শিক্ষা - মনোবিদ্যার সংজ্ঞা দাও। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি আলোচনা করো। Discuss the nature and scope of educational psychology

by - June 29, 2021

শিক্ষা - মনোবিদ্যার সংজ্ঞা দাও। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি আলোচনা করো। 






শিক্ষা - মনোবিদ্যার সংজ্ঞা :- 


মনোবিদ স্কিনার এর মতে , শিক্ষামনোবিজ্ঞান হলো মনোবিজ্ঞানের সেই শাখা যা শিক্ষণ এবং শিখন  নিয়ে কাজ করে। 

জাড বলেছেন , জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে দিয়ে যাওয়া শিশুদের মধ্যে যেসব পরিবর্তন সংঘটিত হয় , সেই সব বিষয়ে বিজ্ঞানের যে শাখা আলোচনা করে তা হল শিক্ষা মনোবিজ্ঞান। 

কোলেসনিক বলেছেন , মনোবিজ্ঞানের যেসব তত্ত্ব ও নীতি শিক্ষাপ্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে এবং উন্নত করতে সাহায্য করে , তাদের অনুশীলন হল শিক্ষামনোবিদ্যা। 

স্যান্ডিফোর্ড এর মতে , শিক্ষা মনোবিজ্ঞান হল ফলিত মনোবিজ্ঞানের একটি শাখা যা মনোবিজ্ঞানের নীতি গুলিকে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগ করে। 

জাড বলেছেন , ব্যক্তির জন্ম থেকে প্রাপ্তবয়স পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের বিকাশের বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা হল শিক্ষামনোবিজ্ঞান। 

বার্নাড এর মতে , শিক্ষামনোবিজ্ঞান হলো মনোবিজ্ঞানের একটি শাখা যা শিক্ষা ও শিখন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করে। 


শিক্ষামনোবিজ্ঞানের প্রকৃতি :- 


১. প্রয়োগমূলক বিজ্ঞান :- 
মনোবিজ্ঞানের তত্ত্ব , নীতি , সূত্র ইত্যাদি শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগ করে শিক্ষাব্যবস্থাকে কার্যকরী ও উন্নত করাই হল শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের কাজ , তাই শিক্ষামনোবিজ্ঞান একটি প্রয়োগমূলক বিজ্ঞান। শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান দানই নয় , তাত্ত্বিক জ্ঞানকে প্রয়োগ করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও উন্নত ও কার্যকরী করতে চায়  শিক্ষামনোবিজ্ঞান। 

২. স্বতন্ত্র বিষয় :- 
আগে শিক্ষামনোবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞানের একটি শাখা বলে বিবেচিত হত। বর্তমানে এটি একটি পৃথক বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। আসলে , কোনো জ্ঞান সমষ্টি অন্ততপক্ষে তিনটি শর্ত সাপেক্ষে নিজেকে পৃথক বিষয় হিসেবে দাবি করতে পারে। (ক ) বিষয়টির পরিধি হবে যথেষ্ট বিস্তৃত। (খ ) বিষয়টির নিজস্ব সমস্যা থাকবে।  (গ ) বিষয়টির নিজস্ব পদ্ধতি থাকবে যার সাহায্যে তার সমস্যা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা গবেষণা করে সমাধানের পথ নির্দিষ্ট করে বিষয়টিকে আরও উন্নত করা সম্ভব হবে।  শিক্ষামনোবিজ্ঞান এই তিনটি শর্তই পূরণ করতে সক্ষম। 


৩. গতিশীল বিষয় :- 
শিক্ষামনোবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়বস্তুগুলি স্থির নয় , গতিশীল। শিক্ষামনোবিজ্ঞানের ওপর প্রতিনিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার ফলে একদিকে যেমন নতুন তথ্য তত্ত্ব , নীতি , সূত্র আবিষ্কৃত হচ্ছে এবং তার প্রয়োগ ঘটছে ; অন্যদিকে তেমনই পুরনো তত্ত্ব ও নীতিসূত্র ও চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটছে যার ফলে শিক্ষামনোবিজ্ঞান আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। 

৪. ব্যক্তি ও সমাজের পক্ষে কল্যাণকর :- 
শিক্ষামনোবিজ্ঞান সর্বদাই ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণের প্রতি দৃষ্টি দেয়। এজন্য এটি একটি আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান। শিক্ষামনোবিজ্ঞান ব্যক্তির সম্ভাবনাগুলির বিকাশের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে ব্যক্তির কল্যাণ সাধন করে। ফলে পরোক্ষভাবে সমাজের মঙ্গল সাধিত হয়। কারণ সমৃদ্ধ ও পূর্ণ মানুষই দেশ ও সমাজের সম্পদ। দেশ ও সমাজের সামগ্রিক বিকাশে এদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষামনোবিজ্ঞান ব্যক্তির আচরণ সংশোধন করে ব্যক্তির ও সমাজের মঙ্গল সাধন করে। 

৫. ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের ওপর গুরুত্ব আরোপকারী :- শিক্ষামনোবিজ্ঞান ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়।  ব্যক্তিগত পার্থক্যের নীতিকে স্বীকার করে শিক্ষামনোবিজ্ঞান তার বিষয়গুলিকে বিশ্লেষণ করে। 


শিক্ষামনোবিজ্ঞানের পরিধি :- 

১. সহজাত মানসিক সামর্থ্য :- 
ব্যক্তি সহজাতভাবে কিছু মানসিক সামর্থ্য নিয়ে জন্মায়। যেমন -  বুদ্ধি , প্রক্ষোভ , স্মৃতি , কল্পনা , চিন্তন  ইত্যাদি। শিক্ষার ক্ষেত্রে এই সামর্থ্যগুলি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এগুলি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান অর্জন ছাড়া কীভাবে এদের নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নতকরণ করা যায় এবং শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর সার্থক প্রয়োগ করা যায় তা জানা সম্ভব নয়। তাই শিক্ষামনোবিজ্ঞানে এই সহজাত সামর্থ্যগুলি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা থাকে। 

২. জীবন বিকাশের ধারা :- 
শিশুর জন্মগতসূত্রে প্রাপ্ত সামর্থ্যগুলি পুষ্টি , অনুশীলন এবং পরিবেশের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বিকাশ লাভ করে। এই বিকাশের যেমন একটি ধারা আছে তেমনি আছে অনুকূল পরিবেশ রচনার  ধারাও। শিক্ষামনোবিজ্ঞান শিশুর দৈহিক , মানসিক , প্রাক্ষোভিক বিকাশের ধারাগুলি আলোচনা করে এবং শিশুর যথাযথ বিকাশের জন্য যে পরিবেশের প্রয়োজন তার রূপরেখাও শিক্ষা মনোবিজ্ঞানে আলোচিত হয়। 

৩. ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য :- 
ব্যক্তিগত পার্থক্য একটি স্বাভাবিক ঘটনা। ব্যক্তিগত পার্থক্যের কারণ কী , কীভাবে এই পার্থক্যকে ভিত্তি করে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি ,যেমন পাঠক্রম , শিক্ষাদান পদ্ধতি , মূল্যায়ন প্রভৃতির বিচার বিবেচনা করা যায় তার আলোচনা শিক্ষামনোবিজ্ঞানের পরিধির অন্তর্ভুক্ত। 

৪. শিখন তত্ত্ব :- 
শিখন তত্ত্ব এবং তার প্রয়োগ শিক্ষামনোবিদ্যার অন্যতম আলোচ্য বিষয়। গতানুগতিক শিখনের পদ্ধতি হিসাবে উদ্দীপক প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তে আধুনিক অপেক্ষাকৃত জটিল আচরণমূলক ও জ্ঞানমূলক তত্ত্ব শ্রেণিশিক্ষনে অধিকতর কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে। জ্ঞানমূলক তত্ত্বে শিখনকে নির্মাণভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যা শিক্ষা শিখন প্রক্রিয়ার মধ্যে আমূল পরিবর্তন এনেছে। 

৫. শিক্ষণের ভিত্তি :- 
শিখনের ভিত্তিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায় - জ্ঞানমূলক এবং অনুভূতিমূলক। বুদ্ধি , স্মৃতি এবং মনোযোগ জ্ঞানমূলক ভিত্তির অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে প্রেরণা , মনোভাব এবং আগ্রহ অনুভূতিমূলক ভিত্তির অন্তর্ভুক্ত। অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা স্মৃতিতে সঞ্চিত হয় , প্রয়োজনবোধে যা আমরা স্মরণ করে প্রয়োগ করি। সঞ্চিত অভিজ্ঞতার সঙ্গে নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়সাধন করাই হল শিখন। তাই , শিক্ষককে জানতে হবে কীভাবে পাঠলব্ধ বিষয় স্মৃতিতে সঞ্চিত হয় এবং কীভাবে সঞ্চয়ের বিলোপ ঘটলে পূর্বপঠিত বিষয়কে আমরা ভুলে যাই। স্মৃতি ছাড়া অন্যান্য জ্ঞানমূলক উপাদান , যেমন বুদ্ধি ও মনোযোগ এবং প্রেরণা , মনোভাব ও আগ্রহ প্রভৃতি শিখনের অনুভূতিমূলক উপাদানগুলি সম্পর্কে বিশদ তথ্য না জানলে উন্নত পাঠদানে শিক্ষকের ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। 

৬. শিক্ষা প্রযুক্তি :- 
শিক্ষা প্রযুক্তি কাকে বলে , কী ধরনের প্রযুক্তি শিক্ষাক্ষেত্রে কার্যকরী , কীভাবে শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রয়োগ করা যায় - এসবই বর্তমানে শিক্ষামনোবিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। 


৭. শ্রেণি ব্যবস্থাপনা :- 
সম্প্রতি শ্রেণি ব্যবস্থাপনা শিক্ষামনোবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। শিক্ষা - শিখন প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকরী করে তুলতে শ্রেণিকক্ষে উদ্ভব ঘটা বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে শ্রেণি ব্যবস্থাপনার কৌশল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

৮. পরীক্ষা ও মূল্যায়ণ :- 
শিক্ষা প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর হল পরীক্ষা ও মূল্যায়ণ। শিক্ষাকার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থী কতটুকু শিখল , প্রত্যাশিত মানে পৌঁছাতে সক্ষম হলো কি'না , না হলে কোথায় তার অসুবিধা , সেই অসুবিধা দূর করতে কী ধরনের সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করা যায় প্রভৃতি শিক্ষামনোবিদ্যার আলোচ্য বিষয়। 

৯. প্রতিভা সম্পন্ন ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থী : - 
প্রতিভাসম্পন্ন ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের কীভাবে নির্দিষ্ট করা যায় , তাদের মনস্তত্ত্ব , কোন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা তাদের জন্য উপযুক্ত , কেমন করে তাদের শেখানো যাবে প্রভৃতি বিষয়ে চিন্তাভাবনা গণতান্ত্রিক এবং কল্যাণকর রাষ্ট্রের পক্ষে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এটি শিক্ষামনোবিজ্ঞানে বিশদভাবে আলোচিত হয়। 

১০. পরিসংখ্যান :- 
বিজ্ঞানের সমস্ত ক্ষেত্রে রাশিবিজ্ঞানের প্রয়োগ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বস্তুত রাশি বিজ্ঞানের জ্ঞান ছাড়া শিক্ষার্থীদের অগ্রগতির সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়। তাই একজন শিক্ষকের পক্ষে পরিসংখ্যানের প্রয়োজনীয় জ্ঞান অপরিহার্য। 

১১. মানসিক স্বাস্থ্য :- 
মানসিক সুস্বাস্থ্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের পক্ষে প্রয়োজন। মানসিক স্বাস্থ্য কী , সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্যের লক্ষণ গুলি কী কী , কীভাবে সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া যায় , অপসংগতি কী , এর কারণ কী , অপসংগতি প্রতিরোধে কী ধরনের কর্মসূচি বিদ্যালয় নেওয়া যেতে পারে - এসব শিক্ষামনোবিদ্যার আলোচ্য বিষয়। 

১২. অভিযোজন প্রক্রিয়া :- 
সার্থক অভিযোজনই হল শিক্ষার লক্ষ্য। অভিযোজন কাকে বলে , কীভাবে অভিযোজন করা যায় , অভিযোজনের অনুকুল ও প্রতিকুল পরিবেশে কী  , শিক্ষাক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা এবং প্রতিকূল পরিবেশকে প্রতিরোধ করাও শিক্ষামনোবিদ্যার আলোচ্য বিষয়। 

১৩. শিক্ষা নির্দেশনা :- 
শিক্ষা নির্দেশনা কাকে বলে , শিক্ষানির্দেশনার আলোচ্য বিষয় , কীভাবে শিক্ষার্থী সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা যায় , কীভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা পরিকল্পনা রচনা হয় - ইত্যাদি এবং সেক্ষেত্রে শিক্ষকের করণীয় কী কী , সে সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য শিক্ষা ও বৃত্তি নির্দেশনার অন্তর্ভুক্ত। 

 

You May Also Like

0 comments