নীলদর্পণ নাটকের অপ্রধান চরিত্রগুলি আলোচনা কর।

by - May 30, 2022

নীলদর্পণ নাটকের অপ্রধান চরিত্রগুলি আলোচনা কর। 

দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকের অপ্রধান চরিত্রগুলির পরিচয় দাও। 




নীলদর্পণ নাটকের অপ্রধান চরিত্রের বর্ণনা :- 


দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকটি বাংলা সাহিত্য ও সংগ্রামশীলতার ইতিহাসে একটি অমর সৃষ্টি। যেকোনো ধরণের নাটকের ক্ষেত্রে প্রধান চরিত্রগুলি পূর্ণতা লাভ করে অপ্রধান চরিত্রগুলির যথাযথ উপস্থাপনের মাধ্যমে। নাটকের ঘটনাক্রম , ঘটনার উপস্থাপন , চরিত্রের বিশিষ্টতা নির্মাণ , ক্লাইম্যাক্স - ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে অপ্রধান চরিত্রগুলি অপরিহার্য হয়ে পরে। দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পন নাটকে অপ্রধান চরিত্রগুলি নাটকের ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রসঙ্গতঃ বলা যায় , দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকে চরিত্রের বহুলতা লক্ষ্য করা যায়। নীচে নীলদর্পণ নাটকের অপ্রধান চরিত্রগুলির বর্ণনা ও নিশিষ্টতা উল্লেখ করা হল। 


গোলক বসু :- 
স্বরপুর গ্রামের বসু পরিবারের কর্তা হলেন গোলক বসু। তাঁর চরিত্রটি অত্যন্ত সহজ , সরল , ধর্মনিষ্ঠ ও প্রীতিপরায়ণ হিসাবে উপস্থিত করেছেন নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র। বর্তমানে তিনি সাংসারিক দায় - দায়িত্ব থেকে অবসর নিয়েছেন এবং সকল দায়িত্ব বর্তেছে পুত্র নবীনমাধবের উপর। গোলক বসু পুত্র নবীনমাধবের জন্য গর্বিত এক পিতা। নিজের গ্রামের প্রতিটি ধূলিকণার প্রতি অগাধ ভালোবাসা থাকলেও তাঁর চরিত্রের মধ্যে সংগ্রামী মানসিকতার অভাব চোখে পড়ে। এই ক্ষেত্রে তিনি একজন দুর্বলচিত্ত মানুষ। মিথ্যা মামলায় আদালতে নিয়ে যাওয়া হলে তিনি যেকোনো উপায়ে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন এবং নীলকর সাহেবের প্রতি আনুগত্যের প্রতিজ্ঞা করেন। গোলক বসু চরিত্রটির মাধ্যমে নাট্যকার উপস্থাপন করেছেন সেই সকল মানুষদের যেসকল মানুষেরা জীবনপ্রেমী হলেও অত্যাচারীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। 

বিন্দুমাধব :- 
নাটকে বিন্দুমাধব চরিত্রটি ম্রিয়মান। পুরো নাটকে তার ভূমিকা নগন্য। তাই চরিত্রটি তেমন উজ্জ্বল নয়। কোনো দৃশ্যেই তাঁর কোনো সক্রিয় ভূমিকা নেই। পিতার মৃত্যুর পর তাঁর সংলাপগুলি অনেক বেশি কৃত্রিম বলে মনে হয়। তবে তাঁর চরিত্রের মধ্যে পিতার প্রতি অগাধ ভক্তি , দাদাকে পিতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা , মায়ের প্রতি নিদারুন স্নেহ , স্ত্রী সরলতার প্রতি ভালোবাসা - প্রকাশ পেয়েছে। বিন্দুমাধব ধীর , স্থির ও সংযত ; তবে কর্মে তৎপর। পিতার বন্দীত্বের সংবাদ পেয়েও বিন্দুমাধব বিচলিত হয়নি এবং ধীর , স্থিরভাবে পিতাকে মুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। বিন্দুমাধবের চরিত্রের মধ্যে দিয়ে বুদ্ধিমত্তা ও হৃদয়বৃত্তির এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে। 


সাবিত্রী :- 
নীলদর্পণ নাটকে সাবিত্রী চরিত্রটি বিশেষভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি জমিদার গৃহিনী। স্বামীর প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা , পুত্রের প্রতি গভীর স্নেহ , পুত্রবধূদের প্রতি উদার স্নেহ - সাবিত্রীর চরিত্রকে মহিমান্বিত করেছে। জমিদার গৃহিনী হলেও সকল বিষয়ে তাঁর সজাগ দৃষ্টি। এছাড়াও , পরিবারের বাইরেও প্রতিবেশীদের প্রতিও তাঁর ভালোবাসা পরায়ণতা লক্ষ্য করা যায় এবং খবর - ঘটনা - ইত্যাদির প্রতিও তাঁর আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। ঈশ্বরের প্রতি তাঁর রয়েছে অগাধ বিশ্বাস। সাবিত্রী চরিত্রটির মধ্যে দিয়ে নাট্যকার ট্রাজিক আবেদন উপস্থাপন করেছেন। 

সৈরিন্ধ্রি :- 
সৈরিন্ধ্রি হলেন নবীনমাধবের স্ত্রী ও বসু পরিবারের বড়বৌ। শ্বশুর , শাশুড়ি , স্বামী - সকলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ; দেবর ও জা - এর প্রতি অপত্য স্নেহ , দাসদাসী , প্রতিবেশী - সকলের প্রতি তাঁর সহৃদয় আচরণ - ইত্যাদির ফলে তাঁর চরিত্রটি বিশিষ্টতা লাভ করেছে। তবে সৈরিন্ধ্রির জীবন যন্ত্রনা ও বেদনায় ভরা। যেমন শিশুকালে পিতৃহীন হয়েছে সে ; আবার শ্বশুর বাড়িতে এসে যখন পিতৃগৃহের কষ্ট যখন সবে কিছুটা লাঘব হয়েছে - তখনি নীলকর সাহেবদের করাল গ্রাস বিপর্যস্ত করে দিয়েছে তার পরিবারকে। সবকিছু পেয়েও সবকিছু হারানোর বেদনা সৈরিন্ধ্রি চরিত্রটির মধ্যে দিয়ে স্পর্শকাতরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন নাট্যকার। 

সরলতা :- 
সরলতা বসু পরিবারের ছোটবৌ তথা বিন্দুমাধবের স্ত্রী। নামের সঙ্গে তাঁর চরিত্রের বিশেষ মিল পাওয়া যায়। সারল্যই তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট। আপন চারিত্রিক মাধুর্য্যে , সেবা ও কর্তব্য পালনের মধ্যে দিয়ে সে সবার স্নেহের পাত্রী হয়ে উঠেছে। তাঁর সারল্যের জন্য শাশুড়ি আদর করে তাকে পাগলী বলে সম্মোধন করেন। সে কিছুটা লেখাপড়া জানে এবং অবকাশ সময়ে সে শাশুড়িকে গল্পের বই পাঠ করে শোনায় ও বড় জা - কে বেতাল পাঠ করে শোনায়। সরলতা প্রাণ শক্তিতে উচ্ছল। কিন্তু শ্বশুর জেলে যাওয়ায় সে ভেঙে পড়ে। আবার সাবিত্রী যখন শোকে উন্মাদ হয় তখন সরলতার সেবা তার চরিত্রটিকে মহিমান্বিত করে তোলে।

গোপীনাথ :- 
গোপীনাথ দাস নীলকরের দেওয়ান। দুস্কর্মের সমস্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আজ সে নীলকরদের তোষামোদকারীতে পরিণত হয়েছে। নীলকরদের অত্যাচারকে তাদের সহযোগীদের চোখ দিয়ে দেখানো হয়েছে চরিত্রটির মাধ্যমে। আবার নীলকররা তাদের নিজেদের অনুগত কর্মচারীদের প্রতিও যে অমানুষিক অত্যাচার চালাতো - তা ফুটে উঠেছে গোপীনাথ চরিত্রটির মাধ্যমে ; গোপীনাথের প্রতি উড সাহেবের ব্যবহার তার প্রমান দেয়। অত্যাচারী নীলকরদের আরো বেশি করে অত্যাচারী হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে গোপীনাথ। তবে তা স্বত্তেও তার সমস্ত সততার মৃত্যু ঘটেনি। সাহেবদের অত্যাচারের মাত্রা যখন সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গেছে তখন গোপীনাথের মধ্যে আক্ষেপ দেখা যায়। যেমন , গোলক বসুর মৃত্যুতে গোপীনাথের যথেষ্ট আক্ষেপ ছিল। 


সাধুচরণ :- 
ঘোষ পরিবারের কর্তা সাধুচরণ ঘোষ এক সাধারণ রায়ত। নাটকের সূচনাতে দেখা যায় সাধুচরণ একজন বিজ্ঞ ও দূরদর্শী মানুষ। তাঁর সংলাপের মধ্যে ফুটে উঠেছে বর্তমানের যথাযথ বিশ্লেষণ অন্যদিকে নীলকরদের ভবিষ্যত সম্পর্কেও তাঁর মতামত উল্লেখযোগ্য। সাধুচরণ শিক্ষিত বলে সাধারণ কৃষকদের মত সে অল্পেই ভেঙে পড়েনা। তবে সে স্পষ্টবক্তা হলেও প্রতিবাদী চরিত্র নয়। চরিত্রটি পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে সচেতন এবং আত্মকেন্দ্রিক নয়। 

তোরাপ :- 
তোরাপ একজন সাধারণ চাষী। নবীনমাধবের দ্বারা উপকৃত হওয়ায় সে তাঁর প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। বলিষ্ট , সাহসী ও ধর্ম বুদ্ধি পরায়ণ চরিত্রের অধিকারী করে নাট্যকার তাঁকে নাটকে উপস্থিত করেছেন। সে নবীনমাধবের পিতা গোলক বসুর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী দিতে অস্বীকার করে - এখানেই তাঁর সাহসিকতা ও ধর্ম বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। সত্যের পথ কঠিন - তা সে জানে ; কিন্তু সে সত্যের পথ থেকে সরে আসতে চায় না। নবীনমাধবের মতই সে নীলকরদের প্রাণে না মেরে তাদের বিবেক বুদ্ধি জাগ্রত করতে চায় - এইখানেই চরিত্রটির বিশিষ্টতা। 

আদুরী :- 
বসু পরিবারের বিধবা পরিচারিকা আদুরী। কিন্তু মনিব পরিবারের কারো সাথেই তার প্রভু - ভৃত্যের সম্পর্ক নেই। আদুরীর আন্তরিকতায় সকল বয়সের মানুষের সঙ্গে তার আত্মার আত্মীয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরিহাস প্রিয়তা তার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট। বসু পরিবারের চরম দুর্দশার দিনে সে ভেঙে পড়েছে ; তাদের কথা ভেবে ব্যাকুল হয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায় মনিব পরিবারের সদস্যদের সে কতটা আপন করে নিয়েছিল। 

রেবতী :- 
রেবতী হল সাধুচরণের স্ত্রী। সে একজন অশিক্ষিত গ্রাম্য রমণী। তবে নাটকে রেবতী চরিত্রটি মাতৃত্বের অসীম মহিমা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কন্যা ক্ষেত্রমণি এমনকি দেবর রাইচরণের প্রতিও তাঁর আচরণে মাতৃত্বের সকল রূপগুলি ফুটে উঠেছে। সে কর্তব্যপরায়ণা , স্নেহশীলা ও বাস্তববোধসম্পন্না। পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট ধারণা রয়েছে। নাট্যকার রেবতী চরিত্রের মধ্যে দিয়ে এক গ্রাম্য রমণীর স্নেহশীলতা তুলে ধরেছেন। 

ক্ষেত্রমণি :- 
সাধুচরণ ও রেবতীর কন্যা ক্ষেত্রমণি। সে সহজ সরল। তাঁর আত্মার আত্মীয় হল বসু পরিবারের ছোটবৌ সমবয়সী সরলতা। নারীর সতীত্ব রক্ষায় ক্ষেত্রমণির সংগ্রাম চোখে পড়ার মত। নবীনমাধব ক্ষেত্রমণিকে কামুক সাহেবের হাত থেকে উদ্ধার করলেও ক্ষেত্রমণি পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। গর্ভে থাকা সন্তানের প্রতি তাঁর আবেগ নাট্যকার নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। 

উডসাহেব ও রোগসাহেব :- 
দুজনেই নীলকর সাহেব - অত্যাচারী ও মানবতাহীন। দুজনেই শিক্ষিত এবং ইংরেজি ও ভাঙা বাংলায় কথা বলেন। সম্ভবতঃ অত্যাচারী লারমুর সাহেবের অনুকরণে নাট্যকার উডসাহেবের চরিত্রটি নির্মাণ করছিলেন। অর্থের প্রতি অসীম লোভের কারণে তারা অত্যাচারী হয়ে উঠেছেন। অত্যাচার , লুন্ঠন , মিথ্যা মামলা সাজানো , নিজ স্বার্থে প্রশাসনকে ব্যবহার করা - সকল নেতিবাচক বৈশিষ্টের সমন্বয় ঘটেছে চরিত্র দুটির মধ্যে।   


You May Also Like

0 comments