আলাউদ্দিন খলজির শাসনতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারগুলি আলোচনা কর।

by - July 03, 2022

আলাউদ্দিন খলজির শাসনতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারগুলি আলোচনা কর। 

আলাউদ্দিন খলজির রাজস্ব সংস্কার। 

আলাউদ্দিন খলজির প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার। 



আলাউদ্দিন খলজি ( ১২৯৬ - ১৩১৬ খ্রিস্টাব্দ ) :- 


প্রথম জীবন ও সিংহাসনলাভ :- 
আলাউদ্দিন খলজি ছিলেন সুলতান জালালউদ্দিন খলজির ভাতুষ্পুত্র। আলাউদ্দিন ছিলেন অক্ষরজ্ঞানহীন। জালালউদ্দিন তাঁকে '' আমির - ই - তুজুক '' পদে নিযুক্ত করেন। ১২৯২ খ্রিস্টাব্দে তিনি মালব রাজ্য আক্রমণ করেন এবং রাজধানী ভিলসা লুন্ঠন করে প্রচুর ধনরত্ন লাভ করেন। এতে খুশি হয়ে জালালউদ্দিন তাঁকে কারা , মানিকপুর ও অযোধ্যার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। ভিলসা থেকে লুন্ঠিত সম্পদের দ্বারা আলাউদ্দিন গোপনে সেনাদল গঠন করতে থাকেন। এরপর আলাউদ্দিন দেবগিরির সম্পদে আকৃষ্ট হয়ে দেবগিরি আক্রমণ করেন। এই সংবাদে খুশি হয়ে জালালউদ্দিন কারায় এসে উপস্থিত হলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁকে হত্যা করে আলাউদ্দিন নিজেকে দিল্লির সুলতান বলে ঘোষণা করেন। 


আলাউদ্দিনের প্রাথমিক সমস্যা :- 
১. স্নেহান্ধ পিতৃব্য জালালউদ্দিনকে হত্যা করার জন্য তিনি সকলের ঘৃণার পাত্র হয়ে ওঠেন। 
২. জালালউদ্দিনের অনুচর ও অনুগতরা আলাউদ্দিনের বিরোধিতা করতে থাকে। 
৩. জালালউদ্দিনের পুত্র রুকনুদ্দিন ইব্রাহিম সিংহাসনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন। 
৪. মোঙ্গল আক্রমণ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। 
৫. দুর্বল শাসন ব্যবস্থা সুলতানি সাম্রাজ্যের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছিল। 
৬. আকাত খাঁ , উমর খাঁ , মঙ্গু খাঁ , হাজি মৌলা - প্রমুখের বিদ্রোহ আলাউদ্দিনের সিংহাসনকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। 

[ A ] আলাউদ্দিন খলজির প্রশাসনিক ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কার :- 


১. অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনে গৃহীত পদক্ষেপ :- 
গুপ্তচর নিয়োগ :- সাম্রাজ্যের সকল সংবাদ জানার জন্য আলাউদ্দিন প্রচুর সংখ্যক গুপ্তচর নিয়োগ করেন। অতি তুচ্ছ ঘটনাও সুলতানকে অবগত করতে হত। সকল রাজকর্মচারী , আমীর ওমরাহ - সকলের গতিবিধি গুপ্তচরদের নখদর্পনে থাকতো। 

অভিজাতবর্গের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা :- অভিজাতদের জায়গির বাজেয়াপ্ত করে এবং উচ্চহারে রাজস্ব বৃদ্ধি করে তিনি অভিজাত সম্প্রদায়ের বিশেষ ক্ষতিসাধন করেন। পূর্ববর্তী সকল উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বরখাস্ত করেন। সুলতানের অনুমতি ছাড়া অভিজাতদের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন , উৎসব ও সামাজিক অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করা হয়। এই সকল বিধিগুলির প্রয়োগে আলাউদ্দিন অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। 

জায়গির প্রথা ও ভাতা বিলোপ :- রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত জায়গির , পুরস্কার , দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ভূসম্পত্তি - ইত্যাদি বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বা খলিসা- য় পরিণত করা হয়। বিনা খাজনায় জমি ভোগ করার প্রথা প্রায় বিলুপ্ত হয়। 

মদ্যপান নিষিদ্ধকরণ :- রাজত্বের সর্বত্র মদ্যপান ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়। সুলতানের ব্যক্তিগত সুরাপাত্রগুলি সর্বসমক্ষে ভেঙে ফেলা হয়। তবে এর ফলে চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম বাড়তে থাকলে শুধুমাত্র গৃহে মদ্য প্রস্তুতির অনুমতি দেওয়া হয়।   


২. নরপতিত্বের আদর্শ স্থাপন :- 
আলাউদ্দিন খলজি সুলতানি শাসনে সুলতানকে সর্বোচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠা করেন। সুলতান ছিলেন একাধারে প্রধান সেনাপতি , প্রধান বিচারক , প্রধান প্রশাসক। সুলতান আলাউদ্দিন খলজি সীমাহীন স্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি এক নতুন নরপতিত্বের আদর্শ স্থাপন করেন। তাঁর মতে , সুলতান ও প্রজাদের মধ্যেকার সম্পর্ক হল প্রভু - ভৃত্যের অনুরূপ। 
এই উদ্দেশ্যে তিনি প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা দলের প্রভাব খর্ব করতে সর্বদা তৎপর ছিলেন। অভিজাত ও উলেমাদের তিনি আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করেন। তিনি কখনই খলিফার সমর্থন লাভ করার চেষ্টা করেননি। এইভাবে তিনি খলিফার ঐতিহ্যগত সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে সুলতানিকে প্রকৃত সার্বভৌম রূপ প্রদান করেন। 

৩. শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রীয়করণ :- 
আলাউদ্দিন একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করে সাম্রাজ্যের সর্বত্র বিশৃঙ্খলা দমন করেন ও শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত শাসন - ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তিনি শাসনকার্যে সহায়তার জন্য বহু মন্ত্রী নিয়োগ করলেও মূল ক্ষমতা সুলতানের হাতেই কেন্দ্রীভূত থাকে। মন্ত্রীদের সঙ্গে তিনি পরামর্শ করতেন কিন্তু তাঁদের পরামর্শ গ্রহণে বাধ্য ছিলেন না। গুপ্তচর নিয়োগ করে সাম্রাজ্যের সর্বত্র তিনি আধিপত্য বিস্তার করেন। মন্ত্রীদের একমাত্র কর্তব্য ছিল সুলতানের আদেশ পালন করা - এর বাইরে তাঁদের আর কোনো ক্ষমতা ছিল না। 

৪. সামরিক ব্যবস্থার সংস্কার :- 
আলাউদ্দিনের সাফল্য নির্ভরশীল ছিল তাঁর সামরিক শক্তির উপর। সামরিক ব্যবস্থায় সংস্কার সাধনের জন্য তিনি বহুবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন - 
(i) দিল্লি সুলতানির শাসকদের মধ্যে আলাউদ্দিন সর্বপ্রথম একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী গঠন করেন। 
(ii) জায়গিরের পরিবর্তে নগদে বেতন প্রদানের রীতি প্রবর্তন করেন। 
(iii) সৈন্যদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র , পোশাক , অশ্ব - সবকিছুই রাষ্ট্র কর্তৃক সরবরাহের নীতি গৃহীত হয়। 
(iv) প্রায় পাঁচ লক্ষ অশ্বারোহী নিয়ে এক বিরাট সেনাদল গঠন করা হয়। 
(v) সেনাবাহিনীতে দুর্নীতি দমনের জন্য তিনি দাঘ ও হুলিয়া ব্যবস্থা চালু করেন। 


[ B ] আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কার :- 


১. রাজস্ব নীতি :- 
তিনি সকল প্রকার ' মিলক ' বা রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত মালিকানার অধিকার , ' ইনাম ' বা উপঢৌকন , ' ইদ্রারত ' বা ভাতা , ওয়াকফ বা ধর্মীয় অনুদান - ইত্যাদি সকল জমি বাতিল করে ' খালিসা ' বা রাষ্ট্রের খাস জমিতে পরিণত করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও অভিজাতদের ক্ষমতানাস। এছাড়াও তিনি গ্রামীণ অভিজাতদের দমন করে তাদের রাজস্ব প্রদানে বাধ্য করেন। ' আমিল ' নামক সরকারি কর্মচারী সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করত। ফলে মধ্যস্বত্বভোগীদের বিলোপ ঘটলো। ' খুঁৎ ' , মুকাদ্দাম , চৌধুরী - প্রমুখ রাজস্ব আদায়কারীদের কঠোর হাতে দমন করেন এবং রাজস্ব প্রদানে বাধ্য করেন। 

২. ইকতা ব্যবস্থায় সংস্কার :- 
আলাউদ্দিন ইকতা ব্যবস্থায় কিছু সংস্কারসাধন করেন। ইকতাদারদের দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য তিনি ইকতাদারদের হিসাব পরীক্ষার উদ্দেশ্যে কর্মচারী নিয়োগ করেন এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ইকতাদারদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এইভাবে ইকতাদারদের প্রদেয় রাজস্ব সরাসরি রাজকোষে জমা পড়ার ফলে রাজকোষের বিপুল উন্নতিবিধান করে। 

৩. ভূমিরাজস্ব বৃদ্ধি :- 
সুলতানি শাসকদের মধ্যে আলাউদ্দিন সর্বোচ্চ ভূমিরাজস্ব নির্ধারণ করেন। ভূমিরাজস্বের পরিমাণ তিনি ৫০ % বাড়িয়ে দেন। সাম্রাজ্য বিস্তার ও মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন ছিল - মনে করা হয় এই বিপুল ভূমিরাজস্ব বৃদ্ধি তারই একটি পদক্ষেপ। 

৪. অন্যান্য বিভিন্ন কর প্রচলন :- 
ভূমিরাজস্ব বৃদ্ধি করা ছাড়াও আলাউদ্দিন অন্যান্য বহু ক্ষেত্রে নতুন কর ধার্য করেন। যেমন - গৃহকর বা ঘরি , পশুচারণ কর বা চরাই , গৃহপালিত পশুদের উপর কর , জলকর , সেচ কর , হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর , মুসলিমদের উপর খরাজ , খামস - ইত্যাদি কর ধার্য করা হয়। 

৫. জমি জরিপ ব্যবস্থার প্রবর্তন :- 
তিনি প্রত্যেক আবাদী ও অনাবাদী জমি জরিপ করে তাতে উৎপাদিত ফসলের ভিত্তিতে রাজস্ব নির্ধারণের নীতি গ্রহণ করেন। অনেক ক্ষেত্রে নগদের পরিবর্তে শস্যের মাধমেও রাজস্ব সংগ্রহ করা হত। এত ব্যাপক পরিমাণে জমি জরিপের কর্মসূচী ইতিপূর্বে গৃহীত হয়নি। 

৬. রাজস্ব বিভাগ স্থাপন :- 
রাজস্ব আদায়কে সুনিশ্চিত করতে আলাউদ্দিন খলজি একটি পৃথক রাজস্ব বিভাগ গঠন করেন। এই বিভাগের নাম ছিল - ' দেওয়ান - ই - মুস্তকরাজ ' । এছাড়াও রাজস্ব বিভাগের জন্য তিনি মুহাশিল , আমিল , গোমস্তা , কারনুন , পাটোয়ারী - ইত্যাদি বহু কর্মচারী নিযুক্ত করেন। 

৭. বাজারদর নিয়ন্ত্রণ :- 
আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কারের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণ। বিভিন্ন প্রকারের খাদ্যশস্য , সূতি ও রেশমবস্ত্র , গবাদি পশু ,  সমস্ত প্রকার খাদ্যদ্রব্য - ইত্যাদি মূল্য বেঁধে দেওয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে ' সেরা - ই - আদল ' , ' দেওয়ান - ই - মন্ডি ' - নামক বাজার গড়ে তোলা হয়। খাদ্যসংকটের সময় ক্রীতদাস সহ সকলকে আধ মন খাদ্যশস্য দেওয়ার রীতি প্রবর্তিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এইভাবে আলাউদ্দিন রেশনিং ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। লাইসেন্স বা অনুমতিপত্র ছাড়া সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করা নিষিদ্ধ হয়। বাজারদর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকর করতে ' দেওয়ান - ই - রিয়াসাত ' ও ' সাহনা - ই - মন্ডি ' নামক দুই রাজকর্মচারী নিযুক্ত হন। 

পরিশেষে বলা যায় , আলাউদ্দিনের সাফল্যের মুলে ছিল তাঁর দৃঢ় মানসিকতা , শাসনকার্যে ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধান , শাসনতান্ত্রিক প্রতিভা ও কঠোরতা , কর্মচারীদের আনুগত্য ও নিষ্ঠা - ইত্যাদি। কিন্তু আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর প্রবর্তিত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। কেননা , আলাউদ্দিন কর্তৃক প্রবর্তিত শাসনতান্ত্রিক ও রাজস্ব ব্যবস্থা নির্ভরশীল ছিল সম্পূর্ণভাবে সুলতানের ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও দক্ষতার উপর।    

 

You May Also Like

0 comments