রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আলোচনা কর।

by - April 04, 2022

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আলোচনা কর। 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি :- 

Discuss Marxism in the discussion of political science. ( In Bengali ). 




ভূমিকা :- 
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিগুলির মধ্যে অন্যতম হল মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি। মার্কসবাদ এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে সমাজ ও মানুষের রাজনৈতিক জীবনকে বিশ্লেষণ করেছেন। মার্কসবাদ অনুসারে সমাজে দ্বন্দ্ব সর্বদা বিদ্যমান। এই দ্বন্দ্ব হল সমাজে অবস্থানকারী বিভিন্ন শ্রেণীগত স্বার্থের বিরোধ। মানুষের রাজনৈতিক জীবন এই দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে থাকে। মার্কসবাদী দর্শনে রাষ্ট্র হল সমাজের একটি উপরি - কাঠামো। এবং এই উপরি - কাঠামোর মূল ভিত্তি হল অর্থনীতি। রাজনীতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেনিন বলেছেন , রাজনীতি হল শ্রেণীসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক ; যে সম্পর্কের ভিত্তি হল অর্থনীতি। 


রাষ্ট্র একটি উপরি - কাঠামো :- 
উপরি - কাঠামো হল রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সমস্ত প্রতিষ্ঠান , সামরিক ব্যবস্থা , পুলিশ , বিচারালয় , শিক্ষা , সাহিত্য , সংস্কৃতি , ধর্ম , দর্শন - ইত্যাদি সমস্ত কিছুর যোগফল। এই উপরি - কাঠামোর মূল ভিত্তি হল অর্থনীতি। এক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে। এই উৎপাদন ব্যবস্থার ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে মানুষের রাজনৈতিক জীবন। এই রাজনৈতিক জীবন রাষ্ট্র দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত হয়। 

রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অর্থনীতির ভূমিকা :- 
মার্কসবাদী রাজনৈতিক দর্শনে মানুষের রাজনৈতিক জীবনে অর্থনীতিকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকার করা হয়েছে। রাষ্ট্র , রাজনৈতিক জীবন ও অর্থনীতি পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। তাই রাজনৈতিক জীবনকে বিশ্লেষণ করতে হলে অর্থনীতির আলোচনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। অর্থনীতি ও রাজনীতিকে বিচ্ছিন্নভাবে আলোচনা করা সম্ভব নয়। মার্কসবাদীদের মতে , রাষ্ট্রীয় উপরি - কাঠামোর সকল অংশগুলির মূল ভিত্তি হল অর্থনীতি। 


অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে রাজনীতির ভূমিকা :- 
মার্কসবাদী রাষ্ট্রদর্শনে অর্থনীতিকে রাষ্ট্রীয় উপরি - কাঠামোর মূল নিয়ন্ত্রক বলা হলেও এই অর্থনীতিকে পক্ষান্তরে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে রাজনীতি। এ প্রসঙ্গে লেনিন বলেছেন - Politics must take precedence over economics.  । রাষ্ট্রীয় উপরি - কাঠামো ও রাজনীতির সংমিশ্রনে তৈরী হয় কোনো একটি রাষ্ট্রের অর্থনীতি। প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হিসাবে অর্থনীতি সমাজ - পরিকাঠামোর বৈশিষ্টগুলি নির্ধারণ করে। 

সমাজ একটি অবিভাজ্য সামগ্রিক সত্তা :- 
মার্কসবাদ হল একটি বিশ্ববীক্ষা ; তাই মার্কসবাদ সমাজের বিশেষ কোনো অংশকে নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে আলোচনা করেনা। সমাজের মধ্যেকার রাজনীতি , অর্থনীতি , সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রের অন্যান্য উপরি - কাঠামোগুলি সম্পর্কে বিচ্ছিন্নভাবে আলোচনা করা মার্কসবাদীরা কৃত্রিম ও খামখেয়ালি বলে মনে করেন। মার্কসবাদের মতে , সমাজ হল একটি সামগ্রিক সত্তা ; তাই সমাজের আলোচনায় সকল অংশগুলিকে সমন্বিত করা উচিত। 

ঐতিহাসিক বস্তুবাদ :- 
মানব সমাজ বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আদিম সমাজ থেকে বর্তমান সমাজে উপনীত হয়েছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধিততে সমাজ বিবর্তনের বিশ্লেষণই হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। মার্কসবাদ বিজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে যুক্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে সমাজ বিকাশের ধারাটিকে বিশ্লেষণ করে থাকে এবং এই বিবর্তনের মধ্যে যে চালিকা শক্তি থাকে তার সম্পর্কে পরীক্ষণ , পর্যবেক্ষণ ও সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ও তার স্বরূপ তুলে ধরে। 

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ :- 
মার্কসবাদ অনুসারে , সমাজ সর্বকালেই পরিবর্তনশীল ও ক্রমবর্ধমান। এই ক্রমবর্ধমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে উৎপাদন শক্তির সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্কের বিরোধ তৈরী হয়। এর ফলে সমাজে বিপ্লবের সূচনা হয়। এই বিপ্লব সমাজের প্রতিটি কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করে। এইভাবেই সমাজ একে একে আদিম সমাজ থেকে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সমাজ , তারপর দাস ও সামন্ততান্ত্রিক সমাজ , তা থেকে ধনতান্ত্রিক ও রাজতান্ত্রিক সমাজ এবং তা পরিবর্তিত হয়ে গণতান্ত্রিক সমাজ ও আধুনিককালে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের জন্ম হয়েছে।     


ইতিহাস প্রসঙ্গে মার্কসবাদ :- 
মার্কসবাদীরা সমাজ পরিবর্তনের ধারাটিকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ইতিহাসের উপর জোর দিয়েছেন। তাই ইতিহাসকে তাঁরা কেবল রাজার বা যুদ্ধের কাহিনী বা সাম্রাজ্যের উত্থান - পতনের কাহিনী হিসেবে বিবেচনা করেন না। মার্কসবাদীদের মতে , ইতিহাস বিবর্তনের ধারায় সমাজ বিকাশের মূল চালিকা শক্তিটিকে চিহ্নিত করে সমাজ বিবর্তনের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনায় সহায়তা করে।   

মার্কসবাদের বৈজ্ঞানিক যথার্থতা :- 
রাজনৈতিক বিশ্লেষণের অন্যান্য সকল পদ্ধতিগুলির মধ্যে একমাত্র মার্কসবাদকেই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বলা হয়। মার্কসবাদের আলোচনার সাহায্যে সমাজ বিকাশের ধারাটিকে যথার্থভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। এ প্রসঙ্গে এঙ্গেলস বলেছেন , মার্কসবাদ কোনো বদ্ধ ধারণা নয় ; মার্কসবাদ হল একটি পদ্ধতি ও অনুসন্ধান পদ্ধতি যার সাহায্যে মানুষের রাজনৈতিক জীবনকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। 

গতিশীলতা :- 
সমাজের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রাজনৈতিক জীবন গতিশীল। তাই মার্কসবাদ তার আলোচনা ক্ষেত্রকে  কোনো সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চাননি। যুগের বিবর্তনের সাথে সাথে মার্কসবাদ সেই বিবর্তন থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে ও রাজনৈতিক আলোচনাকে সমৃদ্ধ করেছে। পরিবর্তনশীল সমাজ থেকে মার্কসবাদ উপাত্ত সংগ্রহ করে তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় প্রয়োগ করে। 

সাম্যবাদ ও সর্বহারার একনায়কতন্ত্র :-
সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য লেনিন রাজনৈতিক শ্রেণিসংগ্রামকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার প্রধান শর্ত হল - কৃষক , শ্রমিক , সর্বহারা কর্তৃক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা। একমাত্র তাহলেই প্রকৃত অর্থে ধনতান্ত্রিক ও সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটবে। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় দুটি শ্রেণী অবস্থান করে - অধিকারভোগী ও অধিকারহীন শ্রেণী। সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে এই শ্রেণী বৈষম্যের অবসান ঘটবে। 

পরিশেষে বলা যায় , মার্কসবাদ  সামগ্রিকভাবে ইতিহাস , বিবর্তনবাদ ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ভিত্তিতে সমাজ বিবর্তনের ধারাটিকে বিশ্লেষণ করে এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে খন্ড খন্ড করে আলোচনার পরিবর্তে সামগ্রিকভাবে আলোচনা করে। এর সঙ্গে সঙ্গে সমাজে অবস্থানকারী শ্রেণী ও শ্রেণিদ্বন্দ্ব , সাম্যবাদ , সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে।



You May Also Like

0 comments