বৈদিক যুগের সমাজ ব্যবস্থা : Features of Vedic Society

by - June 26, 2021

বৈদিক যুগের সমাজ জীবনের পরিচয় দাও। পরবর্তী বৈদিক যুগে সামাজিক ক্ষেত্রে কী কী পরিবর্তন সাধিত হয় ?

Give a pen - picture of the early Vedic society. What changes do you notice in the later Vedic period ?




সমগ্র আর্য সভ্যতাকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করলে - (১) ঋক বৈদিক আর্য ও (২) পরবর্তী বৈদিক যুগের আর্য - এই দুই শ্রেণীভাগ আমাদের চোখে পড়ে। ঋক বৈদিক যুগের আর্যদের সামাজিক ব্যবস্থা বৈদিক সমাজের মূল ভিত্তি হলেও পরবর্তী বৈদিক যুগে এই সমাজ ব্যবস্থার কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সামাজিক ব্যবস্থাকে বহাল রাখা হয়েছিল আবার কিছু অংশের পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। বৈদিক যুগ ও পরবর্তী বৈদিক যুগের সামাজিক কাঠামো আলোচনা করলেই আমরা জানতে পারবো ঋক বৈদিক যুগের সামাজিক ব্যবস্থা কেমন ছিল এবং পরবর্তী বৈদিক যুগে এর কী কী পরিবর্তন সাধিত হয়। 


ঋক বৈদিক যুগে আর্যদের সমাজ ব্যবস্থা :-


পিতৃ প্রধান পরিবার -
রাষ্ট্রের মতো বৈদিক সমাজের ভিত্তি ছিল পরিবার এবং তা ছিল পিতৃপ্রধান। পরিবারের প্রধান ছিলেন পিতা বা পুরুষ। তিনি গৃহপতি বা দম্পতি নামে পরিচিত ছিলেন। পরিবারভুক্ত সদস্যদের ওপর তার ক্ষমতা ছিল সীমাহীন। 

সমাজে নারীর স্থান -
বৈদিক সমাজে নারী সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারিণী ছিলেন। তাঁরা পুরুষের সহকর্মিনী ও সহধর্মিনী হতেন। নারীদের একাধিক পতি গ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল। গৃহস্থালীর ব্যাপারে নারীরা সর্বময়ী কর্তৃত্বের অধিকারিণী ছিলেন। অন্তঃপুরের বাইরেও তারা পুরুষদের সহায়তা করতেন। নারীদের মধ্যে অবরোধ প্রথা প্রচলিত ছিল না। তারা উপযুক্ত শিক্ষালাভ করতেন। ঋক বেদের যুগে বিশ্ববারা ,  ঘোষা , অপালা , মমতা , লোপামুদ্রা - প্রমুখ মহিলারা বিভিন্ন শাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন করেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ বহু বৈদিক স্তোত্রের রচয়িত্রী হিসেবেও প্রসিদ্ধা। সাহিত্য চর্চা ছাড়াও নারীদের যুদ্ধবিদ্যা , অসিচালনা প্রভৃতিও শিক্ষা দেওয়া হতো। বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল না। সতী প্রথাও প্রচলিত ছিল না। তবে নিঃসন্তান , বিধবা ভাতৃবধূকে বিবাহ করার রীতি প্রচলিত ছিল। নারীদের নৈতিক চরিত্রের মান উন্নত ছিল। 


প্রাথমিক পর্যায়ে শ্রেণীহীন সমাজ -
প্রথম দিকে বৈদিক আর্যরা তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল - যোদ্ধা বা অভিজাত শ্রেণী ; পুরোহিত শ্রেণী ও সাধারণ মানুষ। প্রাথমিক পর্যায়ে  বর্ণভেদ প্রচলিত ছিল না। কোনো বৃত্তি নিষিদ্ধ ছিলনা এবং এই তিনটি শ্রেণীর মধ্যে বিবাহও প্রচলিত ছিল। আহার - ইত্যাদির ব্যাপারেও কোনো নীতিগত বা ধর্মীয় বাধানিষেধ ছিলনা। এই তিনটি শ্রেণীকে নিয়েই আর্যদের প্রাথমিক সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। 
রোমিলা থাপার - এর ভাষায় - The three divisions merely facilitated social and economic organisation.’’  

বর্ণভেদের উদ্ভব -
কিন্তু আর্য ও অনার্যদের মধ্যে ক্রমাগত যুদ্ধ বিগ্রহ ও সংযোগের ফলে সমাজে শ্রেণিভেদের উদ্ভব হয়। আর্যরা নিজেদের গৌরবর্ণ ও দীর্ঘ আকৃতি বিষয়ে সর্বদাই সজাগ ছিল। অন্যদিকে অনার্যরা ছিল কৃষ্ণকায় ও খর্বাকৃতি। সুতরাং বর্ণের ভিত্তিতেই সর্বপ্রথম আর্য সমাজে শ্রেণিভেদের সূচনা হয়। ঋক বেদের দশম মন্ডলের পুরুষ সূত্রে বর্ণভেদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। 
যাই হোক এরপর কর্ম ও পেশার ভিত্তিতে সমগ্র আর্য সমাজকে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয় - (১) ব্রাহ্মণ - বিদ্যাচর্চা ও ধর্মকর্মের সাথে যুক্ত ব্যাক্তিরা ; (২) ক্ষত্রিয় - যুদ্ধকর্ম ও শাসন কার্যের সাথে যুক্ত ব্যাক্তিরা ; (৩) বৈশ্য - উৎপাদন , পশুপালন ও ব্যবসা - বাণিজ্যের সাথে যুক্ত ব্যাক্তিরা এবং (৪) শুদ্র - উপরোক্ত তিন শ্রেণীর সেবায় নিযুক্ত ব্যাক্তিরা। কিন্তু ঋক বেদের যুগে পেশাভিত্তিক শ্রেণীবিভাজনের সৃষ্টি হলেও এর পরিণত রূপ দেখা যায়নি। 


চতুরাশ্রম -
চতুরাশ্রম আর্য সমাজের এক অন্যতম বৈশিষ্ট। এই ব্যবস্থা সমাজের প্রথম তিন শ্রেণীর  মধ্যেই প্রচলিত ছিল। (১) জীবনের প্রথম পর্যায়কে বলা হতো ব্রম্মচর্যাশ্রম। এই সময় প্রত্যেককে গুরুগৃহে থেকে বিদ্যাচর্চা করতে হতো। (২) গুরুগৃহে শাস্ত্রচর্চা শেষ করে স্বগৃহে ফিরে '' গার্হস্থ্য আশ্রম '' বা গৃহীর জীবন পালন করতে হতো। এই আশ্রমের মূল কথা ছিল বিবাহ করে স্ত্রী ও সন্তান সহ সংসারধর্ম পালন করা। (৩) তৃতীয় পর্যায় ছিল বানপ্রস্থাশ্রম। প্রৌঢ় অবস্থায় সাংসারিক দায় দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে বনে কুটির বেঁধে নির্লিপ্ত জীবন যাপন করতে হতো। (৪) শেষ পর্যায় ছিল সন্ন্যাস বা যতি আশ্রম। এই সময় সন্ন্যাসীর মতো জীবন - যাপন করতে হতো। 

খাদ্য ও আনন্দ উৎসব -
দুধ , ঘি , ফলমূল , গম , যব - ইত্যাদি আর্যদের প্রধান খাদ্য ছিল। উৎসবের সময় মাংস ও পূজাঅর্চণার সময় সোমরস - নামক পানীয় প্রধান ছিল। মৃগয়া , মৎস শিকার , অশ্ব ও রথ চালনা , নৃত্যগীত - ইত্যাদি প্রধান আনন্দ উৎসব ছিল। ঋক বেদে বিবাহ , আহার ও বৃত্তি ক্ষেত্রে কোনো কঠোর বাধানিষেধ ছিলনা। 

পোশাক পরিচ্ছদ -
আর্য সমাজে পোশাক পরিচ্ছদ ও অলঙ্কারের ওপর বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হতো। তিন প্রকার আবরণের প্রচলন ছিল - (১) দেহের উপরাংশের জন্য উত্তরীয় ; (২) নিম্নাংশের জন্য ''নিবি''
; (৩) নিবির ওপর '' পরিধান '' .পোশাক পরিচ্ছদ  সূতি ও মূল্যবান পশুর চামড়া দ্বারা প্রস্তুত করা হতো।   
       
আর্য সমাজে দানের গুরুত্ব -
রোমিলা থাপার প্রাচীন ভারতের আর্থ - সামাজিক জীবনে দানের গুরুত্বের কথা লিখেছেন। ঋক বেদে '' দানস্তুতি '' থেকে জানা যায় যে , এই ব্যবস্থা বিনিময় প্রথার বিকল্প হয়ে উঠেছিল। ক্ষত্রিয়রা কর্তব্য পালনের জন্য ঈশ্বরের কৃপাপ্রার্থী হতেন এবং ব্রাম্মনদের দান করতেন। আর্যদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জীবনে দানের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তবে ঋক বেদের যুগে ভূমিদানের কথা সেরকমভাবে জানা যায় না। 

পরবর্তী বৈদিক যুগে সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন 


নারীর মর্যাদা হ্রাস - নারীর মর্যাদা পূর্বাপেক্ষা ক্ষীণ হয়ে পড়ে। সম্পত্তি ও রাজনৈতিক অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত হয়। অবশ্য শিক্ষার দরজা তাদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। এই যুগে নারীদের মধ্যে মৈত্রেয়ী ও গার্গীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

হিন্দুধর্মের উদ্ভব - গৃহ্যসূত্র ও ধর্মসূত্র অনুসারে সমাজের বিধিব্যবস্থা সুনির্দিষ্ট করা হয়। গৃহ্যসূত্রে হিন্দুদের পারিবারিক ও পার্থিব জীবনের অনুশাসন সম্পূর্ণরূপে বিবৃত আছে। গৃহ্যসূত্রকে কেন্দ্র করেই হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎপত্তি এই যুগেই হয়। 

দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনের উদ্ভব - যদিও যুগে যুগে ধর্মসূত্র রচিত হয়েছিল তথাপি একটি নির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে সমাজজীবন গঠন করার প্রবণতা ধর্মসুত্রে দেখা যায়। ক্রমে ক্রমে একটি সাধারণ দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন এবং সামাজিক রীতিনীতির বিকাশ ঘটে। 

বর্ণভেদের কঠোরতা - ঋক বৈদিক যুগে বর্ণভেদ কঠোর ছিল না। পরবর্তী বৈদিক যুগে বর্ণভেদ কঠোর হয়ে জন্মগত হয়। সমাজ চতুর্বর্ণের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ব্রাম্মন ও ক্ষত্রিয়দের বৃত্তি জন্মগত হলো। বৈশ্যদের বৃত্তি হলো কৃষি ও ব্যবসা বাণিজ্য। শুদ্রদের অবস্থা হলো অত্যন্ত হীন। ঐতরেয় ব্রাম্মণে শুদ্রদের '' যথাকাম বধ্য '' বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই চতুর্বর্ণের বাইরে যারা থাকলো তারা হলো অগণিত অ -বর্ণ বা পঞ্চমগন। এদের সামাজিক অধিকার কেড়ে নিয়ে অস্পৃশ্য বলা হলো। 

অনার্যদের আর্য জাতিতে পরিবর্তনের সুবিধা - একথা সত্য যে , চারটি বর্ণে সমাজ বিভক্ত হলেও অনার্যদের আর্যসমাজে গ্রহণ করার পথে কোনো বাধা ছিল না। সামবেদের অন্তর্গত 
'' ব্রাত্য - স্তোম - সূত্রে '' আর্য সমাজে অনার্যদের গ্রহণের সুনির্দিষ্ট বিধি আছে। 

ব্রাত্য ও নিষাদ - ওপর দুটি স্বতন্ত্র জাতি - চতুর্বর্ণ ব্যতীত ব্রাত্য ও নিষাদ নামে ওপর দুটি স্বতন্ত্র জাতির উল্লেখ পরবর্তী বৈদিক যুগে পাওয়া যায়। ব্রাত্যদের ভাষা ছিল প্রাকৃত এবং তারা যাযাবর জীবন যাত্রা করতো। নিষাদরা স্থায়ীভাবে বসবাস করতো। এরা শাসক গোষ্ঠীর কাছে '' স্থপতি '' নামে পরিচিত ছিল। 

শিক্ষায় পরিবর্তন - এই যুগে ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষা উভয়ই প্রচলিত ছিল। বেদ , উপনিষদ , ব্যাকরণ , ন্যায় ও আইন শিক্ষার প্রচলন ছিল। চিকিৎসা বিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যা এই যুগে যথেষ্ট উৎকর্ষতা লাভ করেছিল। 

পরিশেষে বলা যায় , আধুনিক ভারতীয় সভ্যতার জন্ম হয়েছিল বৈদিক সভ্যতার হাত ধরেই। প্রাথমিক বৈদিক যুগের সামাজিক বৈশিষ্ট গুলি পরবর্তী বৈদিক যুগে অনেকটা পরিবর্তিত হলেও আসলে এটি ছিল সামাজিক বিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া। এই দুই সময়কালের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল বর্ণভেদ। ঋক বৈদিক যুগে বর্ণভেদ কঠোর ও ব্যাপক না হলেও পরবর্তী বৈদিক যুগে তা ব্যাপক ও কঠোর হয়ে ওঠে যার প্রভাব হাজার বছর পেরিয়েও বিদ্যমান ছিল।   



You May Also Like

1 comments