সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কাকে বলে ? সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমগুলি সম্পর্কে আলোচনা কর।

by - November 09, 2022

সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কাকে বলে ? সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমগুলি সম্পর্কে আলোচনা কর। 

সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম।  




সামাজিক নিয়ন্ত্রণের সংজ্ঞা / ধারণা। 


সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হল এমন এক সামাজিক পদ্ধতি যার দ্বারা সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তিবর্গের আচার আচরণ নিয়ন্ত্রন করা যায়। সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ফলেই সমাজে শান্তি - শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সুব্যবস্থিতভাবে সমাজ পরিচালিত হয়। 

ম্যাকাইভার ও পেজ বলেছেন - সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হল এক বিশেষ পদ্ধতি যার দ্বারা সমাজব্যবস্থা সুসংহত ও সংরক্ষিত থাকে , পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখে এবং সামগ্রিকভাবে সমাজে সুব্যবস্থিত করে তোলে।    

সমাজতাত্ত্বিক বটোমোর বলেছেন - সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হল বিশেষ কিছু সামাজিক রীতিনীতি , মূল্যবোধ , আইন ও আদর্শের সমষ্টি , যার মাধ্যমে সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তিবর্গের জীবন ও সমাজ বাঞ্ছিত ও নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত হয়। 

সমাজতাত্ত্বিক রস বলেছেন - সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হল কিছু বিধি - ব্যবস্থার সমষ্টি - যার মাধ্যমে একটি আদর্শ মানের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়।  

সুতরাং , সামাজিক নিয়ন্ত্রন হল - একটি উপায় বা ব্যবস্থা যার দ্বারা সমাজের আদর্শ ও মূল্যবোধ রক্ষিত হয় , সমাজ পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে এবং সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করে আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করে। 


সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমসমূহ :- 


১. লোকাচার ও লোকনীতি :- 
সমাজে কতকগুলি স্থায়ী অভ্যাস বা চর্চার অস্তিত্ব থাকে যেগুলি বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে পালন করা হয় - এগুলিকে লোকাচার বলে। তবে , লোকাচারগুলি সর্বদা পালনের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা থাকেনা। আবার যেসকল লোকাচার সমাজে প্রতিষ্ঠিত থাকে তাকে লোকনীতি বলে। লোকনীতিগুলি জনসমাজ পালন করতে বাধ্য থাকে। লোকাচার ও লোকনীতিগুলি সমাজের আদর্শ ও মূল্যবোধ রক্ষা করে , সামাজিক শান্তি - শৃঙ্খলা রক্ষা করে ও সমাজকে সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করতে সাহায্য করে। 

২. শিক্ষা :- 
শিক্ষা মানুষের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাগুলোকে জাগরিত করে মানুষকে আলোর পথে পথ চলতে সাহায্য করে। শিক্ষা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। শিক্ষা মানুষের মধ্যে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে ও সংগঠিত হতে সাহায্য করে। এককথায় শিক্ষা মানুষকে পরিপূর্ণ সামাজিক প্রাণী হিসাবে গড়ে তোলে। এইভাবে শিক্ষা জনসমাজকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। 

৩. সাংবিধানিক বিধি - ব্যবস্থা :- 
প্রতিটি সমাজেই রাষ্ট্র কর্তৃক সংবিধান প্রচলিত থাকে। সাংবিধানিক আইনগুলিকে জন সমাজ মেনে চলতে বাধ্য থাকে। এই আইনগুলি অমান্য করলে শাস্তি পেতে হয়। যেহেতু এই আইনগুলিকে অধিকাংশ নাগরিক মান্য করে চলেন - তাই সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সমাজেই ব্যক্তিবর্গ সংবিধান কর্তৃক সরাসরি নিয়ন্ত্রিত হন। 

৪. প্রথাগত আইন :- 
পৃথিবীতে আজও এমন কিছু সমাজ আছে যেখানে সভ্যতার আলো পৌঁছোয়নি। এইসকল সমাজগুলি তাদের প্রথাগত আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। সমাজের শান্তি শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করলে গোষ্ঠী বা গোষ্ঠী পরিষদ দ্বারা শাস্তি পেতে হয়। যেসকল স্থানে আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি সেই সকল সমাজে প্রথাগত আইনগুলি সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 


৫. ধর্মীয় রীতিনীতি :- 
প্রতিটি মানুষের সঙ্গে ধর্ম বিশেষভাবে জড়িত থাকে। সাধারণতঃ মানুষ নিজ ধর্মবিশ্বাসের প্রতি গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীল থাকেন। তাই ধর্মীয় রীতিনীতিগুলি সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সকল ধর্মীয় রীতিনীতির বিরুদ্ধে যেতে মানুষ ভয় পায় এবং এগুলির প্রতি গভীরভাবে আস্থাশীল থাকে। বেশিরভাগ মানুষ ধর্মীয় রীতিনীতির মধ্যেই নিজ জীবন পরিচালিত করে। এইভাবে ধর্মীয় রীতিনীতি সমাজকে নিয়ন্ত্রন করে।  

৬. সামাজিক রীতিনীতি  :-
প্রতিটি সমাজে রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত আইন - বিধি ছাড়াও কিছু সামাজিক রীতিনীতির অস্তিত্ব থাকে। এই ধরণের রীতিনীতিগুলি তুলনামূলকভাবে নমনীয় হয়ে থাকে। এইসকল সামাজিক রীতিনীতিগুলি সমাজকে সুগঠিত করে ও মূল্যবোধ রক্ষা করে। যেমন সন্তানের প্রতি পিতামাতার কর্তব্য , বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য - ইত্যাদি। 

৭. সাংগঠনিক রীতিনীতি :- 
প্রতিটি সমাজে বহুসংখ্যক সামাজিক সংগঠনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। প্রতিটি সামাজিক সংগঠনের নিজস্ব কিছু রীতিনীতি ও নিয়মবিধি থাকে। সংগঠনের সদস্যগণ এইসকল নিয়মবিধি পালনে বাধ্য থাকেন। এইভাবে সামাজিক সংগঠনগুলি তাদের সদস্যদের সামাজিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। 

৮. গণমাধ্যম :- 
বৃহত্তর ও স্থানীয় সমাজের সমস্তরকম খবরাখবর গণমাধ্যমগুলির দ্বারা প্রচারিত হয়। ফলে মানুষ প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি , গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা , সরকারি সিদ্ধান্ত ও বিভিন্ন নীতি , জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি , কোনো বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জনসাধারণের মনোভাব - ইত্যাদি বিষয়ে অবহিত হতে পারেন এবং সামাজিক অভিযোজনের সঙ্গে নিজের সামঞ্জস্যবিধান করতে পারেন। এইভাবে গণমাধ্যম সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

পরিশেষে বলা যায় , সমাজের পরিবর্তন ও সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমগুলিরও পরিবর্তন ঘটে। আবার সকল সমাজে সবগুলি মাধ্যম সমানভাবে কার্যকর হয়না। ভিন্ন ভিন্ন সমাজে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমগুলি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তবে সকল ক্ষেত্রেই সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমগুলি সামাজিক শৃঙ্খলা স্থাপন করে সমাজকে সুসংহত পথে পরিচালিত করতে সহায়তা করে। 

  

You May Also Like

0 comments