুলনায় নব্য প্রস্তর যুগের অগ্রগতি ও প্রাপ্তি ছিল অনেক বেশি। নব্য প্রস্তর যুগের এই অভাবনীয় অগ্রগতি লক্ষ্য করে গবেষক গর্ডন চাইল্ড একে '' নব্য প্রস্তর যুগের বিপ্লব '' বলে অভিহিত করেছেন। এককথায় নব্য প্রস্তর যুগের স্থায়িত্বকাল পুরাতন প্রস্তর যুগের তুলনায় অনেক কম হলেও নব্য প্রস্তর যুগের অগ্রগতি ও ব্যাপ্তি ছিল অনেক বেশি। 


নব্য প্রস্তর যুগের বিপ্লব :- 
এ যুগে কৃষি-সহ বিভিন্ন বিষয়ে যেসব অগ্রগতি লক্ষ্য করা গিয়েছিল সেগুলির গভীর বিশ্লেষণ করে বিখ্যাত ঐতিহাসিক গর্ডন চাইল্ড সেগুলিকে সেসময়ের মানুষের অগ্রগতির স্বাভাবিক ধারা বলে মানতে পারেননি। পূর্ববর্তী যুগ গুলির তুলনায় অনেক কম সময়ে নব্য প্রস্তর যুগে যে অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটেছিল তাকে গর্ডন চাইল্ড '' নব্য প্রস্তর যুগের বিপ্লব '' বলে অভিহিত করেছেন। 

অর্থনৈতিক জীবন :- 
নব্য প্রস্তর যুগের মানুষের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল কৃষি ও পশুপালন। হাতিয়ারের উন্নতির ফলে এই সময় কৃষি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমাজে বিনিময় প্রথার প্রচলন ঘটে। সমাজে ক্রমে শ্রম বিভাজনের সূত্রপাত ঘটে। পুরুষ ও নারীর মধ্যেই এই শ্রম বিভাজন দেখা যায়। পুরুষদের কাজ ছিল হাতিয়ার তৈরি , পশুপালন ও ঘরবাড়ি তৈরি। অন্যদিকে নারীদের কাজ ছিল গৃহকার্য , সন্তান পালন , কৃষিকাজ , বস্ত্র উৎপাদন , মৃৎপাত্র তৈরি , ঝুড়ি তৈরি - প্রভৃতি। 
এক কথায় বলা যায় , নব্য প্রস্তর যুগের শ্রমবিভাজন এর সূচনা ভবিষ্যৎ ভারতীয় সমাজের অর্থনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং নব্য প্রস্তর যুগের কৃষি ও পশুপালনের ভিত্তি বহুদিন যাবৎ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল এবং আজও ভারতের অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ হল কৃষি। 

শিল্পকলা :- 
নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ প্রতীকী চিহ্নযুক্ত ছবি আঁকতো , যা আগেকার যুগের চিত্রাঙ্কন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এশিয়ার বিভিন্ন প্রত্নক্ষেত্র এবং মিশরে আবিষ্কৃত মৃৎপাত্রের গায়ের  অলংকরণ থেকে ওই সময়কার অলংকরণ শিল্পের পরিচয় পাওয়া যায়। এই সময় মানুষ মাতৃকাদেবীর মূর্তি গড়েছিল। ঈজিয়ান সভ্যতার অন্তর্গত ক্রীট - এ ওই  ধরনের মূর্তির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। ওই সময়কার মানুষ প্রাকৃতিক শক্তিকে জয় করতে পারেনি , যে কারণে ওই শক্তিকে তারা ভয় পেত। তাই তারা প্রাকৃতিক শক্তির পূজারি হিসেবে পরিচিত হয়েছিল। 

অস্তিত্বের নিদর্শন :- 
ভারতের মেহেরগড় সভ্যতা নব্য প্রস্তর সংস্কৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এছাড়া ইরাকের জারমো ও হাসুনা , জর্ডনের জেরিকো , দক্ষিণ মেসোপটেমিয়া , আনাতোলিয়া মালভূমি , সুইজারল্যান্ড , বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত বালুচিস্তান , ভারতের বিহার , উড়িষ্যা ও দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন স্থানে নব্য প্রস্তর যুগের সংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া গেছে। 

নব্য প্রস্তর যুগের গুরুত্ব :- 
প্রাচীন যুগের ইতিহাসে এবং ইতিহাসের বিবর্তন সমাজ জীবনের বিবর্তনে নব্য প্রস্তর যুগের কিছু বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। যেমন 
A .এ যুগের হাতিয়ার গুলি অভাবনীয় উন্নতি সম্ভব হয়। তার কার্যকারিতা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। 
B. নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ চাষবাস করতে শেখে। এর ফলে মানুষের জীবনধারার যথেষ্ট উন্নতি সম্ভব হয়। 
C. এ যুগের মানুষ বিভিন্ন পশুকে পোষ মানাতে আরো দক্ষ হয় এবং তাদের সঠিকভাবে কাজে লাগাতে শেখে। 
D. নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ স্থল ও জলপথে যাতায়াতের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটায়। 
E. কৃষি ও পশুপালনের মাধ্যমে নব্য প্রস্তর যুগে স্বচ্ছলতা আছে। তার ফলে নতুন নতুন আবিষ্কার সম্ভব হয়। যেমন - গৃহনির্মাণ , চাকা তৈরী , নৌকা তৈরি , লাঙল তৈরি প্রভৃতি।
F. এ যুগে মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে উপজাতীয় ধরণের সমাজ গড়ে তোলে। 
G. সামাজিক সংগঠন হিসাবে পরিবার ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। 
H. এই সমাজে পেশাভিত্তিক বিভিন্ন শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। 
I.নব্য প্রস্তর যুগে মানুষের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক ও  বিনিময় প্রথার ব্যাপকতার ফলে ভাব - বিনিময়ের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ক্রমে ভাষার উন্নতি ঘটে। 
J. এ যুগে বিভিন্ন প্রতীকের সাহায্যে চিত্রাঙ্কন করা হতো। এগুলি লিখন পদ্ধতির আবিষ্কারের প্রাথমিক প্রয়াস বলে মনে করা হয়। 



You May Also Like

0 comments