ঋক বৈদিক যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা :- Economy of Vedic Age

by - June 26, 2021

বৈদিক আর্যদের অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করো। 
Compare broadly the economic condition of the Early Vedic Aryans with that of the later Vedic Age.




ঋক বৈদিক যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা :-


বৈদিক যুগের শুরুতে যাযাবর আর্যরা ভারতে এসে স্থিতিশীল হয়। প্রথমদিকে পশুচারণই ছিল তাদের প্রধান জীবিকা। প্রাচীন ভাষা বিজ্ঞানে '' গাভীস্তি'' শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। এর অর্থ হলো গাভীর সন্ধান ( to search for cows )। এরপর তারা স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করলে তাদের পেশার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। তারা ক্রমেই পশুচারণ থেকে কৃষিজীবীতে পরিণত হয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে , তৎকালীন কৃষি ব্যবস্থা ছিল উন্নত এবং তার প্রধান অঙ্গ ছিল গরু। কৃষির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা - বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটে। জমির মালিকদের মধ্যে থেকে বণিকশ্রেণীর উদ্ভব হয়। আবার পরবর্তী বৈদিক যুগে কৃষি অত্যন্ত আধুনিক পর্যায়ে উপনীত হয়। এই যুগের কৃষিতে লৌহের প্রচলন অধিক দেখা যায়। এই যুগে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের প্রসার ঘটে এবং শিল্পকূল বা গড়ে ওঠে। 


পরিবর্তনশীল অর্থনীতি : পশুচারণ থেকে কৃষিজীবী :-
বৈদিক যুগের শুরুতে গবাদি পশু দ্বারা উৎপাদিত সামগ্রী ছিল তখনকার জীবনধারণের প্রধান উপাদান। প্রাথমিক পর্যায়ে আর্যদের অর্থনৈতিক জীবনে গাভীর মূল্য এতই অধিক ছিল যে , এদের মধ্যে গাভী অপহরণের প্রবণতা ছিল প্রবল এবং একে কেন্দ্র করে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ লেগেই থাকতো। আর্যরা স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করলে তাদের পেশার পরিবর্তন ঘটে। তারা ক্রমেই পশুচারণ থেকে কৃষিজীবীতে পরিণত হয়। লৌহের ব্যবহার শুরু হলে তা চাষের পক্ষে সহায়ক হয়। ঋক বেদের যুগে আর্যসমাজ চারণভিত্তিক সমাজ (pastoral ) থেকে কৃষিভিত্তিক সমাজে পরিণত হয়। 


গ্রামীণ অর্থনীতির সূত্রপাত :-
ঋক বেদের যুগে আর্য সভ্যতা গ্রামীণ সভ্যতায় পরিণতি লাভ করে। এর ফলে আর্যদের অর্থনৈতিক জীবনে গ্রাম প্রধান অঙ্গরূপে স্থান গ্রহণ করে। সম্ভবত আর্যরা কৃষিজীবীতে পরিণত হলে তারা স্বনির্ভর গ্রামীণ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। স্থানীয় গ্রামীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আর্যদের দ্বারা প্রবর্তিত হলেও একথা অনস্বীকার্য যে , ভারতের অর্থনৈতিক জীবনে গ্রামের গুরুত্ব আজও অপরিবর্তিত রয়েছে। 

ব্যাক্তিগত মালিকানার উদ্ভব ; মিশ্র অর্থনীতি - কৃষিকাজ ও পশুপালন :-
উৎপাদনের উপকরণ ও সামাজিক ধনসম্পদের উপর যৌথ মালিকানা প্রচলিত থাকায় অনুমিত হয় যে , সমাজে আর্থিক বৈষম্যের সম্ভাবনা ছিল কম। কিন্তু ক্রমে জমি গ্রামের বিভিন্ন পরিবারের দখলে আসে এবং ব্যাক্তিগত মালিকানা ও জমি সংক্রান্ত বিরোধ ও উত্তরাধিকার সূত্রে জমি ভোগদখলের সমস্যার সূত্রপাত ঘটে। প্রত্যেক গৃহস্থ পরিবারের নিজস্ব কৃষিজমি ছিল। আবার গ্রামের সকলের পশুচারণের জন্য সাধারণ জমিও ছিল। সুতরাং দেখা যায় যে , সে যুগে কৃষি ও পশুচারণের উপর নির্ভরশীল মিশ্র অর্থনীতির উদ্ভব ঘটে। 
অনেকে মনে করেন যে , লৌহাস্ত্রের সাহায্যে জলকে পরিষ্কার করে কৃষির উপযোগী করে তোলা হতো। প্রকৃতপক্ষে কৃষিই ছিল মানুষের প্রধান অবলম্বন। ঋক বেদে লাঙল দিয়ে জমি চাষ , বীজ বপন , ফসল কাটা - ইত্যাদির উল্লেখ রয়েছে। 
Dr R.C. Roychoudhury - র মতে , শস্যের মধ্যে প্রধান ছিল ধান ও যব। কিন্তু ধানচাষ সম্পর্কে Dr R.C. Roychoudhury - র মতামত অনেকে সমর্থন করেন না। পশুপালন ছিল সেই যুগের মানুষের দ্বিতীয় প্রধান জীবিকা। যমুনা নদীর দুই তীরস্থ অঞ্চল গরুর জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। গোধন দ্বারা মানুষের সম্পদ নির্ধারিত হতো। এমনকি সৈনিকেরাও যুদ্ধের লুন্ঠিত দ্রব্য হিসেবে গো - সম্পদই কাম্য মনে করতো।  অর্থনীতি ও রাজনৈতিক জীবনে ঘোড়ার গুরুত্বও যথেষ্ট ছিল।   

 
অন্যান্য বৃত্তি ; মুদ্রা ; বণিক সম্প্রদায় ; লৌহের ব্যবহার ; যানবাহন :-
কৃষিভিত্তিক সমাজের প্রয়োজনে সূত্রধর , ধাতুশিল্পী , চর্মকার , তন্তুবায় ও কুম্ভকারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ধাতুর মধ্যে স্বর্ণ , তাম্র ও ব্রোঞ্জের ব্যবহার ছিল। মুদ্রা ভিত্তিক অর্থনীতি সেযুগে প্রচলিত না থাকলেও বৈদিক সাহিত্যে '' নিস্ক '' ও '' মানা '' নামক মুদ্রার উল্লেখ আছে। বৈদিক যুগে বণিক সম্প্রদায়েরও উল্লেখ পাওয়া যায়। এরা বিনিময় প্রথা ছাড়াও মুদ্রার মাধমেও ক্রয় - বিক্রয় করতো। বৈদিক আর্যদের নিকট লৌহের ব্যবহার অজ্ঞাত থাকলেও ঋক বেদে '' আয়াস '' নামক একপ্রকার ধাতুর উল্লেখ আছে যা পরবর্তীকালে লৌহ বলে পরিচিত হয়। ঋক বেদের যুগে পরিবহনের ক্ষেত্রে রথ , গো- শকট ও অন্তরীক্ষ বা আকাশ যানেরও উল্লেখ আছে। 

ব্যবসা - বাণিজ্য : অন্তর্দেশীয় ও সামুদ্রিক :-
কৃষির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যেরও সূত্রপাত ঘটে। গাঙ্গেয় উপত্যকার পূর্বাঞ্চলে কৃষির প্রসার ঘটলে গঙ্গানদী বাণিজ্যের সহায়ক হয়ে ওঠে। শক্তিশালী জমির মালিকরা ব্যবসা - বাণিজ্যের দিকে আকৃষ্ট হলে বণিক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। এছাড়াও অসিরিয়া , ব্যাবিলন ও এশিয়ার কয়েকটি দেশের সাথে আর্যদের সামুদ্রিক বাণিজ্য চলতো। তবে বাণিজ্যিক কার্যকলাপ উপকূলরেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ প্রসঙ্গে Cambridge History -র লেখক বলেছেন -  The Indus was the natural outlet to the sea for the Aryan tribes , but in the Rigeda there is no clear sign that they had yet reached the occean .

Basam - এর মতে নিয়মিত ব্যবসায়ী ও মহাজন বলতে যা বোঝায় ঋক বৈদিক যুগে তার অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তবে ঋণের উল্লেখ আছে। 
There is no evidence of a regular class of merchants or money lenders , though indebtedness is sometimes referred to . [ Basam ]  


পরবর্তী বৈদিক যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন :-


১. কৃষি ক্ষেত্রে পরিবর্তন - পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় এই যুগে চাষের উন্নতি হয় এবং ঋতু অনুযায়ী শস্য রোপনের জ্ঞান সুস্পষ্ট হয়। ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ গাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষির ব্যাপক প্রসার ঘটে। কেননা , গাঙ্গেয় উপত্যকার আদ্র জলবায়ু ও বৃষ্টিপাতের প্রাচুর্য স্বচ্ছল কৃষি অর্থনীতির বিকাশের পক্ষে সহায়ক ছিল। এই যুগে আর্যরা ধান ও অন্যান্য শস্যের উৎপাদন শুরু করে। জমিতে সেচ ও সার দেওয়ার কৌশলও আবিষ্কৃত হয়। এই যুগেও কৃষিই ছিল প্রধান জীবিকা। 

২. বাণিজ্য ক্ষেত্রে অগ্রগতি :- সিন্ধুবাসীর পর এই যুগের আর্যরা মেসোপটেমিয়া ও অন্যান্য পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির সাথে বাণিজ্য চালাতে শুরু করে। '' শতপথ ব্রাহ্মণ '' গ্রন্থে বাণিজ্য উপলক্ষ্যে সমুদ্র যাত্রার উল্লেখ পাওয়া যায়। 

৩. অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য সম্প্রসারণ - উত্তর , পূর্ব ভারতে রাজগীর , গয়া , বৈশালী ইত্যাদি অঞ্চল ধরে বাণিজ্যের পথ নেপালের তরাই পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পশ্চিমে বাণিজ্যপথ শ্রাবন্তী , মথুরা , ইন্দ্রপ্রস্থ ও তক্ষশীলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। দাক্ষিণাত্যের দিকে এই বাণিজ্যপথ পৈথান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।   

৪. শিল্পের উন্নতি - পরবর্তী বৈদিক যুগে শিল্পের ক্ষেত্রে বহুল উন্নতি সাধিত হয়। এই যুগে বৈশ্য শ্রেণীর মধ্যে Trade Guild গড়ে ওঠে। স্বর্ণকার , মণিকার , সূত্রধর , রঞ্জুক - ইত্যাদি বৃত্তিধর শিল্পীর উল্লেখ পাওয়া যায়। আলোচ্য সময়ে বস্তুগত অগ্রগতির প্রতীকরূপে '' চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র '' ( Painted Grey Ware Culture ) গুলির আগমন ঘটে। এর , মধ্যে কারিগরি দক্ষতা ও কৃৎকৌশলের প্রমান মেলে। 

৫. ধাতু ও মুদ্রার ব্যবহারে পরিবর্তন - ঋক বৈদিক যুগে স্বর্ণ , তাম্র ও ব্রোঞ্জের প্রচলন ছিল। পরবর্তী বৈদিক যুগে টিন , দস্তা , রৌপ্য ও লৌহের প্রচলন দেখা যায়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ অব্দের শেষের দিকে মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। এর ওপর পারসিক প্রভাব দেখা যায়। '' মানা '' নামক মুদ্রা ছিল সম্ভবত স্বর্ণমুদ্রা। 

উপসংহার :-
ঋক বৈদিক অর্থনীতি মোটেই উন্নত ছিল না। মুদ্রার অভাবে ব্যবসা - বাণিজ্যের চলাচল সহজ ছিল না এবং বিনিময় প্রথা ছিল একমাত্র পথ। গরুর বিনিময় ছিল সর্বাধিক। নিস্ক ও মানা নামক মুদ্রাগুলির ব্যবহার ছিল সীমিত। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল নিম্নমানের। কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগে ভারতীয় অর্থনৈতিক চিন্তাধারা এক বিশিষ্ট রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। প্রকৃতপক্ষে পরবর্তী বৈদিক যুগেই পরবর্তী ভারতের অর্থনৈতিক জীবনের সূচনা হয়।     
‘’ The end of this shadowy age , ……...the beginning of the great period of India’s culture . ……………’’       [Basam ]

      

You May Also Like

0 comments