Features of Chalcolithic Age . তাম্র - প্রস্তর সংস্কৃতির পরিচয় ও বৈশিষ্ট :-

by - June 26, 2021

তাম্র প্রস্তর সংস্কৃতির বর্ণনাসহ এই যুগের বৈশিষ্ট্য গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো। 

Discuss the different features of Chalcolithic Age .  




তাম্র - প্রস্তর সংস্কৃতির পরিচয় ও বৈশিষ্ট :-   

সভ্যতার উষালগ্নে ধারাবাহিক মানব সভ্যতার উন্নতির পথে এক বিশেষ অগ্রগতির মাধ্যম হলো ধাতুর ব্যবহার। ধাতুর মধ্যে তামা মানুষের কাছে সহজলভ্য হয়েছিল এবং জটিল ধাতুবিদ্যা ছাড়া সাধারণ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তামা গলিয়ে বিভিন্ন হাতিয়ার মানুষ তৈরি করতে শিখেছিল। তাই সভ্যতার যে যুগে মানুষ পাথরের পাশাপাশি তামার আসবাব ও হাতিয়ার তৈরি ও ব্যবহার করত - তাকে তাম্র প্রস্তর যুগ বা Chalcolithic Age বলা হয়। ( গ্রিক শব্দ Cholkos অর্থাৎ তামা এবং Lithos অর্থাৎ পাথর ) অবশ্য প্রথমদিকে মানুষ খনি থেকে তামার আকরিক সংগ্রহের পদ্ধতি জানত না। তারা পাথরের সঙ্গে লেগে থাকা তামার আকরিক সংগ্রহ করে এবং তা উত্তপ্ত করে কাঁচা তামা সংগ্রহ করত। 


সময়কাল :-
আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ৩০০০ অব্দ পর্যন্ত পৃথিবীতে তাম্র প্রস্তর যুগের অস্তিত্ব ছিল। মনে করা হয় , ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ বা তার পরবর্তীকালে সুমেরের মানুষরা সর্বপ্রথম খনিজ তামার ব্যবহার শুরু করে। পরবর্তীকালে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এশিয়া , আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন অংশে তামার ব্যবহার যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। আমেরিকায় তামার ব্যবহার শুরু হয় আরো অনেক পরে। 

তামার ব্যবহার ও তার সুবিধা :-
তামার ব্যবহার শুরু হলে মানব সভ্যতার ইতিহাসে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যায়। হাতিয়ার তৈরিতে তামা ব্যবহারের কিছু সুবিধা ছিল। পাথরের তুলনায় তামার হাতিয়ার অনেক বেশী মজবুত হত। তামাকে আগুনে গলিয়ে  বিভিন্ন আকারের হাতিয়ার তৈরি করা যেত। এই হাতিয়ার পাথরের তুলনায় অনেক বেশি ধারালো ও তীক্ষ্ণ হয়। 


ব্রোঞ্জের ব্যবহার :- 
তামার ব্যবহার সর্বত্র সমান ছিল না। তাছাড়া তামার মত নরম ধাতু দিয়ে উন্নত হাতিয়ার ও টেকসই আসবাব তৈরি করা যাচ্ছিল না। তাই প্রয়োজন মেটাতে আমার সঙ্গে টিন  মিশিয়ে নতুন সংকর ধাতু ব্রোঞ্জ আবিষ্কৃত হয়। ব্রোঞ্জের হাতিয়ারগুলো তামার হাতিয়ারের থেকে আরও অনেক মজবুত , ধারালো ও উন্নত হয়ে ওঠে। এইজন্য তাম্র প্রস্তর যুগের পরবর্তী কাল '' তাম্র ব্রোঞ্জ যুগ '' নামে পরিচিত। তবে পশ্চিম এশিয়ার ব্রোঞ্জ তৈরির কৌশল আবিষ্কার ও ব্রোঞ্জের ব্যবহার হয় আনুমানিক চার হাজার থেকে তিন হাজার পাঁচশ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। 

হাতিয়ার তৈরিতে অগ্রগতি :-
তামার তুলনায় ব্রোঞ্জ অধিক কঠিন , দীর্ঘস্থায়ী ও এর ক্ষয় কম হওয়ায় সহজেই এই ধাতু মানুষকে আকৃষ্ট করে। তাই ব্রোঞ্জ যুগ ছিল দীর্ঘস্থায়ী ও গ্রহণযোগ্য। ব্রোঞ্জ উদ্ভাবনের পরে বিভিন্ন আকৃতিবিশিষ্ট কুঠার , কাটারি , তলোয়ার , টাঙ্গি ইত্যাদি তৈরি করা হয়। তাম্র ব্রোঞ্জ যুগের হাতিয়ারের   একটা বড় অংশ ছিল যুদ্ধাস্ত্র। আঘাত করা এবং  আত্মরক্ষা উভয় ধরনের ব্রোঞ্জ অস্ত্র পাওয়া যায়। যেমন- ব্রোঞ্জের বর্ম , শিরস্ত্রাণ , তলোয়ার , বর্ষা , তির - ইত্যাদি। এর থেকে মনে করা হয় এই যুগে মানুষের মনে শান্তি ছিল না এবং তাদেরকে বিভিন্ন কারণে সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত থাকতে হত। 


কৃষির উন্নতি :-
তাম্র প্রস্তর সংস্কৃতির অপর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হল এ সময় মানুষ স্থায়ী কৃষিজীবী এবং খাদ্য উৎপাদনকারীতে পরিণত হয়েছিল। তাই নব্য প্রস্তর যুগের তুলনায় কৃষিকাজ আরও উন্নত হয়। পশুর টানা কাঠের লাঙল , ব্রোঞ্জের কাস্তে ব্যবহার করা হয়। জমি পরিষ্কারের জন্য ব্রোঞ্জের কুঠার ও কাটারি ব্যবহার করা হত। মাছ শিকারের জন্য হারপুন বা বঁড়শিও ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি করা হত। 


অন্যান্য ক্ষেত্রে অগ্রগতি :-
তাম্র প্রস্তর যুগে ধাতুর ব্যবহারের ফলে উন্নত কুঠার , তলোয়ার , বর্শা , তিরের ফলা , লাঙল প্রভৃতির যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সামগ্রী তৈরী হতে থাকে। কাঠের ব্যবহারে সময় যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। কাঠ  দিয়ে নৌকা ও ঘরবাড়ি তৈরি হতে থাকে। কুমোরের চাকা এ যুগে আরও উন্নত হলে মৃৎশিল্পের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। বস্ত্র উৎপাদনের জন্য তাঁতের প্রচলন বৃদ্ধি পায়। রান্নার কাজে ধাতুর পাত্রের ব্যবহার শুরু হলে মানুষের খাদ্যাভাসে যথেষ্ট পরিবর্তন আসে। 

নগর সভ্যতার সূচনা :-
তাম্র প্রস্তর যুগে কৃষিজীবী মানুষ বিভিন্ন নদীর তীরে বসতির প্রসার ঘটায়। নদীর তীরে উর্বর কৃষি জমিতে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি , জমিতে জল সেচের সুবিধা , নদী থেকে মাছ ধরার সুবিধা , নদী পথে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের সুবিধা -  প্রভৃতির ফলে বিভিন্ন নদী উপত্যকা অঞ্চলের জনঘনত্ব যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। ক্রমে এইসব অঞ্চলে নগরজীবন প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতে হরপ্পা সভ্যতা এরূপ  নগর সভ্যতার অন্যতম উদাহরণ। 

পুরুষের প্রাধান্য :- 
কৃষিজমিতে লাঙল ব্যবহার করা , পশু পালন করা ও কৃষিকাজে পশুকে ব্যবহার করা - প্রভৃতি কাজে শারীরিক শক্তির বিশেষ প্রয়োজন ছিল। ফলে এসব কাজের তাম্র প্রস্তর যুগের মেয়েদের তুলনায় পুরুষের ভূমিকা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। এসময় থেকে জীবন জীবিকার ক্ষেত্রে পুরুষের প্রাধান্য স্থাপিত হয় এবং সামাজিক কর্তৃত্বের বিষয়ে মেয়েরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে। ক্রমে ক্রমে সমাজের সব ক্ষেত্রে পুরুষের প্রাধান্য স্থাপিত হয়। 

খাদ্য ও বাসস্থানের ক্ষেত্রে পরিবর্তন :-
তাম্র প্রস্তর যুগের মানুষ খাদ্য ও বাসস্থান এর চাহিদা পূরণ করে নতুনভাবে এবং আরও উন্নততর ভাবে করতে শেখে।  বসতি এলাকা গড়ে তোলে। গাছের গুড়ি , পাতা ও খড়ের  ছাউনি দেওয়া ঘর প্রথমে তৈরি করে। পরে কাঁচা বা পোড়া   ইটের বাড়ি তৈরি করা হয়। খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খামার , উঠান পরিচর্যা , শস্য সংরক্ষণের জন্য পাত্র তৈরি বা কক্ষ বিশিষ্ট ইঁটের শস্যাগার নির্মাণ ও ভবিষ্যৎ খাদ্য সঞ্চয় করতে শেখে। রান্নার কাজে ধাতুর পাত্রের ব্যবহার শুরু হলে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে যথেষ্ট পরিবর্তন আসে। 

পরিবহন ব্যবস্থায় চাকার ব্যবহার :-
তাম্র প্রস্তর সভ্যতার গতি আনে কাঠের ও ধাতুর চাকা। যানবাহন ও মাটির পাত্র তৈরিতে চাকার ব্যবহার শুরু হয়। চাকার ব্যবহার করে সুমের ও মেসোপটেমিয়াতে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চাকাওয়ালা গাড়ি , যুদ্ধরথ , যাত্রীবাহী গাড়ির  প্রচলন হয়েছিল। ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিন্ধু উপত্যকায় চাকার ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। চাকার ব্যবহার থেকে মৃৎশিল্পে মানুষের দক্ষতা লক্ষ্য করা যায়। 

ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি :-
তাম্র প্রস্তর যুগের জীবিকায় কৃষি , পশুপালনের সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যের প্রচলন ও আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। নদী উপত্যকায় গুদাম নির্মিত হয়। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে দূরদেশে যাতায়াতের জন্য বাণিজ্যতরী ব্যবহৃত হত। গাছের গুড়ি দিয়ে নৌকা ও বাণিজ্যতরি নির্মিত হত। এই যুগেই সর্বপ্রথম নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বাজার গড়ে ওঠে। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ তাদের উৎপাদিত দ্রব্য বেচাকেনার জন্য এই বাজারে এসে জড়ো হত। 

অস্তিত্বের নিদর্শন :-
ভারত , মেসোপটেমিয়া , এশিয়া মাইনর , মিশর , গ্রিস প্রভৃতি স্থানে তাম্র - ব্রোঞ্জ যুগের সূত্রপাত ঘটে। ভারতের মেহেরগড় সভ্যতায় ৪৩০০ - ৩৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তামা গলাবার পদ্ধতি চালু ছিল বলে প্রমান পাওয়া গেছে। অবশ্য এ যুগে এসব স্থানে তামা বা ব্রোঞ্জের ব্যবহার শুরু হলেও প্রথমদিকে তামার পাশাপাশি পাথরের ব্যবহারও চলতে থাকে। কেননা , তামা বা ব্রোঞ্জ ধাতু পাথরের মত সহজলভ্য ছিল না বা এসব ধাতু নিষ্কাশন করে তা দিয়ে হাতিয়ার তৈরির প্রক্রিয়া মোটেই সহজ ছিল না। 

পরিশেষে বলা যায় , তামা আবিষ্কারের ফলে  মানবসভ্যতার ইতিহাসে যুগান্তকারী পরিবর্তন দেখা যায়। পাথরের অস্ত্রের তুলনায় তামার তৈরী অস্ত্র অনেক বেশি ধারালো ও তীক্ষ্ণ হওয়ায় তাম্র প্রস্তর যুগে মানবসমাজে অভাবনীয় উন্নতি ঘটে। ভারতে তাম্রাশ্মীয় গ্রাম সভ্যতার বিকাশ ঘটে। বোলান নদীর তীরে অবস্থিত মেহেরগড় ছিল তাম্রাশ্মীয় সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। পুরাতত্ত্ববিদ গ্রেগরি পোসেল বলেছেন - '' ভারতের তাম্রাশ্মীয় সভ্যতাই পৃথিবীতে প্রাচীনতম। ''   


You May Also Like

0 comments