গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী ( Gautamiputra Satkarni )

by - June 26, 2021

সাতবাহন বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট কে ছিলেন ? তাঁর কৃতিত্ব আলোচনা কর। 
অথবা , শাসক ও বিজেতা হিসেবে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর সাফল্য ও কৃতিত্ব আলোচনা কর। 




শাসক ও বিজেতা হিসেবে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর সাফল্য ও কৃতিত্ব


মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর এই ধ্বংসপ্রাপ্ত সাম্রাজ্যের উপর কয়েকটি রাজ্য গড়ে ওঠে। যথা - উত্তর ভারতের শুঙ্গ রাজ্য , উড়িষ্যার খারবেলের রাজ্য এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের সাতবাহন রাজ্য। এদের মধ্যে সাতবাহন সাম্রাজ্য বিস্তার ও স্থায়িত্বের দিক দিয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল। ডক্টর হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী মনে করেন যে , খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে সাতবাহন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু , স্মিথ প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে , খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকেই বিশেষতঃ ২৩৫ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ২২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সাতবাহন রাজবংশ বিদ্যমান ছিল। এই রাজবংশের শ্রেষ্ঠ নরপতি ছিলেন গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী। 


( A ) সাতবাহন বংশ সম্পর্কিত ঐতিহাসিক বিতর্ক :-
সাতবাহন বংশ সম্পর্কে ঐতিহাসিক বিতর্ক রয়েছে। তবে কয়েকটি সূত্র থেকে গৌতমীপুত্রের রাজত্বকাল নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। তিনি নহপানের সমসাময়িক ছিলেন এবং তাঁকে তিনি চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেছিলেন। এই ঘটনাটি ১২৪ - ১২৫ খ্রিষ্টাব্দে ঘটে বলে মনে করা হয়। তার কারণ এর পর নহপানের অস্তিত্বের কোনো প্রমান পাওয়া যায় না। আরও মনে করা হয় যে গৌতমীপুত্রের রাজত্বের অষ্টাদশ বৎসরে তিনি নহপানকে পরাজিত করেন। সুতরাং , ১০৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর রাজত্ব শুরু হয়েছিল। তাঁর শেষ লেখাটি তাঁর রাজত্বকালের চতুর্বিংশ বৎসরে রচিত হয়েছিল। সম্ভবতঃ তখন তিনি পঙ্গু হয়ে পড়েছিলেন। কারণ এই লেখাটি গৌতমী বলশ্রীর সঙ্গে যুক্তভাবে রচিত হয়েছিল। সুতরাং , তাঁর রাজত্বকাল ১০৬ থেকে ১৩০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে ধরা যেতে পারে। 


( B ) গৌতমী বলশ্রীর শিলালিপি :- 
গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর মাতা গৌতমী বলশ্রীর শিলালিপিতে তাঁর রাজত্বকালের ও রাজ্য জয়ের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এই শিলালিপিতে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীকে গোঁড়া ব্রাক্ষ্মণ এবং শক , যবন (গ্রীক ) ও পল্লবদের উচ্ছেদকারী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া উক্ত শিলালিপিতে তাঁকে উত্তর কোঙ্কন , সৌরাষ্ট্র , অবন্তী - প্রভৃতি রাজ্যের অধীশ্বর বলা হয়েছে। 


( C ) সাম্রাজ্যের বিস্তার :-
সাতকর্ণী মহারাষ্ট্র ও পার্শ্ববর্তী প্রদেশসমূহ পুনরুদ্ধার করে সাতবাহন বংশের লুপ্ত গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। মহারাষ্ট্র পুনরুদ্ধার তাঁর প্রধান কৃতিত্ব হলেও একমাত্র কৃতিত্ব নয়। নাসিক প্রশস্তিতে তিনি যে অঞ্চলগুলি শাসন করতেন তাদের নামের বিস্তৃত তালিকা রয়েছে। এই নামগুলি হল আসিক (মহারাষ্ট্র ) , মূলক ( পৈথানের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ) , সুরথ ( কাথিয়াবার ) , বিদর্ভ (বেরার ) , আকর ( পূর্ব মালব ) এবং অবন্তী ( পশ্চিম মালব ) । এছাড়া এই প্রশস্তিতে গৌতমীপুত্রকে বিন্ধ্য পর্বত থেকে মলয় পর্বত পর্যন্ত এবং পূর্বঘাট পর্বতমালা থেকে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিপতি বলা হয়েছে। 

ডক্টর রায়চৌধুরীর মতে , এই তালিকায় অন্ধ্র ও দক্ষিণ কোশলের নাম নেই। কিন্তু লেখ ও হিউ এন সাঙ এর বিবরণী থেকে জানা যায় যে , এই দুটি অঞ্চল কোনো না কোনো সময়ে সাতবাহন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। গৌতমীপুত্র দাবী করেছেন যে , তাঁর  সৈন্যদল আরব সাগর , ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের জল পান করেছিল।
 
এছাড়া , ডক্টর কে . গোপালাচারী বলেছেন যে , গৌতমীপুত্রের অধিকৃত স্থান সমূহের মধ্যে মহেন্দ্র - র উল্লেখ আছে। এ থেকে কলিঙ্গ ও অন্ধ্র তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল - তার প্রমান পাওয়া যায়। 


( D ) শক - যবন - পল্লব ধ্বংসকারী :-
নাসিক প্রশস্তিতে গৌতমীপুত্রকে শক , যবন ও পল্লবদের ধ্বংসকারী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যোগাল থেম্বিতে প্রাপ্ত মুদ্রা থেকে শকদের সঙ্গে তাঁর সংগ্রামের কথা জানা যায়। সেখানে নহপানের যে অসংখ্য মুদ্রা পাওয়া গেছে তা থেকে দেখা যায় যে , তার দুই - তৃতীয়াংশই গৌতমীপুত্র কর্তৃক পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। এথেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে , নহপান গৌতমীপুত্রের নিকট পরাজিত হয়েছিলেন। গৌতমীপুত্রের এই সাফল্য সাতবাহনদের উচ্চাশাকে অতিক্রম করেছিল। এই জয়ের ফলেই গৌতমীপুত্র অলুপ , সুরাষ্ট্র , আকর , অবন্তী - ইত্যাদি স্থানগুলি লাভ করেন। এই জয়লাভের দ্বারাই উত্তর দাক্ষিনাত্য এবং পশ্চিম ও মধ্য ভারতের অংশবিশেষ বিদেশী শাসনমুক্ত হয়েছিল। এই   জয়লাভকে চিহ্নিত করার জন্য গৌতমীপুত্র নাসিকে একটি নগর নির্মাণ করেন এবং শকদের অনুকরণে '' রাজরাজ '' এবং '' মহারাজ '' উপাধি গ্রহণ করেন। 

( E ) পুলুময়ীর বিবাহ : রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক :- 
গৌতমীপুত্র তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সাফল্য লাভ অব্যাহত রেখেছিলেন - এরূপ মনে করার কোনও কারণ নেই। শক বংশের পতনের পর কর্দমাক শক গোষ্ঠী চষ্টনের নেতৃত্বে লুপ্ত ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসেন। তিনি সম্ভবতঃ উজ্জয়িনী তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত করতে পেরেছিলেন। চষ্টনের পর মহাক্ষত্রপ রুদ্রদামনের সাতবাহনদের বিরুদ্ধে শকদের সাফল্যের পরিচয় পাওয়া যায়। এই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে গৌতমীপুত্র তাঁর অন্যতম পুত্র বশিষ্ঠ পুত্র পুলুমায়ীর সঙ্গে রুদ্রদামনের কন্যার বিবাহ দেন। এই বিবাহ সাতকর্ণীর বাস্তব রাজনীতি জ্ঞানের পরিচায়ক। 

( F ) ধর্মীয় উদারতা :-
গৌতমীপুত্র ব্রাম্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধদের প্রতি উদার মনোভাব গ্রহণ করেন। নাসিক প্রভৃতি স্থানের অধিবাসীদের তিনি ভূমি ও গুহা দেন করেন। ডক্টর গোপালাচারী বলেছেন যে , তাঁর ধর্মীয় উদারতার নীতির ফলে গৌতমীপুত্র অপর ধর্মাবলম্বীদের সমর্থন লাভ করেছিলেন এবং তার সাম্রাজ্যকে সাফল্যের সাথে পরিচালনা করতে সহায়তা করেছিল। 

( G ) শাসন ব্যাবস্থায় দক্ষতার পরিচয় :-
ডক্টর গোপালাচারীর মতে , গৌতমীপুত্রের শাসনের ভিত্তি ছিল শাস্ত্রীয় বিধান ও মানবতাবোধ। তাঁর রাজস্ব ব্যবস্থায় এই বোধ প্রতিফলিত হয়েছিল। গৌতমীপুত্রের সরকারী দলিল ও ব্যাক্তিগত নথিপত্র থেকে তাঁর সময়কার শাসন ব্যবস্থার কথা জানতে পারা যায়। তিনি তাঁর পূর্বসূরীদের প্রচলিত শাসন ব্যবস্থাকেই মোটামুটি অক্ষুন্ন রাখেন।                 
শাসক সাতকর্ণী শাসন ব্যবস্থায় সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন এবং দৈবস্বত্ব অনুসারে রাজ্যশাসন করতেন। রাজা নিজেই সৈন্য পরিচালনা করতেন। শাসনকার্যের সুবিধার জন্য - '' মহার্তক '' , '' মহাআর্যক '' , ''ভান্ডারগারিক '' , '' মহামাত্র '' , '' নিবন্ধকার '' - প্রভৃতি উপাধিধারী কর্মচারী নিযুক্ত করেন। 

( H ) কর ব্যবস্থা ও ব্যবসা বাণিজ্য :- 
কর প্রথা দ্বারা রাজস্ব আদায় হত ; কিন্তু কর কখনোই উচ্চহারে ধার্য হত না। রাজার খাস সম্পত্তি ও জমির উপর কর , লবণের একচেটিয়া ব্যবসা এবং বিচারালয় প্রদত্ত অর্থ রাজস্বের উৎস ছিল। সাতকর্ণীর আমলে বৈদেশিক বাণিজ্য উন্নতি লাভ করে। এছাড়াও তাঁর আমলে ভারত ও পাশ্চাত্য দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। রাজধানী পৈথান ছিল বিশিষ্ট বাণিজ্য কেন্দ্র। 

( I ) সমাজ সংস্কার : ব্রাক্ষ্মণ্য শ্রেণীর প্রাধান্য স্থাপন :-
গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী যে শুধু সুযোদ্ধা-ই ছিলেন তাই নয় , সমাজ সংস্কারক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। তিনি সকল বর্ণের স্বার্থরক্ষা করতে যত্নবান ছিলেন। কিন্তু বর্ণ সংমিশ্রনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। নাসিক প্রশস্তি অনুসারে তিনি ক্ষত্রিয়দের দর্প চূর্ণ করে ব্রাক্ষ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব স্থাপন করেছিলেন। তিনি ছিলেন প্রজাকল্যাণমূলক শাসক। 


পরিশেষে বলা যায় ,  রাজনৈতিক দিক দিয়ে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর অবদান ছিল দু - ধরণের - একদিকে বৈদেশিক শক্তিকে প্রতিহত করে নিরাপত্তা বিধান ও অন্যদিকে বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তিকে প্রতিহত করে সাতবাহন রাজ্যের সম্প্রসারণ।   
শাসক ও বিজেতা হিসেবে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছিলেন। প্রথম সাতকর্ণীর মৃত্যুর পর শক আক্রমণের ফলে সাময়িকভাবে সাতবাহন বংশের গৌরব ম্লান হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী এই লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধার করেছিলেন। এটিকেই ঐতিহাসিকরা গৌতমীপুত্রের সর্বাধিক গৌরবময় কৃতিত্ব বলে দাবী করেছেন। 


You May Also Like

0 comments