দারিদ্রতার সংজ্ঞা দাও। গ্রামীণ সমাজে দারিদ্রতার প্রভাব আলোচনা কর।

by - May 03, 2022

দারিদ্রতার সংজ্ঞা দাও। গ্রামীণ সমাজে দারিদ্রতার প্রভাব আলোচনা কর।  

দারিদ্রতা কীভাবে গ্রামীণ জনসমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করে ? 

Define poverty. Discuss the impact of poverty in rural society. ( In Bengali ) .  



দারিদ্রতার সংজ্ঞা :- 


দারিদ্রতা হল একটি অবস্থা। যখন কোনো ব্যক্তি নিজের এবং নিজের উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিবর্গের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলি পূরণ করতে ব্যর্থ হয় - তখন সেই ব্যক্তির সেই অবস্থাকে দারিদ্রতা বলা হয়। 

বা , বলা যেতে পারে , ব্যক্তির যা পাওয়ার দরকার আছে ও যা আছে - তার মধ্যে পার্থক্য তৈরী হলে সেই অবস্থাকে দারিদ্রতা বলা হয়। 

দারিদ্রতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে সমাজতত্ববিদ গোডার্ড বলেছেন , দারিদ্রতা হল ব্যক্তির সেই অবস্থা - যার ফলে ব্যক্তি নিজের ও নিজের উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয় অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে। 

দারিদ্রতা বিষয়টি আপেক্ষিক। অর্থাৎ এটি কোনো নির্দিষ্ট সমাজের ব্যক্তিবর্গের জীবনযাত্রার উপর নির্ভরশীল। কেননা , সকল সমাজে জীবন যাত্রার মান একই ধরণের হয়না। ধরা যাক A নামক ব্যক্তি B নামক ব্যক্তির তুলনায় বেশি রোজগার করেন। সেক্ষেত্রে B ব্যক্তি A ব্যক্তির তুলনায় দরিদ্র। আবার C ব্যক্তি B ব্যক্তির তুলনায় কম রোজগার করেন। সেক্ষেত্রে C ব্যক্তি B ব্যক্তির তুলনায় দরিদ্র। 

তবে সাধারণভাবে , দারিদ্রতা বলতে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের যোগানের অক্ষমতাকেই বোঝানো হয়। এই অবস্থা ব্যক্তির জীবনে প্রতিকূল প্রভাব বিস্তার করে এবং জীবনধারণের ন্যূনতম মান বজায় রাখতে অক্ষম করে তোলে। 


গ্রামীণ সমাজে দারিদ্রতার প্রভাব :- 


১. নিরক্ষরতা বৃদ্ধি :- 
গ্রামীণ দারিদ্রতার প্রভাবে গ্রামীণ সমাজে নিরক্ষরতা বৃদ্ধি পায়। চরম দারিদ্রতা ব্যক্তিকে শিক্ষা গ্রহণের তুলনায় অর্থ উপার্জন করা যায় - এমন বৃত্তিমূলক কর্মে নিজেকে নিযুক্ত করতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ফলে শিক্ষার প্রসারের জন্য বহুবিধ কর্মসূচি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এইভাবে দারিদ্রতা গ্রামীণ নিরক্ষরতা বৃদ্ধি করে। 

২. শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি :- 
দারিদ্রতার কারণে বহু শিশু পর্যাপ্ত শিক্ষা গ্রহণ না করে শিশু শ্রমিকে পরিণত হয়। অনেক ক্ষেত্রেই শিশুদের অভিভাবকগণ চরম দারিদ্রতার তাড়নায় শিশুদেরকে শ্রমে নিযুক্ত করতে বাধ্য হন। এই সকল শিশু শ্রমিকেরা সারা ভারতে ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঝুঁকিপূর্ণ কর্মে নিযুক্ত হয়। 

৩. বেকারত্ব বৃদ্ধি :- 
অতিরিক্ত দারিদ্রতা পক্ষান্তরে বেকারত্বের জন্ম দেয়। অতিরিক্ত দারিদ্রতার ফলে মানুষ উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনা , বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারেনা এমনকী ন্যূনতম মূলধন প্রয়োগ করে আর্থিক আয়ের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনা। ফলে খুব সহজেই মানুষ বেকারত্বের শিকার হয়ে পড়ে। 

৪. নারীপাচারের সংখ্যা বৃদ্ধি :- 
সমাজে দারিদ্রতা বৃদ্ধির ফলে ভারত , বাংলাদেশ , নেপাল , ভুটান - এইসকল উন্নয়নশীল দেশ থেকে নারী পাচারের সংখ্যা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রামীণ এলাকায় চরম দারিদ্রতা অসহায় নারীদের খুব সহজেই অন্ধকার জগতে প্রবেশ করতে অনুপ্রাণিত করে। 

৫. গ্রামীণ অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি :- 
চরম দারিদ্রতার শিকার হওয়ার ফলে গ্রামীণ ক্ষেত্রে মানুষের অপরাধ প্রবণতা ও অসামাজিক কার্যকলাপের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। গ্রামীণ ক্ষেত্রে যেহেতু কর্মসংস্থানের সুযোগ কম , তাই দারিদ্রতার শিকার হয়ে মানুষ অপরাধের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনকে একমাত্র পথ বলে মনে করে। এইভাবে দারিদ্রতা গ্রামীণ অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। 


৬. উন্নয়ন ব্যাহত :- 
গ্রামীণ এলাকার অধিক সংখ্যক মানুষের দারিদ্রতার কারণে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মসূচি ব্যাহত হয়। বহুসংখ্যক মানুষের দারিদ্রতার কারণে কর বাবদ সরকারের আয় কম হয় এবং অন্যদিকে দরিদ্র জনসাধারণের জন্য সরকারকে বিভিন্ন ধরণের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। ফলে জাতীয় আয়ের একটি বিরাট অংশ ব্যয় হয়ে যায়। এইভাবে যথেষ্ট উন্নয়নমূলক কর্মসূচির পরিবর্তে দরিদ্র মানুষের ন্যুনতম চাহিদা পূরণ করাটাই অন্যতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। 

৭. পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি :- 
গ্রামীণ দারিদ্রতার কারণে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। গ্রামীণ এলাকায় যথেষ্ট কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় গ্রামীণ বেকার জনসাধারণ শহরে বা ভিন্ন রাজ্যে শ্রমিক হিসাবে নিজেকে নিযুক্ত করেন। বহু সংখ্যক মানুষ গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার ফলে গ্রামীণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য ব্যাহত হয়। 

৮. স্বাস্থ্য সমস্যা বৃদ্ধি :- 
গ্রামীণ এলাকায় মানুষের সার্বিক দারিদ্রতার কারণে স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হয়। অর্থের অভাবে মানুষ স্বাস্থ্য পরিষেবা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। অনেক সময় সরকারি গ্রামীণ হাসপাতালগুলিতে সমস্ত রকমের রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থার বন্দোবস্ত থাকেনা। এই অবস্থায় বহু মানুষকে বিনা চিকিৎসায় জীবন অতিবাহিত করতে হয়। 

৯. নৈতিকতার অবনমন :- 
গ্রামীণ এলাকায় দারিদ্রতার ফলে মানুষের মধ্যে নৈতিক অবনমন ঘটে। প্রবল দারিদ্রতার যাতাকলে পিষ্ট হয়ে মানুষ নৈতিকতা ভুলে গিয়ে ঠিক - ভুল সমস্ত রকম পথ অবলম্বন করে অর্থ উপার্জনের জন্য। এইভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে নৈতিকতার অবনমন জাতীয় ঐক্য ও সুরক্ষার বিষয়টিকে প্রশ্নের সম্মুখে ঠেলে দিয়েছে। 

১০. ন্যূনতম জীবন যাত্রার মান বজায় রাখতে না পারা :- 
চরম দারিদ্রের কবলে পড়ে গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ জীবন যাত্রার ন্যূনতম মান বজায় রাখতে অক্ষম হয়। খাদ্যের অভাব , পরিধানের অভাব , স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাব , শিক্ষার অভাব , ঋণগ্রস্থতা - ইত্যাদি বিভিন্ন নেতিবাচক বিষয়গুলি গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে। 

পরিশেষে বলা যায় , দারিদ্রতার প্রভাব শহর ও গ্রামীণ জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব ফেলে। গ্রামীণ জীবনযাত্রায় দারিদ্রতা মানুষের সার্বিক বিকাশ ব্যাহত করে। যেহেতু গ্র্রামীন জনসংখ্যা প্রায় সম্পূর্ণভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল থাকে ; ফলে কর্মসংস্থানের বিকল্প সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা খুব কম থাকে। ফলে গ্রামীণ দারিদ্রতা মোচনের বিষয়টি তুলনামূলক জটিল হয়ে পড়ে। গ্রামীণ দারিদ্রতা একসঙ্গে অনেকগুলি সামাজিক সমস্যার জন্ম দেয়। 


You May Also Like

0 comments