চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য : Chandragupta Maurya.

by - June 26, 2021

মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্থান ও সাম্রাজ্য সুদৃঢ়করণে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ভূমিকা আলোচনা করো। 
অথবা , শাসক ও বিজেতা হিসেবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্বের মূল্যায়ন করো।


Discuss the rise of Maurya Empire under Chandragupta Maurya.



  
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সম্পর্কিত তথ্যাদির সূত্র :-
পুরাণ , কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র , বিশাখাদত্তের মুদ্রারাক্ষস , সোমদেবের কথাসরিৎসাগর , মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা ইত্যাদি থেকে এবং স্ট্রাবো , প্লুটার্ক , জাস্টিন - প্রমুখের রচনা থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সম্পর্কে জানা যায়। এছাড়াও হিন্দু কিংবদন্তী , বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থাদির সাক্ষ্য প্রমাণও যথেষ্ট সহায়ক। 


বংশপরিচয় :-
হিন্দু কিংবদন্তি অনুসারে চন্দ্রগুপ্তের মাতা ও নন্দরাজের উপপত্নী মুরার নামানুসারে এই বংশকে মৌর্য বংশ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে রচিত ''মুদ্রারাক্ষস '' নাটকে ও পরবর্তীকালে ক্ষেমেন্দ্র সংকলিত '' বৃহৎকথা '' গ্রন্থে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে নন্দ বংশোদ্ভূত বলা হয়েছে। অন্যদিকে বৌদ্ধগ্রন্থ '' দিব্যবদন '' এ তাঁকে ক্ষত্রিয় মোরিয় বংশোদ্ভূত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। জৈনগ্রন্থ '' পরিশিষ্ট পার্বন '' অনুসারে মোরিয় নামে এক শাক্য গোষ্ঠী হলো চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বংশ। 
উপরোক্ত তথ্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক ঐতিহাসিকগণ কিংবদন্তি , পুরাণ - প্রভৃতির তুলনায় বৌদ্ধ গ্রন্থাদির সাক্ষ্য প্রমানকে অধিকতর নির্ভরযোগ্য বিবেচনা করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে ক্ষত্রিয় কুলোদ্ভব বলে বর্ণনা করেছেন। 

সিংহাসনারোহন :-
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সিংহাসনারোহন সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে মতভেদ রয়েছে। যেমন Charpentier  খ্রিস্টপূর্ব ৩১৩ অব্দকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সিংহাসনারোহনকাল বলে উল্লেখ করেছেন। আবার , স্টেইন খ্রিস্টপূর্ব ৩১৮ অব্দকে , ফ্লিট খ্রিস্টপূর্ব ৩২০ অব্দকে , Smith  খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ অব্দকে এবং R.K. Mukherjee খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সিংহাসনারোহনকাল বলে বর্ণনা করেছেন। 


মগধের সিংহাসন অধিকার :-
উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে চাণক্য চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে পাটলিপুত্রে প্রেরণ করেন। সেই সময় পাটলিপুত্রে নন্দরাজ ধননন্দের অত্যাচারে জনসাধারণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। ঠিক এই সময় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মগধের সিংহাসনারোহনের বাসনা পোষণ করেন। তিনি নন্দ বংশের উচ্ছেদকল্পে গ্রীক সাহায্যলাভের আশায় আলেকজান্ডারের শিবিরে গমন করেন। কিন্তু তাঁর উদ্যত ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়ে আলেকজান্ডার তাঁর প্রাণদন্ডের আদেশ দেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সেখান থেকে পলায়ন করে বিন্ধ্য পর্বতের অরণ্যে চাণক্যের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এদিকে চাণক্যও নন্দরাজ কর্তৃক অপমানিত হয়ে প্রতিশোধের সুযোগ খুঁজছিলেন। সুতরাং দুজনের লক্ষ্য এক হওয়াতে চাণক্য চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে সর্বতোভাবে সহায়তা করতে থাকেন। 
'' মিলিন্দ পঞ্চহো '' নামক গ্রন্থে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের নন্দরাজের  বিরুদ্ধে অভিযানের বর্ণনা পাওয়া যায়। প্রথম দুবারের চেষ্টায় বিফল হয়ে তৃতীয়বার চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য পাটলিপুত্র অবরোধ করে নন্দরাজ ধননন্দকে সিংহাসনচ্যুত করেন। 

উত্তর - পশ্চিম ভারতে গ্রিকদের বিরুদ্ধে অভিযান -
এরপর তিনি উত্তর পশ্চিম ভারতে গ্রিক শাসন উচ্ছেদ করতে উদ্যোগী হন। আলেকজান্ডারের ভারত ত্যাগের পর গ্রিক শিবিরে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তাই তাঁর মৃত্যুর পর এই বিশৃঙ্খলা চরম আকার ধারণ করে। এই বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য উত্তর - পশ্চিম ভারতে গ্রিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩১৭ অব্দে গ্রিক সেনাপতি ইউডিমাস ভারত ত্যাগ করলে ভারতের উত্তর - পশ্চিম সীমান্তে গ্রিক শাসনের অবসান ঘটে। 
কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য প্রথমে নন্দরাজকে উচ্ছেদ করেছিলেন না গ্রিক শাসনের অবসান ঘটিয়েছিলেন সে বিষয়ে ঐতিহাসিক মহলে মতভেদ রয়েছে। 
একদিকে Smith এর মতে , 
It appears probable that before he undertook the extension of the foreign garrisons , he had already overthrown …………….. the Nanda king of Magadha .  
আবার ,
‘’ Chandragupta’s fight against the Macedonians , however , must have begun considerably earlier……………… Chandragupta’s next tusk was to rid the country of the internal tyranny of king Nanda . ‘’
[ The Age of Imperial Unity ] 

দাক্ষিণাত্য বিজয় -
দক্ষিণ ভারতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজ্যবিস্তার সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। অনেকের মতে , চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য দক্ষিণ ভারত বিজয় সম্পন্ন করেছিলেন ; আবার অনেকের মতে , বিন্দুসারের আমলেই দক্ষিণ ভারত মৌর্যগণ কর্তৃক বিজিত হয়েছিল। কিন্তু R.C. Roychoudhury  -র মতে , নন্দরাজগন কর্তৃক দক্ষিণ ভারত বিজিত হয়েছিল এবং স্বাভাবিকভাবেই নন্দবংশের অবসানের পর দাক্ষিণাত্য চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।    


সেলুকাসের সাথে যুদ্ধ ( খ্রিস্টপূর্ব ৩০৫ অব্দ ) -
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর সাম্রাজ্যের পূর্বাংশের অধিপতি সেলুকাস ভারতবর্ষে গ্রিক আধিপত্য পুনরায় প্রতিষ্ঠার জন্য খ্রিস্টপূর্ব ৩০৫ অব্দে সিন্ধু অঞ্চলে এসে উপস্থিত হলে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সাথে তাঁর যুদ্ধ বাঁধে। এই যুদ্ধের কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে স্ট্রাবো যে সন্ধির কথা বলেছেন তাতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যেরই জয়লাভের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সন্ধির শর্তানুসারে সেলুকাস চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে কাবুল , কান্দাহার , হিরাট , বেলুচিস্তান - ইত্যাদি প্রদেশ প্রদান করেন। এরপর সেলুকাস কর্তৃক মেগাস্থিনিস দূত হিসেবে চন্দ্রগুপ্তের মৌর্যের রাজসভায় প্রেরিত হন। 
এই সন্ধির গুরুত্ব প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন , দু - হাজার বছরের অধিক পূর্বে প্রথম ভারতীয় সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য গুরুত্বপূর্ণ সীমান্তের অধিকার লাভ করেন - এতটা সাফল্য পরবর্তীকালে মোগল সম্রাটেরা ও ইংরেজরা সমগ্রভাবে লাভ করতে পারেনি। 

সাম্রাজ্যের বিস্তার  -
Dr. R.K. Mukherjee - র মতে , চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন। 
(i) নন্দ বংশের উচ্ছেদসাধন করে সমগ্র মগধরাজ্য তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। 
(ii) গ্রিকদের বিতাড়িত করে তিনি সমগ্র পাঞ্জাব সহ উত্তর - পশ্চিম ভারত নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। 
(iii) সেলুকাসের কাছ থেকে তিনি কান্দাহার , কাবুল , হীরাট , বেলুচিস্তান লাভ করেছিলেন। 
(iv) জুনাগড় শিলালিপি অনুসারে পশ্চিম ভারতের সৌরাষ্ট্র পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল। 
(v) তামিল কবি মানুলনার রচিত গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে , দক্ষিণ ভারতে তিনেভেলি জেলা পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। 
(vi) মহীশুরে প্রাপ্ত শিলালিপি অনুসারে উত্তর মহীশূর তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল।
 

 -:চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্বের মূল্যায়ন :-


নন্দরাজকে ধ্বংস করে এবং গ্রীকদের বিতাড়িত করে তিনি ভারত থেকে বিদেশি শাসনের অবসান ঘটিয়ে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। দক্ষিণে মহীশূর , পূর্বে বঙ্গদেশ থেকে পশ্চিমে সৌরাষ্ট্র পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করে সর্বভারতীয় রাষ্ট্রীয় ঐক্যের পথ রচনা করেন। 
প্রজাকল্যাণমূলক ও কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে তিনি এই বিশাল সাম্রাজ্যের সংহতি রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মেগাস্থিনিস তাঁর শাসন দক্ষতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
Gokhle  মন্তব্য করেছেন - 
An unrivalled general , an able administrator , a unique personality , Chandragupta stands at the very head of the array of the great rulers of India .    

  

এই ওয়েবসাইটের সমস্ত প্রশ্নোত্তরের তালিকা / সূচীপত্রের জন্য এখানে CLICK করো।

    

You May Also Like

0 comments