রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আলোচনা কর।

by - April 03, 2022

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আলোচনা কর। 

আচরণবাদ কাকে বলে ? এর বৈশিষ্ট ও সীমাবদ্ধতাগুলি লেখ। 

Behaviorist approach in the discussion of political science. ( In Bengali ).




আচরণবাদের অর্থ ও ধারণা :- 


রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় সনাতন দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সীমাবদ্ধতা বর্তমান। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিংশ শতকের প্রথম পর্বে আচরণবাদের উদ্ভব ঘটে। আচরণবাদ হল মূলত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে রাজনীতিকে ব্যাখ্যার চেষ্টা ও মনোবিদ্যা , সমাজবিদ্যা , অর্থনীতি , নৃতত্ব - ইত্যাদি বিষয়ের সাহায্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়গুলিকে বিজ্ঞানসম্মত করে তোলার পক্ষপাতী। রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করাই হল আচরণবাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। 

রবার্ট ডাল আচরণবাদকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে একটি প্রতিবাদ আন্দোলন বলে বর্ণনা করেছেন। 

আর্নল্ড ব্রেখট আচরণবাদকে রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে একটি অভিজ্ঞতাবাদী এবং চিরস্থায়ী তত্ত্ব গড়ে তোলার প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করেছেন। 


আচরণবাদের বৈশিষ্ট :- 


১. আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ ঘটনা , কাঠামো , প্রতিষ্ঠান ও মতাদর্শের পরিবর্তে ব্যক্তি ও সামাজিক গোষ্ঠীর আচরণকে তাত্ত্বিক ও অভিজ্ঞতাবাদী বিশ্লেষণের একক বা লক্ষ্য বলে গ্রহণ করেন। 

২. আচরণবাদ রাজনৈতিক তত্ত্ব ও গবেষণার গন্ডিকে সমাজ - মনোবিদ্যা ও সংস্কৃতিগত নৃতত্ব পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার পক্ষপাতী। 

৩. রাজনৈতিক আচরণবাদ তত্ত্ব ও গবেষণার পারস্পরিক নির্ভরশীলতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। আচরণবাদ পূর্বেকার বর্ণনাত্মক অভিজ্ঞতাবাদের মত নিছক ঘটনাকে নিয়ে আলোচনা করে না ; আত্মসচেতনভাবেই তা তত্ত্বকেন্দ্রিক। 

৪. আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ ক্ষমতা প্রয়োগের সঙ্গে যুক্ত যেকোনো কার্যকেই রাজনৈতিক কার্য বলে বিবেচনা করে তাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাসূচির অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী। 

৫. একটি সুসংবদ্ধ অভিজ্ঞতাবাদী রাজনৈতিক তত্ত্ব গঠন করাই হল আচরণাবাদীদের প্রকৃত উদ্দেশ্য। তাঁরা মূল্যের পরিবর্তে ঘটনার উপর গুরত্ব প্রদান করেন। আচরণবাদীরা তাঁদের আলোচনাকে মূল্যমান নিরপেক্ষ করে তোলার পক্ষপাতী। 

৬. সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাগুলির সাথে সম্পর্ক স্থাপনের উপর গুরত্ব প্রদান করেন আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ। তাঁদের মতে , সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সাথে সংযোগ স্থাপন না হলে ব্যক্তির সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা পূর্ণাঙ্গভাবে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। 

৭. আচরণাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ রাজনৈতিক সমস্যাসমূহের বিশ্লেষণের উপর গুরত্ব আরোপ করেন। তাঁরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে রাজনৈতিক সমস্যাগুলির বিশ্লেষণ করেন। 


আচরণাবাদের সমালোচনা / সীমাবদ্ধতা :- 


১. আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ রাজনীতির একটি সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নিরুপনে ঐক্যমত্য হতে পারেননি। কেবলমাত্র মানুষের আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতির সংজ্ঞা নিরুপন করা যায়না বলে সনাতন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ অভিযোগ করেন। 

২. আচরণবাদের বিরুদ্ধে অন্যতম সমালোচনা করা হয় যে , আচরণবাদ সংখ্যাতত্ত্বের নামান্তর। কেননা , আচরণবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় সংখ্যাতত্বকে অধিক মাত্রায় গুরুত্ব প্রদান করে। 

৩. আচরণবাদ মূল্যবোধকে অস্বীকার করে। তাই আচরণবাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে , আচরণবাদীরা রাজনৈতিক বিশ্লেষণে কেবলমাত্র তথ্য , তালিকা ও রেখাচিত্র ব্যবহার করে - এগুলির মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবনের যথাযথ বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। 

৪. অনেকেই আচরণবাদকে রক্ষণশীল মতবাদ হিসাবে সমালোচনা করেন ; কেননা , আচরণবাদ বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষপাতী। আচরণবাদ কখনই সমাজ পরিবর্তন , রাষ্ট্র বিপ্লব , সমাজ পরিবর্তন - এগুলি নিয়ে আলোচনা করেনা। 

৫. মানুষের রাজনৈতিক জীবনের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আচরণবাদীরা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নিয়মগুলিকে অন্ধভাবে অনুকরণ করেছেন। মানুষের সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনের বিশ্লেষণে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রেই অযৌক্তিক। 

৬. অনেকে অভিযোগ করেন যে আচরণবাদীরা নিজেদের আলোচনাকে মূল্যমান নিরপেক্ষ করে তোলার পক্ষপাতী হলেও বাস্তবে তা মূল্যমান নিরপেক্ষ নয়। কেননা , আচরণবাদীরা মার্কিন গণতন্ত্রকেই উপযুক্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে মনে করে রাজনৈতিক বক্তব্য পেশ করেন। 

৭. আচরণবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে অধিক মাত্রায় সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার উপর নির্ভরশীল করে তুলেছে। ফলে সমালোচকদের অনেকেই মনে করেন এর ফলে আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মৌলিক বৈশিষ্ট ক্ষুন্ন করেছেন। 

পরিশেষে বলা যায় , উপরোক্ত বিভিন্ন সীমাবদ্ধতাগুলির জন্য আচরণবাদী আন্দোলন দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়নি। তবে , আচরণবাদী আন্দোলনের পর উত্তর - আচরণবাদী আন্দোলন শুরু হয় যা সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সমন্বয়সাধন করার প্রয়াস করেছে।  


You May Also Like

0 comments