রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রকৃতিভাবনা আলোচনা কর।

by - May 29, 2022

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রকৃতিভাবনা আলোচনা কর। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কীভাবে প্রকৃতি , মানুষ ও শিক্ষার সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন - আলোচনা কর। 




রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রকৃতিভাবনা। 


কবি , সাহিত্যিক এবং দার্শনিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহু সৃষ্টির মধ্যে প্রকৃতির প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়। নিজ আত্মজীবনী '' জীবনস্মৃতি '' তে তিনি লিখেছিলেন - '' আমার শিশুকালেই বিশ্ব প্রকৃতির সাথে আমার খুব একটা সহজ ও নিবিড় যোগ ছিল। '' প্রকৃতির সাথে তাঁর এই সান্নিধ্য তাঁর জীবনের দার্শনিক উপলব্ধিগুলির মধ্যেও ধরা দেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃতি , মানুষ ও শিক্ষাকে পরস্পর অভিন্ন বলে মনে করতেন। তাঁর দার্শনিক উপলব্ধির অন্যতম বৈশিষ্ট হল প্রকৃতি , মানুষ ও শিক্ষার মেলবন্ধন। 


কবির দর্শনে প্রকৃতির প্রধান উপাদান হিসেবে অরণ্য :- 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর '' অরণ্য দেবতা '' প্রবন্ধে লিখেছেন - '' অনেক মানুষ অরণ্যকে ধ্বংস করে নিজেরাই ক্ষতি ডেকে এনেছে। বায়ুকে নির্মল করার ভার যে গাছের উপর , যার পত্র ঝরে গিয়ে ভূমিতে উর্বরতা দেয় , তাকেই সে নির্মূল করেছে। বিধাতার যা কিছু কল্যাণের দান , আপনার কল্যাণ বিস্মৃত হয়ে মানুষ তাকেই ধ্বংস করছে। '' তাঁর এই উক্তির মাধ্যমেই প্রকৃতির প্রতি তাঁর গভীর আকর্ষণ প্রমাণিত হয়। তিনি প্রকৃতিকেই মানব কল্যাণের সর্বোৎকৃষ্ট উপাদান ও ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে মনে করেন। সেই প্রকৃতির প্রধান উপাদান অরণ্যকে মানুষ যদি দিনের পর দিন ধ্বংস করতে থাকে ,তাহলে মানব সভ্যতারও পতন সুনিশ্চিত - বলে তিনি মনে করেন। 

প্রকৃতি ও শিক্ষার মেলবন্ধন :- 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন , '' তথাপি খোলা আকাশ , খোলা বাতাস এবং গাছপালা মানব সন্তানের শরীর - মনের সুপরিণতর জন্য যে অত্যন্ত দরকার একথা বোধহয় কেজো লোকেরাও একেবারে উড়াইয়া দিতে পারিবেন না। বালকদের হৃদয় যখন নবীন আছে , কৌতূহল যখন সজীব এবং সমুদয় ইন্দ্রিয় শক্তি যখন সতেজ , তখনি তাহাদিগকে মেঘ ও রৌদ্রের লীলাভূমি অবারিত আকাশের তলে খেলা করিতে দাও - তাহাদিগকে এই ভূমার আলিঙ্গন হইতে বঞ্চিত রাখিয়ো না। সুতরাং তিনি চেয়েছিলেন প্রকৃতির মাঝেই প্রতিটি শিশুর শিক্ষা হোক। নবীন ও সজীব প্রকৃতি শিশুমনকে প্রকৃতির রহস্যগুলি জানতে ও সেগুলির উদঘাটন করতে কৌতূহলী করে তুলবে। এই শিক্ষা শিশুর জীবনকে সার্থক করে তুলবে বলে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। 


প্রকৃতির কোলে গ্রাম উন্নয়ন :- 
পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে জমিদারির দায়িত্ব পেয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গ্রাম বাংলার অপরূপ নির্মল প্রকৃতির প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করেন। তিনি উপলব্ধি করেন ভারতের গ্রামগুলি যতটা প্রকৃতির কাছাকাছি আছে , শহরগুলি সেইরূপ নয়। আবার গ্রামের উন্নতি ছাড়া জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। তাই তিনি গ্রামীণ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন - শিলাইদহে '' মহর্ষি দাতব্য চিকিৎসালয় '' স্থাপন করেন , পতিসরে হাসপাতাল স্থাপন করেন , বিভিন্ন কুটির শিল্পের উন্নতির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। 

প্রকৃতি ও কৃষি :- 
কৃষি ও প্রকৃতি পরস্পর সমার্থক। আবার গ্রামীণ জীবন ও কৃষি পরস্পর সমার্থক। তাই গ্রামীণ এলাকায় কৃষির বিকাশের জন্য তিনি বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি শিলাইদহে ৮০ বিঘা জমিতে আধুনিক কৃষি খামার গড়ে তোলেন। প্রাকৃতিকভাবে জৈব সার ব্যবহার করে তিনি সেই এলাকায় কৃষি বিপ্লব সংগঠিত করেন। তিনি মনে করতেন , কৃষি হল প্রকৃতির অপর এক আশীর্বাদ। তাই প্রতিটি শিশুর কৃষি সম্পর্কিত জ্ঞান থাকা আবশ্যিক বলে তিনি মনে করতেন। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার অর্থনৈতিক জীবনের মেরুদন্ড হল কৃষি। তাই কৃষিকে মানব কল্যাণের স্বার্থে ব্যবহার করতে কৃষির ক্ষেত্রে বিশেষ যত্নবান হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করতেন। 

শান্তিনিকেতনে প্রকৃতিপাঠ :- 
শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে শান্তিনিকেতনে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তপোবনকেন্দ্রিক শিক্ষাধারা প্রতিষ্ঠা , শিল্প শিক্ষার জন্য কলাভবন নির্মাণ , ব্যবহারিক শিক্ষার জন্য শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা , বিনামূল্যে শিক্ষাপ্রদানের জন্য শিক্ষাসত্র প্রতিষ্ঠা - ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির স্নেহছায়ায় এক অভিনব শিক্ষা ব্যবস্থার সূচনা করেন। তাঁর শান্তিনিকেতনের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতির মাঝে শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে শিশুদেরকে উন্মুক্ত পরিসরে জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করা। 

শিক্ষার উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি :- 
রবীন্দ্রনাথের মতে , শিক্ষার উদ্দেশ্য হল প্রকৃত মানুষ তৈরী করা। শিশুদের প্রকৃত মানুষ তৈরী করতে হলে শিক্ষাকে মুক্ত প্রকৃতির কোলে প্রদান করা প্রয়োজন। তাঁর মতে , মানুষের দুটি পরিবেশ - সমাজ ও প্রকৃতি। সমাজ থেকে মানুষ পায় তার ভাষা , ভাবসম্পদ , রীতিনীতি - ইত্যাদি। অন্যদিকে দেহ ও মনের উন্নতির জন্য মানুষ ঋণী প্রকৃতির কাছে। তিনি বিশ্বাস করতেন , তৃণ - গুল্ম - লতা , জলধারা , বায়ুপ্রবাহ , অনন্ত প্রাণী পর্যায় , জগতের সকল অণু - পরমাণু - সবকিছুর সঙ্গেই মানুষ সরাসরিভাবে সংযুক্ত। তিনি মনে করতেন শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে প্রভাতের আলো , শ্যামল প্রান্তর , বৃক্ষরাজি - সবকিছুই হবে শিশুর শিক্ষক। 

মানব মনের মুক্তির পথ : প্রকৃতি :- 
প্রকৃতির আনন্দময় পরিবেশে , সহজ ও উদার প্রান্তরে শিশুমন মুক্তিলাভ করে। তাই শিশু ও প্রকৃতির মধ্যে থাকা সকল ব্যবধানকে দূর করে প্রকৃতিকে তাদের সামনে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। শিশুদের সকল জড়তা , সকল অন্ধকার , সকল বাঁধা দূর করতে পারে একমাত্র প্রকৃতি। প্রকৃতির সরলতা শিশুমনকে সরল করে তুলবে। তাই মানব মনকে মুক্তির পথ দেখাতে প্রকৃতির সান্নিধ্য একান্ত আবশ্যিক। 

পরিশেষে বলা যায় যে , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দার্শনিক উপলব্ধিগুলির মধ্যে বারবার প্রকৃতির সাথে তাঁর সহাবস্থানের প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁর দর্শনে প্রকৃতি ও মানব এক ও অভিন্ন। তাই মানুষের জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে , প্রতিটি কর্মকান্ডে প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ করা প্রয়োজন।   


You May Also Like

0 comments