রাষ্ট্রের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট :-

by - April 05, 2022

রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দাও। রাষ্ট্রের বৈশিষ্টগুলি লেখ। 

রাষ্ট্রের সংজ্ঞা ও রাষ্ট্রের উপাদান। 

Definition and features / elements of state. ( In Bengali ).  




রাষ্ট্রের সংজ্ঞা :-   


ল্যাস্কি বলেছেন - রাষ্ট্র হল এমন একটি ভূখন্ড সমন্বিত জনসমাজ যা সরকার এবং প্রজায় বিভক্ত এবং তা ভূখন্ডে অবস্থিত সকল প্রতিষ্ঠানের উপর কর্তৃত্ব দাবী করে। 

গেটেল বলেছেন - রাষ্ট্র হল স্থায়ীভাবে সুনির্দিষ্ট ভূখন্ডের অধিকারী জনসমাজ। এই জনসমাজ সকল প্রকার বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত এবং এই জনসমাজ একটি সরকারের অধীনে থাকে। এই সরকার রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জন্য আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করে। 

বার্জেস বলেছেন - কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে রাজনৈতিক দিক থেকে সংগঠিত জনসমষ্টি। 

গার্নার বলেছেন - রাষ্ট্র হল এমন একটি জনসমাজ যা কোনো নির্দিষ্ট ভূখন্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে এবং যা বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ বা প্রায় মুক্ত এবং যার একটি সুসংগঠিত সরকার আছে এবং ভূখন্ডে বসবাসকারী বেশিরভাগ জনগণ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। 

উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলির মধ্যে গার্নার প্রদত্ত সংজ্ঞাকেই অধিক গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয়। তবে মার্কসবাদীরা রাষ্ট্র সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করেন। মার্কসবাদীদের মতে , রাষ্ট্র হল শ্রেণীশোষণের হাতিয়ার ও উৎপীড়নের যন্ত্র। রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এক শ্রেণীর মানুষ অন্য এক শ্রেণীর উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। 

সর্বোপরি বলা যায় , রাষ্ট্র হল এমন এক সংগঠন যার একটি সুনির্দিষ্ট জনসমাজ আছে এবং এই জনসমাজ নির্দিষ্ট ভূখন্ডে বসবাস করেন। এই জনসমাজ তার সকল ক্ষমতা একটি সরকারের উপর ন্যাস্ত করে এবং এই জনসমাজ সম্পূর্ণভাবে বা প্রায় বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত। 


রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট / রাষ্ট্রের উপাদান :- 


রাষ্ট্রের উপাদানগুলিকে মূলতঃ দুই ভাগে ভাগ করা যায় - অপরিহার্য বৈশিষ্ট বা উপাদান ; এবং অপরিহার্য নয় - এমন বৈশিষ্ট বা উপাদান। রাষ্ট্রের অপরিহার্য বৈশিষ্ট বা উপাদানগুলি হল - নির্দিষ্ট জনসমষ্টি , নির্দিষ্ট ভূখন্ড , সরকার ও সর্বভৌমিকতা। এছাড়া অপরিহার্য নয় - এমন বৈশিষ্ট বা উপাদানগুলি হল - স্থায়িত্ব , অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও জাতীয়তাবাদ। 

১. নির্দিষ্ট জনসমষ্টি :- নির্দিষ্ট জনসমষ্টি রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট। প্রাচীন ইউরোপে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনসমষ্টি বিশিষ্ট রাষ্ট্রের অস্তিত্ব দেখা যায়। প্লেটো , অ্যারিস্টটল - প্রমুখেরা স্বল্প জনসংখ্যা বিশিষ্ট রাষ্ট্রকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। কিন্তু বর্তমানে বৃহৎ জনসমষ্টিযুক্ত রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বর্তমান। ভারত , চীন , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র - প্রভৃতি রাষ্ট্রে বিপুল জনসংখ্যা বর্তমান। 

জনসমষ্টিকে মূলতঃ তিনভাগে ভাগ করা যায় - 
(ক ) নাগরিক - রাষ্ট্রের প্রতিটি সদস্য যাদের আইনগত স্বীকৃতি আছে - তারা হলেন নাগরিক। 
(খ ) বিদেশি - একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অন্য রাষ্ট্রের যে সকল সদস্যরা বাস করে - তারা হলেন বিদেশি। 
(গ ) প্রজা - কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপনিবেশে বসবাসকারী নাগরিকেরা হলেন সেই সাম্ৰাজ্যবাদী শক্তির প্রজা। 


২. নির্দিষ্ট ভূখন্ড :- নির্দিষ্ট ভূখন্ড হল ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা বেষ্টিত একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকা। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরস্থ সকল প্রকার ভূমিরূপ - পাহাড় - পর্বত , নদ - নদী , আকাশ পথ , সমুদ্র উপকূল , বনাঞ্চল - ইত্যাদি সকল প্রকার ভূমিরূপগুলি রাষ্ট্রীয় ভূখন্ডের অন্তর্ভুক্ত। তবে , সমুদ্র উপকূল ও আকাশ পথের ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ আন্তর্জাতিক আইন প্রচলিত আছে। রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট ভূখন্ডের উপরে ১০০ - ১১০ কিলোমিটার পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন। অন্যদিকে , সমুদ্র উপকূলে রাষ্ট্রীয় সীমারেখার ক্ষেত্রে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে , সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ কর্তৃক গৃহীত সামুদ্রিক আইন সংক্রান্ত তৃতীয় সম্মেলনে ১২ মাইল পর্যন্ত এলাকাকে রাষ্ট্রীয় ভূখন্ডের অংশ বলে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। 

রাষ্ট্রীয় ভূখন্ডের আয়তন সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। যেমন - রুশো ক্ষুদ্র আয়তন বিশিষ্ট রাষ্ট্রকে আদর্শ বলে মনে করতেন। তবে , ট্রিটসকে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রকে '' পাপের প্রতীক '' বলে মনে করতেন। রাষ্ট্রীয় ভূখন্ড বৃহৎ হলে বৃহৎ জনসমষ্টি দ্বারা তার সম্পদকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা যায়। আবার রাষ্ট্রীয় ভূখন্ড ক্ষুদ্র হলে জাতীয়তাবাদ , গণতন্ত্র - ইত্যাদির সহজ বিকাশ ঘটে। 

৩. সরকার :- রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান প্রতিষ্ঠান হল সরকার। সরকার ব্যতীত রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের কল্পনা করা যায়না। সরকারের মাধ্যমেই রাষ্ট্র মূর্ত হয়ে ওঠে। সরকারের মাধ্যমেই রাষ্ট্রীয় ইচ্ছা , আদর্শ , নীতি , কর্মসূচি - গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়। 
ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মাঝে সেতুবন্ধনের কাজ করে সরকার। জনকল্যাণকামী নীতি , সামাজিক স্বার্থ , মানুষের ন্যুনতম দাবী - ইত্যাদি বাস্তবায়িত হয়। রাষ্ট্রের সকল অভ্যন্তরীণ নীতি সহ রাষ্ট্রীয় স্বার্থে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনা করে সরকার। 
বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন ধরণের সরকারের অস্তিত্ব চোখে পড়ে। যথা - গণতান্ত্রিক , একনায়ক , রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার , মন্ত্রিসভা পরিচালিত সরকার , এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার - ইত্যাদি। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন , বর্তমান বিশ্বে প্রতিটি সরকারের কাজের পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে ; এর মূল কারণ হল বিশ্বায়ন , জনকল্যাণকামী নীতির প্রণয়ন , আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি - ইত্যাদি। 

৪. সর্বভৌমিকতা :- রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম মৌলিক এবং অপরিহার্য উপাদান হল সর্বভৌমিকতা। সার্বভৌম ক্ষমতা হল এমন এক চূড়ান্ত ক্ষমতা যার দ্বারা রাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র বিষয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ , নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারে। সর্বভৌমিক ক্ষমতা ব্যতীত রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অর্থহীন। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অবস্থিত সকল প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ও আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যে চূড়ান্ত ক্ষমতা ভোগ করে - তা'ই হল সর্বভৌমিকতা। 

রাষ্ট্রীয় সর্বভৌমিকতাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় - অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক। অভ্যন্তরীণ সর্বভৌমিকতা দ্বারা রাষ্ট্র তার অভ্যন্তরস্থ সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর চূড়ান্ত কর্তৃত্ব দাবী করে , নীতি প্রণয়ন বাস্তবায়ন করে। আবার বাহ্যিক সর্বভৌমিকতা হল রাষ্ট্রের সেই ক্ষমতা যার দ্বারা রাষ্ট্র সকল প্রকার নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে বিদেশনীতি পরিচালনা করতে পারে ও আন্তর্জাতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে। 


৫. জাতীয়তাবাদ :- রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকে জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট হিসেবে মনে করার পক্ষপাতী। তাদের মতে , রাষ্ট্রের নাগরিকেরা যদি রাষ্ট্রের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের বন্ধনে আবদ্ধ না হন তাহলে যথাযথভাবে রাষ্ট্রীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা। কিন্তু এই ধারণার বিপক্ষে সমালোচনাও বিস্তর। বিশ্বায়নের যুগে বিশেষ কারণ ছাড়া জাতীয়তাবাদ সুপ্ত চিন্তাধারায় পরিণত হয়েছে। তাছাড়া , অতিমাত্রায় জাতীয়তাবাদ বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রশ্রয় দেবে ; রাষ্ট্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে পড়বে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিরোধের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। 

৬. স্থায়িত্ব :- কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্থায়িত্বকে রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করেন। কিন্তু এই ধারণা সর্বজনীন স্বীকৃতিলাভ করেনি। মার্কসবাদীরা মনে করেন , শোষণের যন্ত্র হিসাবেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটেছে এবং শ্রেণীহীন ও শোষণমুক্ত সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেই রাষ্ট্রীয় ধারণা বিলুপ্ত হবে। 

৭. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি :- অনেকে মনে করেন যে অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতিও রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য উপাদান। কিন্তু এই ধারণা সঠিক নয়। কেননা , রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতির উপর নির্ভরশীল নয়। অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতির বিষয়টি অধিকাংশক্ষেত্রেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রনোদিত। রাজনৈতিক স্বার্থেই গণপ্রজাতন্ত্রী চীন , সোভিয়েত রাশিয়া - ইত্যাদি রাষ্ট্রকে পাশ্চাত্য ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি বহুদিন স্বীকৃতি প্রদান করেনি। 

পরিশেষে বলা যায় , রাষ্ট্রের মৌলিক ও প্রধান উপাদান চারটি - নির্দিষ্ট জনসমষ্টি , নির্দিষ্ট ভুখন্ড , সরকার ও সর্বভৌমিকতা। অন্যান্য উপাদানগুলি রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক ;কিন্তু অপরিহার্য উপাদান নয়।    



You May Also Like

0 comments